গোধূলি বেলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুলাই ২০২৩, ১২:১১:২৮ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
জীবন সায়াহ্নে এসে নাটকের চেয়ে নাটকীয় জীবন কাহিনী লিখতে হবে কখনো ভাবেননি আলিফ উদ্দিন। আমরা এলাম, কাঁদলাম- এই তো জীবন। আমরা কাঁদলাম চলে গেলাম এই তো মৃত্যু। আলিফ উদ্দিন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রয়াত আব্দুল হামিদের অন্তিম যাত্রা জানাজার নামাজে শরীক হয়েছিলেন। জানাজার নামাজ শেষে ফেরার পথে দীর্ঘদিনের সাথি বশির উদ্দিন মাস্টার এবং ডাক সাইটে কাগুজে বাঘ সাংবাদিক শফিক উদ্দিনের সাথে সুখ-দুঃখের কথা বলে ফিরছিলেন। শহরের আলোকজ্জ্বল সন্ধ্যায় হঠাৎ পূবাল হাওয়ার সাথে বিনা নোটিশে ভাদ্র মাসের বৃষ্টির সাথে ঝড়ো হাওয়ায় তিনজনকে ঠেলে নিয়ে গেল এক রেস্টুরেন্টে। সেখানে বসে চায়ের সাথে গরম পরোটা খুব স্বাদ করে গলধঃকরণ করছিলেন। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সদ্যপ্রয়াত আঃ হামিদ ব্যক্তি ও তাঁর কর্মজীবন আলাপচারিতায় চলে আসে।
প্রয়াত আঃ হামিদের অন্যান্য গুণের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমিক। প্রতিটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর সরব উপস্থিতি সকলের কাছে উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। আঃ হামিদ ব্যক্তি জীবনে হাসি-খুশিমাখা সাদা মনের মানুষ আর জম্পেস গল্পবাজ ছিলেন। তিনি সাহিত্য আসরে এলে উপস্থিত সকলকে হর্ষোৎফুল্ল করে রাখতেন। তাঁর অন্তিম যাত্রায় আত্মীয় শুভানুধ্যায়ী ও সাহিত্য অঙ্গনের নবীন-প্রবীণ সকলের উপস্থিতি ছিল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আঃ হামিদ জীবদ্দশায় তাঁর রচিত বই প্রকাশের অপারগতার কথা প্রায়ই আফসোস করতেন। তাঁর অনেক বইয়ের পান্ডুলিপি স্বনামধন্য লেখকরা পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং যথাশিঘ্র বইয়ের মোড়কে প্রকাশ করার জন্য তাগিদও দিয়েছেন। আঃ হামিদ চাকুরী থেকে অবসর জীবনে এসে এককালীন পেনশনের প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। মনে করেছিলেন ছেলে বিদেশে এস্টাবলিস্ট হলে পরিবারের টানাপোড়ান যাবে এবং এক সময় দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পান্ডুলিপিগুলো ছাপিয়ে পাঠক মহলে তাক লাগিয়ে দিবেন। কিন্তু বিধিবাম পারিবারিক স্বচ্ছলতা ফিরে এলেও পরিবারের পোষ্যগণ কেউই অলাভজনক খাত বই প্রকাশে বিনিয়োগ করতে চায় না। আঃ হামিদ প্রায়শ: আফসোস করতেন তাঁর শ্রমলব্ধ পান্ডুলিপি আতুরঘরে আটকে থাকবে। আঃ হামিদ আজ জীবন থেকে ফোরসিবলি রিটায়ারমেন্টে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁর শখের পান্ডুলিপি আর কখনো অন্তর্লোক থেকে বহিঃলোকে প্রকাশ পাবে না।
মনের ব্যথা জমিয়ে রাখা যায় না। আঃ হামিদের জীবননাট্যের কথা শেষ হতে না হতেই বশির উদ্দিন মাস্টার মুখ ফ্যাকাশে করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক না দিয়েই বললেন, আমি শিক্ষক মানুষ দু’টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল গেল বছর বাংলা একাডেমি বইমেলায়। ছেলেরা শুনে তো তাদের চোখ চড়কগাছ। আব্বা এত টাকা পেলেন কোথায়? একে একে তারা তাদের আম্মাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করছে। সন্তানদের এই উদগীরণের কারণ হলো বইনামক অলাভজনক খাতে আব্বা কেন এত টাকা ব্যয় করলেন। কিন্তু ওদের মা আমেনা বেগম ঠিকই জানতেন আমার বই দু’টি পুনরুজ্জীবন লাভ করেছিল আমার এক প্রাক্তন ছাত্র আরিফের বদান্যতায়। যে কিনা ক্লাসের শেষ বেঞ্চটাতেই বসে থাকত।
বশির উদ্দিন মাস্টারের কথা শেষ না হতেই ডাকসাইটে কাগুজে বাঘ সাংবাদিক, লেখক শফিক উদ্দিন তাঁর জীবন নাট্যের কথা বললেন যা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তার একাকী জীবনের অনুরণন তুলছে। তাই তো লীলাছলে বলা যায়, ‘বাহিরে যার হাসির ছটা ভিতরে তার চোখের জল’, সৌরভ আত্মহত্যা করে, ফল নিজকে গুটিয়ে নেয় বৃত্ত থেকে, মুক্তির স্বাদ আমার জীবনে বাঁধা হয়ে পড়েছে। শফিক ভাইয়ের রহস্যে ঘেরা কথায় পারিবারিক জীবন দ্বন্দ্বময় সম্পর্ক বিচিত্র হয়েছে। শফিক ভাই চরম ক্লান্ত ও মূল্যহীনতায় আক্রান্ত। তিনি দীর্ঘদিনের সাজানো বাগানে মালি হয়ে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন। এটি নির্দয় সত্য যে, বৃদ্ধকাল মানুষের নৈরাশ্যজনক সীমাবদ্ধতা। উপেক্ষার আঘাত সবচেয়ে বড় আঘাত। এই গল্পে প্রয়াত আঃ হামিদ, বশির উদ্দিন মাস্টার এবং সাংবাদিক শফিক উদ্দিনের পারিবারিক দ্বন্দ্বময় জীবনের নিরাভরণ রূপই ফুটে উঠে যাপিত জীবনের নির্দয় কাহিনী। আমাদের সমাজে পুরাতন আসবাবপত্রের দাম বাড়ে কিন্তু পরিবারের বৃদ্ধ মানুষের দাম কমে। টিনের চালায় বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ থেমে গেছে। আমরা নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে পড়লাম।