নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুলাই ২০২৩, ৫:০৪:৩২ অপরাহ্ন
মোঃ আব্দুল ওদুদ
স্বাধীন দেশে নাগরিক তার জীবন যাপনে রাষ্ট্রের কাছে যেসব অধিকার পাওয়ার দাবী রাখে তন্মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা অন্যতম নাগরিক অধিকার। সংবিধান মোতাবেক স্বাধীন রাষ্ট্র এসব অধিকার দিতে বাধ্য। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত সব খাতের দায়িত্ব জনগণের জীবন মানের সুখ ও দুঃখের নজরদারি করা। এসব দেখার জন্য সরকারের বহু ধরনের প্রশাসনিক দফতর রয়েছে। এসব দফতরের পেছনে নাগরিকের কষ্টার্জিত করের অর্থের বিনিময়ে তাদের লালন পালন করা হয়। এক কথায় তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, বাসাবাড়ি ও পেনশন পর্যন্ত দেয়া হয়। লাখ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনগণের করের অর্থে রাষ্ট্রপরিচালিত হয়। আসলে একটা স্বাধীন দেশে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের বিশাল এ
খাত থেকে কী সুবিধা বা কী সেবা পাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব হাট বাজার অনিয়ন্ত্রিত। মফস্বলের বাজার বলেন অথবা শহরের ফুটপাথ থেকে নামী দামি মার্কেটে পণ্য কেনা বেচায় নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা হচ্ছে না। তরিতরকারি চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, মরিচ, শাকসবজি সবকিছু ইচ্ছে মতো চড়া দাম হাঁকিয়ে সাধারণ জনগণের অতিরিক্ত পকেট কাটা হচ্ছে। দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব হাট বাজার অনিয়ন্ত্রিত। ভোক্তা নিজের চাহিদা পূরণ করতে বাজারে অসহায়। পণ্য বাজার যেন সেকেন্ডে সেকেন্ডে লাফিয়ে লাফিয়ে ফেঁপে উঠছে। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে মতো মাছ, গোশত, তরিতরকারির দাম হাঁকিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে দোকান মার্কেটে অন্যান্য ব্যবহার্য্য জিনিসপত্রের দামও প্রতিদিন আকাশ চুম্বী।
এদিকে সরকারি দফতরে কাজ কর্মে নাগরিকের যাওয়া আসা করতেই হয়। সেখানেও কোনোভাবে নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না। টেবিলে টেবিলে পদে পদে হয়রানি ও অবৈধ অর্থ লেনদেন করে জনগণকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করে অফিস কাজ শেষ করতে হয়। গণতান্ত্রিক দেশ, গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি সরকারী প্রশাসন কী দিচ্ছে জনগণকে। রাষ্ট্রের সব খাতে প্রশাসনিক হয়রানি আর বাজারের লাগামহীন অনিয়ন্ত্রিত পণ্য মূল্যে জনগণের নিঃশ্বাস যায় আর আসে। জনগণ কার কাছে গিয়ে এসব ভোগান্তির অভিযোগ দিবে সেটাও ভেবেচিন্তে পাচ্ছে না। জনগণ অর্থ সরকার, সরকার অর্থ জনগণ। জনগণের সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায় পাওয়া না পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের যেসব প্রশাসন ও উপপ্রশাসন রয়েছে তারাই দেখার কথা জনগণের সমস্যাদি। পদে পদে নাগরিকের ভোগান্তি, প্রশাসনিকভাবে নানাবিধ হয়রানির কারণে জনগণ কী পরিমাণ রাষ্ট্রের কাছে আস্থা হারাচ্ছে সেটা চলমান প্রশাসনকে অনুধাবন করা দরকার।
সরকার বাহাদুরের আদেশ নিষেধ বক্তব্য হুকুম ও নির্দেশনা কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আর যখন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক আদেশ-নিষেধ পালন করা হবে না তখন তো রাষ্ট্রের প্রতিনিয়ত শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে। পণ্য বেচাকেনা থেকে প্রশাসনিক সব খাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভোগান্তির শিকার জনগণ।
জনগণের অধিকার দায়িত্ব যাদের কাছে রয়েছে, তারা সঠিক ভূমিকা পালন করছেন না বলা যেতে পারে।
