অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নিরাপত্তাহীন মানবসভ্যতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুলাই ২০২৩, ১০:৩৪:১৫ অপরাহ্ন
অ্যাডভোকেট আনসার খান
বিশ্বজুড়ে সামরিক ব্যয় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০২২ সালে বিশ্বের সামরিক ব্যয় রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এই সময়ে সামরিক ব্যয় সর্বকালের সর্বোচ্চ ২.২৪ ট্রিলিয়ন (বাংলাদেশী টাকার হিসেবে প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা) ডলারে পৌঁছেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এটি সামরিক খাতে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যয়। এই বৃদ্ধি গতবছরের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি এবং বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ২.৫ শতাংশ। ইকোনমিস্ট ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় বার্ষিক প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে।
এসআইপিআরআই বলেছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের কারণেই বিশ্বের দেশগুলো সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করছে নিজেদের দেশগুলোর প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। এই সংস্থার সামরিক ব্যয় ও অস্ত্র উৎপাদন কর্মসূচির গবেষক লরেঞ্জু স্কারাজ্জাতো জানিয়েছেন, -অনেক প্রাক্তণ পূর্ব ব্লকভূক্ত রাষ্ট্র ২০১৪ সাল থেকে তাদের সামরিক ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি করেছে, যে বছর রাশিয়া সামরিক শক্তি দিয়ে অবৈধভাবে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছিলো। যেমন ২০২২ সালেই কেবল ইউক্রেনই তার সামরিক ব্যয় ছয়গুণের বেশি বাড়িয়েছে, যার পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলার এবং এটি এক বছরে দেশটির সর্বোচ্চ সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি। একইভবে ফিনল্যান্ড তার সামরিক ব্যয় ৩৬ শতাংশ এবং লিথুয়ানিয়া ২৭ শতাংশ, সুইডেন ১২ শতাংশ, পোল্যান্ড ১১ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। যুক্তরাজ্য ও মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সামরিক ব্যয় রেকর্ড করেছে, যার মূল্য ৬৮.৫ বিলিয়ন ডলার।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে বিশ্বের সর্বাধিক ব্যয়কারী দেশগুলো হলো, যুক্তরাষ্ট্র, যার ব্যয়ের পরিমাণ ৮৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গেল বছরের তুলনায় দেশটির ব্যয় বেড়েছে ০.৭ শতাংশ। দেশটির মোট সামরিক একক ব্যয় বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের ৩৯ শতাংশ। ২০২১-২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেটের পরিমাণ ৬ ট্রিলিয়ন ডলার।
বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন। দেশটির মোট সামরিক ব্যয় ২৯২ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের ১৩- শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২সালে চীনের ব্যয় বেড়েছে ৪.২ শতাংশ। তবে গত চব্বিশ বছর ধরেই চীন তার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করে চলেছে। যদিও এখনো অবধি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে চীন। ২০২১-২২ সালে চীনের সামরিক বাজেটের পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তিনগুণ কম। তৃতীয় স্থানে থাকা রাশিয়া সামরিক খাতে ৮৬.৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছে। চতুর্থ স্হানে থাকা ভারতের সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ ৮১.৪ বিলিয়ন এবং ৫ম স্হানে রয়েছে সৌদি আরব, যার সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এসআইপিআরআই এর তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া যৌথভাবে বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের ৫৬ শতাংশ ব্যয় করছে। এসআইপিআরআই-এর সামরিক ব্যয় এবং অস্ত্র উৎপাদন কর্মসূচির সিনিয়র গবেষক ন্যান তিয়ান এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয়ের ক্রমাগত বৃদ্ধি একটি উদাহরণ যে আমরা একটি ক্রমপ্রসারমান অনিরাপদ বিশ্বে বাস করছি।’
