গাছ-গাছালির ঔষধি গুণ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুলাই ২০২৩, ২:১১:৫৯ অপরাহ্ন

রফিকুর রহমান লজু
আমাদের চারপাশে নানা জাতের গাছ-গাছালি আছে। ফুলের গাছ আছে। শাক সবজি আছে। লতা পাতার ছোট ছোট গাছ আছে। আমরা এগুলোকে গাছ বা বৃক্ষ হিসেবে দেখি। এসব গাছ, লতাপাতা, শাক সবজি যে খুব উপকারী এবং বিভিন্ন ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে, তা আমরা খেয়াল করি না। গাছের পাতা, ফুল, কান্ড বা গুঁড়িও বিভিন্ন রোগে ঔষধের কাজ করে। এগুলো থেকেই আয়ুর্বেদ বা কবিরাজি ঔষধ তৈরি হয়। এগুলো পরিশ্রাবণ করেই কঠিন কঠিন রোগের চিকিৎসা করা হয়।
দূর অতীতে গ্রামাঞ্চলে ডাক্তার পাওয়া দুষ্কর ছিল। ডাক্তার দেখাবার জন্য শহরে যেতে হতো। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় শহরে যাওয়াও কষ্টকর ছিলো। তাই গাছ-গাছালি, গাছের পাতা, গাছের গুঁড়ি বা জড়ই ছিল ভরসা। এতে মানুষের পূর্ণ আস্থা ছিল। গভীর আস্থা নিয়ে মানুষ এসব সেবন করতো। ফলও পেতো। এই সকল গাছ-গাছালি, লতাপাতা, শাক-সবজি মহান আল্লাহর অমূল্য দান ও নিয়ামত। এরকম কিছু গাছ-গাছালি, লতাপাতার পরিচিতি ও উপশম গুণ সংগ্রহ করে পাঠকদের উপহার দিলাম।
ঠুনিমানকুনি
ঠুনিমানকুনি শাক জাতীয় একটি উদ্ভিদ। ইহার চাষ করতে হয় না। বাসা-বাড়ির আঙিনায় পুকুর ঘাটের পাথরের ছিদ্রে ছিদ্রে জন্মায়। পেট ফাঁপা, পেট ফোলা, পেটের ব্যথায় একটি ঔষধ। ঠুনিমানকুনি পিষে রস খেতে হয়, মধু মিশিয়েও খাওয়া যায়।
পুদিনা
পুদিনা লতিকা চাষ করতে হয় না। ইহা অমনি অমনি জন্মে। বাসা বাড়িতে একটু উচু জায়গায় পুদিনা ভালো জন্মে। পুদিনার পাতায় একটা সুগন্ধী আছে। টমেটোর সালাদে, কাঁচা আমের ভর্তা বা চাটনিতে পুদিনা পাতা মিশালে খাদ্যের স্বাদ বেড়ে যায়। সবজির সঙ্গে মাছের ঝুলে মেশালে খাদ্যের স্বাদ বেড়ে যায়, পেট ঠান্ডা রাখে।
পিসাস
এক ধরনের চিকন গাছ, খুব লম্বা হয় কিন্তু গায়ে মোটা হয় না। হাতের বা পায়ের আঙ্গুল কেটে গেলে পিসাসের (পিচাচ) পাতা কচলিয়ে ক্ষতস্থানে লাগালে বিষ বেদনার উপশম হয়। বেশি রক্ত বের হলে পিসাসে পাতা কচলিয়ে ক্ষতস্থানে রেখে কাপড় দিয়ে বেধে রাখলে রক্তপড়া বন্ধ হয় এবং দ্রুত ক্ষতস্থান শুকায়।
করলা
করলা সবজি জাতীয় একটি খাদ্য। ইহা পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে তেলে ভেজে ভাতের সঙ্গে খাওয়ার একটি সবজি বিশেষ। ভর্তা করে কাঁচাও খাওয়া যায়। করলা অত্যন্ত উপকারী ও অতি পরিচিত একটি সবজি।
করলা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হজম শক্তি বৃদ্ধি ও চর্মরোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। ইহার স্বাদ তিক্ত, তা সত্ত্বেও খেতে ভিন্ন রকম স্বাদ পাওয়া যায়।
করলা কিডনিতে পাথর জমতে দেয় না, মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখে। হাঁপানী বা এজমা রোগে করলা উপকারী। করলা কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর করে।
কচুশাক
আমাদের দেশে কচুশাক একটি অতিপরিচিত শাক। কচুশাকের কিছুই বাদ যায় না, কচুর সব অংশই আমরা খাই। মানবদেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণে কচু শাখের ভূমিকা সীমাহীন। এ শাক সহজেই পাওয়া যায়। গ্রাম বাংলার প্রতিটি বাড়ির আশেপাশে পতিত জমিতে, ডোবাতে এবং পুকুর পাড়ে, রাস্তার পাশে প্রচুর কচু শাক জন্মে। কচুর গুড়ি থেকে লম্বা লতিকা বের হয়, ইহা খেতে খুব মজাদার ও স্বাদযুক্ত হয়। সিদল শুটকি দিয়ে নাগা মরিচ মিশিয়ে ইহা রান্না করা হয়।