জনগণের কথা হলো- দুর্নীতি আর ভোক্তা হয়রানি সহ অনিয়মের প্রতিকার। প্রতিকারের ক্ষমতা সরকারের। সরকারি দফতর দায়িত্বশীলরা তা বাস্তবায়ন করবে। যদি সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণ করতে ব্যর্থ হয় দেশের নাগরিকরা সু-ফল কোন দিনই পাবেন না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন নাগরিক অন্য একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করতে পারে না। রাষ্ট্র ও সরকারেরও নাগরিকদের মৌলিক অধিকারে হাত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এমনকি নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ কারোরই এখতিয়ার নেই মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করার। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল চেতনা। রাষ্ট্র যদি জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে তাহলে তা রোধ করা অত্যন্ত কঠিন। গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন। কোনটি আগে, কোনটি পরে, নাকি দুটিই একসঙ্গে সমান তালে চলবে, এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন উভয়ের পক্ষেই যথেষ্ট বক্তব্য রয়েছে। তারপরও বলা যায় গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই একটি দেশের সত্যিকারের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। যা বাংলাদেশে সম্ভব হতে চলেছে।
উদার গণতান্ত্রিক আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাথাপিছু আয় এবং জীবন যাত্রার মান দ্বিগুণ হতে ৩০ বছর পর্যন্ত সময় লেগেছে। আর এখন তো করোনাকালের যুগ। তাই দেশে দেশে কোভিডের অন্যতম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে মহামারিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নাগরিক অধিকার সংকোচনের চেষ্টা। প্রায় ১৬ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের ভাটায় টান চলছে, তাই সেই দিক দিয়ে গণতন্ত্রের সংকোচন করোনা ভাইরাসের কারণে নয়। করোনা ভাইরাসের সূচনায় জরুরি অবস্থা পরিস্থিতির সুযোগে আর অনেক দেশ আর বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার পথ ধরে। বাস্তবে সেই আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করছে না। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর নট-ফর-প্রফিট ল (আইসিএনএল) এর হিসাব অনুযায়ী ৯৬টি দেশে কোনো না কোনো ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে বা জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৫০টি দেশে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা মত প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। ১৩০টি দেশে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যেগুলো সমাবেশ করার উপর বাধা নিষেধ আরোপ করেছে এবং ৫৩টি দেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর আঘাত এসেছে। এসব করা হয়েছে হয় নতুন আইন করে নতুবা বিরাজমান আইনের কঠোর প্রয়োগের মধ্য দিয়ে।
কার্নেসি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের হিসাব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০০টি সরকার বিক্ষোভ হয়েছে। ৩০টি ক্ষেত্রে সরকার বা নেতাদের পতন ঘটেছে। দক্ষিণ আমেরিকার ১২টি দেশের মধ্যে ৭টিতেই বিক্ষোভ হয়েছে।
এসব বিক্ষোভের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বুলগেরিয়া ও ভেনেজুয়েলায় আন্দোলন হয়েছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সুদানে, বেলারুশে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনি জালিয়াতির বিরুদ্ধে কিরগিজস্তানে নির্বাচন এবং দুর্নীতির প্রতিবাদে পেরুতে প্রেসিডেন্টকে ইসপিচমেন্টের বিরুদ্ধে। পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে নাইজেরিয়া ও ফ্রান্সেও গণবিক্ষোভ হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারতে একাধিকবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ হয়েছে। ভারতে কৃষকরা আন্দোলন করেছেন। নাগরিকরা অধিকার চান। এ আকাক্সক্ষা সর্বজনীন।
২০১৬ সালে ট্রাম্পের বিজয় এবং উনার আচরণ সারা দুনিয়ায় উগ্র জাতীয়তাবাদী বর্ণবাদীদের উসকে দিয়েছে। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিনি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, নির্বাচনের মাধ্যমে ২০২১ সালে জো বাইডেনকে মার্কিনিরা ক্ষমতায় বসিয়েছে।
দেশে দেশে সকলের ভোটে ক্ষমতার পালা বদলের যে ব্যবস্থা গ্রিক থেকে এসেছে, সেটাই তো গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ, হস্তক্ষেপ মুক্ত, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত না হলে গণতন্ত্র সফল হবে না।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কলামিস্ট