সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার আশঙ্কা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০২৩, ১২:৫২:৪৯ অপরাহ্ন
অন্জন কুমার রায়
গত বছর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট এবং সুনামগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। ভারী বর্ষণের সাথে উজানের ঢল নেমে বন্যা অনেকদিন স্থায়ী ছিল। নদীর পানি এবং ঢলের পানি চারিদেকে প্লাবিত হয়ে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। বৃষ্টি এবং বজ্রপাত উপেক্ষা করে মানুষ ছোটে গিয়েছিল আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, উঁচু ভবন কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। এক দফা নয়, দুই দফা বন্যা হয়েছিল। প্রথম বার বন্যার দখল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় বার বন্যা হয়েছিল। জনগণের চরম ভোগান্তির পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। যার ধকল কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। তবে, ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত থাকায় কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছিল।
পরপর দুই দফা বন্যার ভয়াবহতা মানুষ এখনো ভুলতে পারেনি। সে বছর হঠাৎ করে একদিনের কয়েক ঘন্টার টানা বর্ষণে সিলেট এবং সুনামগঞ্জের যাতায়াতের রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যায়। মানুষের চলাচলে দুর্ভোগ নেমে আসে। সিলেটের সাথে সুনামগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা কয়েকদিন বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট সেবাও ব্যাহত হয়েছিল। সুনামগঞ্জের মানুষ কয়েকদিন বিদ্যুতহীন অবস্থায় অন্ধকারে ছিল। মানুষের গরু, হাঁস, মুরগীসহ অনেক গৃহপালিত পশু বন্যর পানিতে ভেসে গিয়েছিল। সবকারি হিসাবে এ বন্যায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘরের আসবাবপত্র, গোলার ধান, মাছের খামার, গবাদি পশু ভেসে যায়। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
এ বছর টানা কয়েক দিন যাবৎ জ্যৈষ্ঠের খরতাপে পুড়েছে সারা দেশ। তীব্র গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। কয়েকদিন যাবৎ স্বস্তির বৃষ্টি হলেও গত কয়েকদিন থেকে সিলেটে বৃষ্টিপাত বেড়েছে। তাই সিলেট শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অনেক স্থান হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। শহরের চলাচলের রাস্তাসহ বিভিন্ন বিপণীবিতানে বৃষ্টির পানি ঢুকে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। প্রতিদিনই টানা বর্ষণ হচ্ছে। উজানের ঢলে নেমে আসা পানি এবং বৃষ্টিতে নদীর পানি বাড়তে থাকে।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্রমতে, গত ১৩ জুন ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়েছে। পাউবো সূত্রে জানা যায়, একই দিনে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি ৯১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও ভারতের মেঘালয়ে অতিবৃষ্টির কারণে উজান থেকে ঢল নেমে আসছে। ফলে, সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে সুরমা, কুশিয়ারা, রক্তি, কালনী, ধোপাজান ও জাদুকাটা নদী দিয়ে বিভিন্ন হাওড়ে ঢলের পানি প্রবেশ করছে। তাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও সুনামগঞ্জের বিশ্বম্বরপুর- তাহিরপুর সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। এতে যান চলাচল বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানা যায়, পানি বাড়া অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ১৩ জুন সকাল ছয়টা পর্যন্ত ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। পরের দিন সকাল ছয়টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ১৫১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। গত ১৮ জুন সিলেটের কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জের ছাতকে সুরমা নদীর পানি কিছুটা বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে নিম্নাঞ্চল কিছুটা প্লাবিত হয়েছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, সুরমা নদীর কানাইঘাটে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। গত ১৭ জুন সন্ধ্যায় ছিল ১২ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। সিলেট পয়েন্টে একই দিনে ৯ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। যেখানে সিলেটে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। অন্যদিকে, কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। সেখানে একই দিনে ছিল ১১ দশমিক ১০ সেন্টিমিটার।
প্রতিদিনের বৃষ্টি এবং উজানের ঢলে নেমে আসা পানি দেখে মানুষের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে। ২০২২ সালেও এভাবেই অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ এবং সিলেট পানির নিচে নিমজ্জিত হয়। সেই শঙ্কা থেকে এখন নদ-নদীর পানি বাড়া দেখে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। বর্তমানে সুরমা এবং কুশিয়ারা নদী পানিতে টইটুম্বর হয়ে আছে। এছাড়াও টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ বিভিন্ন হাওড় পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে যেকোন সময় বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা টানা ভারি বর্ষণে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা আরো প্রবল হচ্ছে।
এছাড়াও ভাটি অঞ্চলে পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা স্ফীত হয়ে আসায় পানির স্বাভাবিক গতি বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন বাঁধ নির্মাণ করায় পানি নিষ্কাশনে অসুবিধা দেখা দেয়। পাশাপাশি শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং ছোট ছোট খাল বা ছড়াগুলো দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীতীর ভেঙে যাওয়া এবং নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির স্বাভাবিক গতিপথ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীর তলদেশ অনেকাংশ ভরাট হয়ে গিয়েছে। নদীর বিভিন্ন অংশ দখল হয়ে জনবসতি কিংবা দোকানপাট গড়ে উঠেছে। ফলে নদী আয়তন কমে পানি ধারণ ক্ষমতা কমে
আসছে। ফলে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়।
তবে, বন্যার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় আগে থেকেই কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বন্যার সময় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। পয়ঃনিষ্কাশন এবং বন্যার পানি একাকার হয়ে রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়। ফলে আমাশয়, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া জ-িসের মতো পানি বাহিত রোগবালাই বাড়তে থাকে। ঠা-াজনিত এবং মশা মাছির উপদ্রবে শিশুদের স্বর্দি, জ্বর, কাশি বেড়ে যায়। সেজন্য ওরস্যালাইন এবং পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রাখা জরুরী। প্রয়োজনে শুকনো খাবার যতটুকু সম্ভব সাথে রাখতে হবে। বন্যার আগাম প্রস্তুতির জন্য ঘরে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু খাদ্যের ব্যবস্থা, গবাদিপশুর খাদ্য সংরক্ষণ করে রাখা জরুরী। এছাড়াও নিরাপদ আশ্রয় সন্ধান করে রাখা যাতে প্রয়োজনমতে সেখানে আশ্রয় নেয়া যায়।
তবে, শহরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে শহর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করতে হবে যা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সুরমা ও কুশিযারা নদী খননে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা খালগুলোতে (স্থানীয় ভাষায় ছড়া) পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরী। বিশেষ করে সিলেটের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা মালনিছড়া, যোগিনীছড়া, গোয়ালীছড়া, কালীবাড়িছড়া, মঙ্গলীছড়া, হলদিছড়া, ভুবিছড়া, ধোপাছড়া ও গাভীয়ার ছাড়াগুলোর পানি প্রবাহ নিশ্চিত হলে শহরের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে কিছুটা রক্ষা পাবে। এছাড়াও বন্যার কারণ ও প্রতিকারের স্থায়ী উপায়ে নিরুপণ করতে হবে। পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কার্যকরের ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি করা যাবে বন্যার আশঙ্কা তত কমে আসবে। আশার কথা, পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে প্রস্তুতি নিতে বলেছে প্রশাসন।
লেখক : ব্যাংকা কর্মকর্তা।