কচু গাছের লম্বা ডগা, পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। আবার কচুর মূল মুকিও একটা সবজি। মুকি থেকে একরকম লতা বের হয়। এই লতা বেশ লম্বা হয়, আধা হাত থেকে দেড় হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। মুকি, লতা দুটোই খেতে খুব মজা লাগে। মুকি তরকারি হিসেবে মাছ দিয়ে, শুটকি দিয়ে খাওয়া যায়। লতার সঙ্গে সিদল সুটকি ও নাগা মরিচ দিয়ে ভাত খেতে খুব উপাদেয় লাগে।
আমড়া
আমড়া একটা দেশীয় ফল। ইহার স্বাদ খুব টেংগা। টেংগা হলেও কাঁচা খেতে মজা লাগে। মাছ দিয়ে রান্না করে খাওয়া যায়। এতে ভিটামিন সি, ক্যারোটিন ও শর্করা রয়েছে। আমরা পিত্তবমনে, অম্লমন্দায়, শরীর জ্বালাপোড়ায়, অজীর্ণ রোগে, অরুচিতে, শুক্র তারল্যে ভালো ফল দেয়।
আমড়া দিয়ে সুস্বাদু আচার চাটনি তৈরি করা যায়। আমড়ার শাস বের করে বেটে রস খেলে শুক্র গাঢ় হয়।
সজনা
খুব উপকারী একটা গাছ সজনা। সজনা গাছ খুব নরম থাকে। একটুকরো সজনা ভিজিয়ে রেখে অথবা কুচি কুচি করে কেটে বেটে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ভর্তা করে ভাতের সঙ্গে খেতে হয়। খেতে একটু ঝেং ঝেং লাগে। তবুও এই ঝেংওয়ালা ভর্তা খুব সুস্বাদু হয়। সর্দি-কাশিতে সজনার রস মধু দিয়ে খেলে উপসম পাওয়া যায়।
ধুতরা
ধুতরা এক রকম কাঁটাযুক্ত গাছ। গাছ এবং ডালপালা খুব নরম। ইহা জংলি গাছ হলেও লোকালয়েও দেখা যায়। ধুতরা গাছে একরকম গোল গোটা ধরে। গোটার বিচি খেলে চুলকানি বা খাজলি সেরে যায়। ২/৩ টার বেশি বিচি খেতে নেই। বেশি খেলে যে খাবে কিছু সময় অনবরত আবুল তাবুল কথা বলবে বা মাতলামি করবে।
পাথর কুরসি
পাথর কুরসি বিচিত্র ধরনের গাছ। লোকালয়ে প্রকাশ্যস্থানে পাথর কুরসির গাছ দেখা যায় না। সাধারণত পুকুর ঘাটের পাথরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাথর কুরসি জন্মে। গাছ বাড়ে না, মাটির সঙ্গে কথা কয়। এই গাছ আলো বাতাস সহ্য করতে পারে না।
পাথর কুরসি একটা মহৌষধি, হাত পায়ের হাড়ের কোথাও কেটে গেলে পাথর কুরসি বেটে আক্রান্ত স্থানে লেফ দিলে হাড়ফাটা জোড়া লেগে যায়। এ জন্যে পাথর কুরসির আরেক নাম হলো হাড়জোড়া।
জাম্বুরা
জাম্বুরা লেবু জাতীয় এক প্রকার সুস্বাদু ফল। ইহার আকৃতি গোল এবং ফুটবলের মতো আকার হয়। জাম্বুরার আরেক নাম বাতাবিলেবু। সিলেট অঞ্চলে জাম্বুরাকে মাতুয়া বলে। লেবু যত প্রকারের আছে তন্মধ্যে জাম্বুরা সর্বাপেক্ষা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এতে বেশি পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ আছে। সাইট্রাস গোত্রের এই ফলটি যেমন পুষ্টিকর তেমনি জাম্বুরার মধ্যে রয়েছে ঔষধিগুণও।
জাম্বুরা পেপটিক রক্তের কলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। ইহা ল্যাক্সেটিভ হিসেবে ভালো কাজ করে এবং শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে। দেহের ওজন কমাতে সাহায্য করে। যারা বেশি মোটা এবং মেদবহুল দেহ তারা খাবার গ্রহণের আধঘন্টা আগে এক গ্লাস জাম্বুরার রস খেলে ১২ সপ্তাহে দুই থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত ওজন কমাতে সমর্থ হয়। জাম্বুরা আর্থাইসিস ও প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। সর্দি-কাশিতে জাম্বুরা সহায়ক শক্তি। লেবুর মতো চিপে ভাতের সঙ্গে খেলেও উপকার পাওয়া যায়।
সজনে পাতা
