জৈন্তাপুর বাউরবাগ গ্রামে বাদুড়ের বিচিত্র ভুবন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুলাই ২০২৩, ৮:১৬:৫৫ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম
সাদা বক, পানকৌড়ি কিংবা অতিথি পাখি নয়, অন্তত দুই শতাধিক গাছে ঝুলে আছে কয়েক হাজার বাদুড়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেই বাদুড়গুলোর কিচির মিচির শব্দ অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে চারপাশে। সেই দৃশ্য দেখতে হলে যেতে হবে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার বাউরবাগ গ্রামে।
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে জৈন্তিয়া উপজেলার ফেরিঘাট বাজার। বাজার ঘেঁষে বাঁ-দিকের সড়ক দিয়ে প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলেই বাউরবাগ গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সারি নদীর শাখা সবড়ি নদী। পাকা ব্রিজ থেকে নেমে মাটির সড়ক ধরে পায়ে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়বে বাঁশঝাড়ের সারি। যতদূর চোখ যায়, নির্জন বাঁশঝাড়গুলো পরম মমতায় ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে সরু পথটিকে। এই গ্রামের নুরুর রহমানের বাড়ির সীমানায় পা রাখতেই কানে ভেসে আসলো বাদুড়ের কিচির মিচির ধ্বনি। অবাক চোখে বিস্ময়কর সেই দৃশ্যে থমকে যাবে যে কারো দৃষ্টি।
চল্লিশোর্ধ্ব নুরুর রহমানের সাথে হেঁটে হেঁটে কথা বলছি আর গাছ থেকে গাছে বাদুড়ের ছুটাছুটি দেখছি। এক একটি গাছে যতগুলো না সবুজপাতা, তার চেয়ে বেশি ঝুলে আছে কালোবাদুড়। কেউ হয়তো বাদুড়বৃক্ষ বললেও ভুল হবে না। যদিও গ্রামের মানুষের কাছে এই দৃশ্য নতুন নয়। তারা বছরের পর বছর ধরেই বাদুড়ের এই অবস্থান দেখে আসছেন। স্থানীয়রা অবাক না হলেও ঘুরতে বা বেড়াতে আসা মানুষদের কাছে বাদুড়ের এই আবাস বিস্ময়কর এবং রোমাঞ্চকর।
যেখান থেকে নুরুর রহমানের বাড়ির সীমানা শুরু সেই পথের দূরত্ব ২১৮ ফুট। দীর্ঘ এই সীমানাজুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। শিরিস, কৃষ্ণচূড়া, মেহগনিসহ নানা জাতের উঁচু উঁচু অন্তত দুই শতাধিত বৃক্ষের বসতি এই সীমানাজুড়ে। এমন কোনো গাছ পাওয়া যাবে না, যেখানে বাদুড় নেই। দিনেরবেলাতেও তারা ইচ্ছেডানায় উড়ছে। বাদুড়ের সেই ডানামেলা শেষবিকেলে নদীতীরবর্তী গ্রামকে আরো মায়াময় করে তোলে।
বাদুড়ের ভিড়ে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে মগডালে আছে অনেকগুলো পাখির নীড়। তবে সেগুলো বাদুড়ের নয়, পানকৌড়ি পাখির। সকালে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেও সন্ধ্যার আগে নীড়ে ঠিকই ফিরে আসে সেই পানকৌড়িগুলো। বাদুড় এবং পানকৌড়ি-দুই প্রজাতির প্রাণী হলেও একসাথে, একইবৃক্ষে তাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের চিত্র পর্যটকদের কাছেও বিস্ময়। তবে শীতকালে পানকৌড়িসহ আরো কিছু অতিথি পাখি ভিড় করে এই গাছগুলোতে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, নুরুর রহমানের বাড়ির সীমানা ঘেঁষে অন্যবাড়ির সীমানাতেও রয়েছে এরকম বহুজাতীয় বৃক্ষের সমাহার। কিন্তু সেই বৃক্ষগুলোতে একটিও বাদুড় বসেনা, সীমানাও অতিক্রম করে না।
নুরুর রহমান জানান, অন্তত বিশ বছর ধরে তার গাছগুলোতে বাদুড় বসবাস করছে। কিন্তু তারা মানুষের কোনো ক্ষতি করেনি বিশ বছরের মধ্যে। এমনকি বাড়ির ভেতরে থাকা ফলগুলোরও কোনো ক্ষতি করে না বাদুড়। তিনি বলেন, শীতের সময় বাদুড় ছাড়া আরো বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসে। সেই পাখি দেখতে পর্যটকরা আসেন গ্রামে।
বাদুড় কোন পাখি নয়। বাদুড় হলো একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা আকাশে উড়তে সক্ষম। পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে যা পৃথিবীতে অবস্থানরত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ২০ ভাগ। বাদুড়ের মুখ দেখতে অনেকটা শিয়ালের মুখের মতো, খরগোশের মতো বড় বড় দুটো কান, ছাতার মতো অদ্ভুত দুটি ডানা। বাদুড়ের ঘ্রাণশক্তি ও শব্দবোধ অত্যন্ত তীব্র। এরা খাদ্য ও বাসস্থানের খুঁজে ঘ্রাণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করে।
গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম, হাফিজ, রুবেল আহমদসহ আরো কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, বাদুড়গুলোর অবাধ বিচরণ দেখে মনে হয় তারাও ভালোবাসা বুঝে। তা না হলে একসাথে, একইস্থানে বিশ বছর কাটিয়ে দেয়া সম্ভব হতো না। গ্রামের মানুষও তাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করছেন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।