বিবেকই হোক ঘুষ-দুর্নীতির আদালত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০২৩, ৮:১৫:৫৫ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
আসলে যেকোন পত্রিকার বাক্সবন্দী খবরগুলোর গুরুত্বটাই অন্যরকম। তেমনি একটি বাক্সবন্দী খবর পাই ২৯.৩.২০২৩ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার ‘বিদেশের খবর’ পাতায়। আর সেটি হলো- ‘দুর্নীতি করার অনুমতি চাই’ শিরোনামে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত খবরটি হলো, ‘আর্থিক সংকটে পাকিস্তানের হাল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে বাড়তে ৪৭ শতাংশে পৌঁছেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন সে দেশের নাগরিকরা। এই পরিস্থিতিতে ন্যূনতম চাহিদা পূরণে দুর্নীতির রাস্তায় হাঁটতে চেয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে চিঠি দিলেন এক শীর্ষ কর কর্মকর্তা। যা ঘিরে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে সেদেশে। নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে দুর্নীতিতে যুক্ত হতে চাই এই মর্মে পাক প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন ওই কর্মকর্তা দুর্নীতিতে লিপ্ত হওয়ার জন্য পাক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি অনুমতি চেয়েছেন। ঐ চিঠির মাধ্যমে পাকিস্তানের উল্লেখিত কর কর্মকর্তা কি বুঝাতে চাচ্ছেন তা জানা না গেলেও বলা চলে যে তার চিঠিটা ন্যাকামী বৈ আর কিছুই নয়। ঐ কর্মকর্তার তো এটুকু জ্ঞান অবশ্যই রয়েছে যে, পাক প্রধানমন্ত্রী এতো অর্বাচীন নন যে তিনি সেদেশের সরকারি/বেসরকারি সকল কর্মকর্তাদের দুর্নীতি করার অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবেন। আর ঐ কর কর্মকর্তার বিভাগে কি সে দেশে কোন প্রধানমন্ত্রীর কোন অনুমতি না নিয়ে কোন প্রকার দুর্নীতি বা ঘুষ কেলেঙ্কারীর মতো কোন ঘটনা ঘটেনি? পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকে চিঠি প্রদানকারী কর কর্মকর্তা কি হলফ করে তা বলতে পারবেন কোন দুর্নীতি হয়নি সেদেশে? আমরা সকলেই জানি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্থা তাদের জরীপের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির চালচিত্র নিয়ে ফলাফল প্রকাশ করে থাকে। ঐ সমস্ত জরীপে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সেখানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা ভারতের অবস্থান, কত নম্বরে তাতো পাকিস্তানের ঐ কর কর্মকর্তার অজানা থাকার কথা নয়। তাহলে সবকিছু জেনে শুনে বুঝে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে এ ধরনের মশকরা করার কি মানে তা অন্তত আমার বোধগম্য নয়।
আর দুর্নীতি তো শুধু অর্থের সাথেই সম্পৃক্ত নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সমূহের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকার সে দেশের কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি করতে অনুমতি দেবে সেটা কি কোন নীতির কথা হলো? দুর্নীতি এবং ঘুষ ভাই ভাই। দুর্নীতি মানে যে শুধু ঘুষ ভক্ষণ তা কিন্তু নয়। ঘুষ-দুর্নীতির আভিধানিক অর্থ হলো- অন্যায় কার্যে সাহায্যলাভার্থ গোপনে প্রদত্ত পুরস্কার, উৎকোচ ইত্যাদিকে ঘুষ বলে। আর যে বা যারা ঘুষ লইয়া থাকে তাদেরকে বলা হয় ঘুষখোর। আর দুর্নীতি হলো- কু-নীতি, কু-রীতি, ন্যায় ও ধর্ম বিরুদ্ধ আচরণ। যারা দুর্নীতি করে তারা হলো- অসদাচারী, দুঃশীল, দুরাত্মা।