সজনে পাতায় প্রচুর প্রোটিন, আয়রণ, ক্যালসিয়াম রয়েছে। ভিটামিন এ-ও প্রচুর আছে। সজনে পাতায় স্মরণশক্তি বাড়ে। সজনে পাতা খেলে হার্ট, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের উপশমে সাহায্য হয়। সজনে পাতা নিয়মিত খেলে অ্যানিমিয়া রোগ সেরে ওঠে। ইহা সুগারের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখে। সজনে পাতা খেলে ব্লাডপ্রেসার কমে, মুখের ঘা ও দুর্গন্ধ দূর করে। দৃষ্টিহীনতা প্রতিরোধ করে। ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, কোলাইটিস এবং জন্ডিসে সজনে পাতার ঝোল খুবই উপকারী।
যোজটের পাতা
মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়াতে এবং আমাশয়ে যোজটের পাতা খুবই উপকারী। গাছ লম্বা হয়, ঝাপড়া হয় এবং প্রচুর পাতা গজায়। ইহা শাকের মতো রান্না করে খেতে হয়। ছোট মাছ বা চর্বিওয়ালা মাছ দিয়ে খেতে আলাদা ধরনের স্বাদ পাওয়া যায়। কাঁচা মরিচ বা নাগা মরিচ এবং সিদল শুটকি মিশালে সিদল ও নাগামরিচের গন্ধে আলাদা ধরনের স্বাদের সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষুধা-মন্দা দূর হয় এবং খাওয়ার রুচি বাড়ায়। পেট পরিষ্কার রাখে। প্রসূতি মহিলারা এই খাবার খুব পছন্দ করেন।
তেতুল
তেতুল একরকম ফল বিশেষ। ইহা খুবই টক। তেতুলের গাছ খুব বড় হয়। ইহার ভিতরে বড় বিচি থাকে। সার অংশ বিচিকে ধরে রাখে। বিচি ফেলে দিলে যেটুকু থাকে তাই তেতুল। ইহা রোদে শুকিয়ে সরিষার তেল মেখে ডলা করে বোয়ামে রাখা হয়। প্রচন্ড গরমে শরবত বানিয়ে খেতে খুব স্বাদ লাগে। ইহা পেট ঠান্ডা রাখে। গরমের মধ্যে খেলে গরমের কিছুটা উপশম হয়। মহিলারা চাটনি করে খেতে খুব মজা পান।
কালজাম
কালজাম একটি ফল। ইহা বেশি বড় হয় না। বর্ষা মৌসুমে ইহা পাওয়া যায়। কালজাম বৃক্ষ খুব বড় হয়, দীর্ঘ হয়। ইহা খেতে একটু টক লাগে। কালজামে প্রচুর ভিটামিন সি আছে। ইহা খেলে পেট ঠান্ডা রাখে। চাটনি করে খেতে মজা লাগে। টয়লেট খোলাসা হয়।
শালগম
শালগম পুষ্টিকর একটি খাবার। পুষ্টিগুণে ভরপুর শালগম। সবজি হিসেবে তরকারি বা আনাজ হিসেবে মাছ বা মাংস দিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়।
পুষ্টিগুণঃ প্রতি ১০০ গ্রাম শালগমে আছে ২৮ মিঃ গ্রাম ক্যালরি, প্রোটিন ০.৯০ মি. গ্রাম, ক্যালশিয়াম ৩০ মি. গ্রাম, ভিটামিন সি ৪৩ মি. গ্রাম। শালগম খারাপ কোলেস্টরল কমায়, হজম শক্তি বাড়ায়, হাড় ও দাঁত সুস্থ রাখে, মূত্রথলির রোগ ও টিউমার প্রতিরোধে সাহায্য করে। ইহা ক্যানসার কোষ বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। শালগম অ্যাজমা রোগ সারাতে ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
নিম গাছ
নিমগাছ খুবই উপকারী একটি গাছ। যে কোনো ঔষধের গুণ রয়েছে নিমের মধ্যে। ত্বকের যতœ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য রক্ষায় নিমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিমের মধ্যে আছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস জনিত নানা রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা।
নিমের ডাল দাঁতন বা মিসওয়াক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইহা টুথব্রাসের কাজ করে। নিম পাতার প্রলেপ লবণসহ গরম করে ব্যবহার করলে ফোলা, ব্যথা দূর করে। ইহা ফোঁড়া বা বরণ পাকাতে সাহায্য করে। বিষফোঁড়া কখনও সুঁই বা এরকম কিছু দিয়ে খোঁচাখুঁচি করা যাবে না বা বলপ্রয়োগ করে ফাঁটানো যাবে না। এতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। পেকে গেলে আপনা আপনি ফেঁটে গেলে আলতো করে চাপ দিলে পুঁজ বা নষ্ট পচা রক্ত বের হয়ে যাবে। অন্যথায় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
লেখক : সিনিয়র কলামিস্ট।