যে ব্যক্তি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুর্নীতি করার অনুমতি চেয়েছেন সেই ভদ্রলোকের সদয় অবগতির নিমিত্তে জানাচ্ছি যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কোন প্রধানমন্ত্রী নন, ইয়াহিয়া খান সহ পাকিস্তানের সকল কর্তাব্যক্তিমহোদয়গণ অবশ্যই দুর্নীতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ জানতেন। তারা সবকিছু জেনে-শুনে, দুর্নীতি করার কোন অনুমতি না নিয়েই কোন নীতি, রীতি, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় না এনেই বাংলাদেশে বাঙালিদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলো। মুখে মুখে বাইরে বাইরে ধর্মের কথা বলে বলে সত্যিকার অর্থেই ধর্ম বিরুদ্ধ আচরণ করেছিলো। আর এই দুর্নীতির কারণেই চরম আর্থিক সংকটের মুখোমুখি আজ পাকিস্তান। তাদের দুর্নীতির কারণেই মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে বাড়তে হয়েছে ৪৭ শতাংশ। তাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম আজ নাগরিকদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তাদের অবস্থা এক সময়ের শ্রীলঙ্কার মতো হতে যাচ্ছে কিনা কে জানে। তাই বলা চলে সেদেশের দুর্নীতি দুর্নীতিবাজদের অনুমতি চাওয়া না চাওয়া বা অনুমতি পাওয়ার ওপর একেবারেই নির্ভরশীল নয়।
আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর কোন দেশই পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত বলা চলে না। হয়তো দুর্নীতির ধরন-ধারণ আলাদা হতে পারে। কারোটা চুরি, কারোটা পুকুর চুরি, কারোটা বা সমুদ্র চুরি বলা যেতে পারে। তফাৎটা ওইটুকুই। ঘুষ-দুনীতি বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের কথাই যদি ধরা যায় তাহলে আমরা কি দেখি? আমরা দেখি, আমরা নাকি একসময় এক্ষেত্রে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম। চ্যাম্পিয়ান না হলেও এখনও নাকি আমাদের অবস্থান তালেবানি দেশ আফগানিস্তান এর পরেই। অর্থাৎ অবস্থান দ্বিতীয়। এটা কোন সুখকর বিষয় নয়। তবুও তা চলছেই। শত চেষ্টা করেও থামানো সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থাটা এমন যে, সেটা থামাবে কে! যার যার থামানোর কথা তারাই যদি শুরু করে তাহলে ঘুষ-দুর্নীতির গাড়ীর চাকাতো সচল থাকবেই। অচল হবে না কখনো। তাইতো দেখি সে গাড়ির নিয়ন্ত্রণকারী গুটিকয় সম্মানিত, শ্রদ্ধেয় চালক মহোদয়গণ অসহায়ের মতো নিরাপদ দূরে অবস্থান করে মনে মনে হারানো দিনের সেই গানের সুরে সুরে নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলেন। বলেন, ‘তুমি চলে গেলে, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, আমার বলার কিছু ছিলো না।’ আর তখনই ঘুষ দুর্নীতিকে নতুন নতুন নামে ডেকে ডেকে জাতির সামনে একটু হাসির খোরাক এনে দেন। যেমন- সহনীয় ঘুষ, সহনীয় দুর্নীতি। কেউ বলেন- স্পিডমনি, কেউ বলেন ‘টাকা রপ্তানি’ কেউ বলেন ‘পাচার’ নয়, ‘লেন দেন’। কেউ কেউ এক ডিগ্রি বাড়িয়ে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে ঘুষ খেলে অপরাধের মধ্যে পড়বে না’ এইসব কথাগুলো শুনতে শুনতে কেন জানি সুর-স¤্রাট মান্নাদের একটি গানের কলি- ‘ওযে রাগ নয় গো এ যে অভিমান’ এর কথা খুবই মনে পড়লো। সাথে সাথে মনে পড়লো ‘হারানো সুর’ সিনেমায় মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের উদ্দেশ্যে মহানায়ক উত্তম কুমারের একটি ডায়লগের কথা। কথাটি- ‘অভিমান থাকা ভালো কিন্তু তারও একটা সীমা থাকা দরকার’। বড়ো দুঃখ লাগে, কষ্ট লাগে সেই ‘দরকার’ শব্দটিকে আজকাল আমরা কেউ পাত্তা দিচ্ছি না। স্বীকার করতেই হবে যে, এটা কিন্তু একটা অশনি সংকেত।
আর সাম্প্রতিক কালের দু’একটি পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনামই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যেমন- ‘দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত দুদক কর্মকর্তার সম্পদের পাহাড়, আভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান প্রতিবেদন- ঢাকায় ফ্ল্যাট-গাড়ি, গ্রামে নিজের, স্ত্রী ও মেয়ের নামে হাজার শতক জমি, বিভিন্ন কোম্পানিতে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ।’ (আমাদের সময় ১২.৪.২০২৩)।
পত্রিকাটির ভাষ্য মতে উল্লেখিত দুদক কর্মকর্তার নাম মুহ. মাহবুবুল আলম। দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক তিনি। ভদ্রলোকের পেশাগত দায়িত্ব হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। সরকার নিয়োজিত এক (বীর?) যোদ্ধা তিনি। এখন জনমনে প্রশ্ন- কার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ? বাস্তবে দেখা যায়, আসলে যুদ্ধ তার নিজের সম্পদ আহরণের। তার যুদ্ধের সহযোদ্ধা তার স্ত্রী, মেয়ে। তার স্ত্রী বা মেয়েকে তো যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়নি সরকার? তবু এ কর্মকর্তার সহযোদ্ধা তার স্ত্রী ও মেয়ে। স্ত্রীর দায়িত্ব স্বামীকে সৎ পথে পরিচালনা করা। কিন্তু এতো সম্পদ কি করে অর্জন করলেন তার স্বামী প্রবরটি তাতো তিনি জানতে চাইলেনই না বরং মা মেয়ে মিলে সরিষার মধ্যে এক ভূতের জন্ম দিলেন। যা হবার তো হয়েই গেছে। দেশের জনগণ এখনো দুদককে সরিষা বলেই বিশ্বাস করেন। বাংলার কোন মায়ের গর্ভে যেন এমন কোন ভূতের জন্ম না হয় এমনি প্রত্যাশাই সমগ্র জাতির।
এবার একটি অন্যরকম খবর। অন্যরকম শিরোনাম। আর সেটি হলে- ‘ঘুষের টাকা কম হওয়ায় ছিঁড়ে ফেললেন এস.আই (দৈনিক জনকন্ঠ ৯.৪.২০২৩)’। টাকার অংক যত ছোটই হোক, তা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার মতো ঘটনা জীবনে কখনো শুনিনি। এক গরীব বিচার প্রার্থীর কাছে দশ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করে পেকুয়া থানার এস আই ইসমাইল। ঐ গরীব বিচারপ্রার্থী কোন রকমে ৩ হাজার টাকা জোগাড় করে এস.আই.কে দিলে এস.আই. ইসমাইল ভীষণ ক্ষেপে যায় এবং এই তিন হাজার টাকা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে রেগে গিয়ে বলতে থাকে- ‘এই শালা এই অল্প টাকা এগুলো কি গাড়ি ভাড়া দেব, নাকি স্যারকে দেব বা আমি নেব?’ এই এস.আই এর কথা যদি সত্য হয় তাহলে বুঝতে কোন অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে, এস.আই. হলেন স্যার, তারও স্যার আছেন, স্যারেরও স্যার আছেন। এভাবে একটি ‘স্যারের’ চেইন রয়েছে। যে চেইন এর মাধ্যমে সব কাজ কারবার চলে আসছে। তা চলছে চলুক। মানুষ এ নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছেন না। সব ‘স্যার’দের কাজ। কারো কি বলা-কওয়ার ক্ষমতা আছে? তবে টাকা ছিঁড়ে ফেলা! সেতো রাষ্ট্রীয়ভাবে দ-নীয় অপরাধ। তাদের অপরাধের বিচার না হলে ওরাতো বঙ্গবন্ধুর নৌকাকে ফুটো করে দেবে। নৌকাডুবির মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তাইতো বলি কা-ারী হুশিয়ার।
তাইতো দেখি আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ জেলা প্রশাসক সম্মেলনে কিছু সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘নিজে দুর্নীতিমুক্ত এবং অন্যরাও যাতে দুর্নীতির সুযোগ না পায় সেদিকেও খেয়াল রাখবেন।’ ডিসিদের সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যাতে না হয় সেদিকেও নজর দিতে বলেন। তবে যে যা-ই বলুন না কেন সব কিছু নির্ভর করে মানসিকতার ওপর। বিবেকের ওপর। মনে প্রাণে ধার্মিক না হলে ধর্মের কাহিনী কেউ শুনে না। লোক দেখানো ‘হালাল-হারাম’ বলে চীৎকার করে ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, দুর্নীতি দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। দুর্নীতির কারণে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর সব কথার শেষ কথা হলো, যার যার বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। কারণ মানুষের বিবেকই হলো সর্বোচ্চ আদালত। ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, কলা খাই না’ বললে কলা খাওয়া বন্ধ হবে না।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।