২০২৩ সালের গোড়ায় প্রকাশিত ২০২২ সালে বিশ্বের দেশগুলোর সামরিক ব্যয় সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে এসআইপিআরআই বলেছে আগের বছরগুলোর তুলনায় ২০২২ সালে সামরিক ব্যয় অনেক বেশি বেড়ে গেছে এবং এর বেশিরভাগই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেই হয়েছে। মূলত রাশিয়ান হুমকিসহ একটি অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিবেেেশর বিষয়টির প্রেক্ষাপটেই দেশগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার জন্য সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করেছে, যা অদুর ভবিষ্যতে উন্নতির প্রত্যাশা করা যায় না।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এর বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা অস্টম বছরে বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় বেড়েছে। ইউরোপে সামরিক ব্যয় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিগত ত্রিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বব্যাপী সামরিক সংঘাত, অস্ত্র উৎপাদন ও মজুতকরণ প্রতিযোগিতার কারণে আগামী বছরগুলোতে সামরিক ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী থাকবে, যা বিশ্বব্যাপী শান্তি, নিরাপত্তা ও নিরস্ত্রীকরণকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলস্বরূপ বিশ্বসভ্যতা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় পতিত হতে চলেছে। উপরন্তু, সাইবার আক্রমণ থেকে সন্ত্রাস পর্যন্ত উদীয়মান হুমকির সাথে, রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও নিশ্চিত করার জন্য সামরিক ব্যয়ের উপর বেশি জোর দিচ্ছে। ফলে অস্ত্র প্রতিযোগিতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এবং একইসাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উত্তেজনা। অথচ সকলপ্রকার আগ্নেয়াস্ত্রমুক্ত নিরাপদ বিশ্বব্যবস্থা মানব সভ্যতার প্রত্যাশা। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, হবে এমনটিও বলা যাচ্ছে না, কেননা অস্ত্র উৎপাদন ও মজুতকরণ ফি বছর বেড়েই চলেছে।
অস্ত্র উৎপাদন ও বিপণনের সাথে রয়েছে আর্থিক সঙ্গতির সম্পর্ক। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী নয়, মুষ্টিমেয় কিছু রাষ্ট্র সম্পদশালী এবং ওই রাষ্ট্রগুলোই অস্ত্র উৎপাদন করতে সক্ষম এবং উৎপাদিত এইসব অধিকাংশ অস্ত্রের ক্রেতা হচ্ছে ক্ষুদ্র ও দরিদ্র ও দূর্বল রাষ্ট্রগুলো। তবে অনেক ধনাঢ্য রাষ্ট্রও অস্ত্র আমদানি ও রফতানির সাথে সম্পর্কিত আছে। যেমন, বিশ্বের বৃহত্তর পাঁচ অস্ত্র রফতানিকারক দেশ হলো, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানি, যেগুলো বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানির ৭৬ শতাংশ, অর্থাৎ সর্বমোট ৮৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করেছে বিগত ২০১৮-২২ সময়কালে। আবার একই সময়কালে চীন, ভারত, সৌদি আরব,তুরস্ক সহ বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো ১১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে অস্ত্র আমদানী করে।
ওইসব রাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রি করে আরও সম্পদশালী হয়ে উঠছে ধনী রাষ্ট্রসমূহ। সচেতন মানুষেরা তাই মনে করেন অস্ত্র বিক্রির জন্যই বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো সামরিক উত্তেজনা জিইয়ে রেখে মুনাফা লুটে নিচ্ছে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো থেকে।
স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া হয় যে অস্ত্র উৎপাদনে অক্ষম উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র ক্রয় করে নিজেদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো হতদরিদ্র মানুষের রক্তঘামে অর্জিত অর্থের বিনিময়ে ক্রয়কৃত এইসব অস্ত্র বহিঃশক্তির পরিবর্তে নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয় শাসকদের শাসন কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
অস্ত্র উৎপাদন ও বিপণন মানব সভ্যতার কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই ডেকে আনছে, এটি অনস্বীকার্য। অস্ত্রের উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় ও দেশ-দেশান্তরে স্থানান্তরের কারণে গোটা বিশ্বকে সবসময় নিরাপত্তাহীন ও যুদ্ধ ঝুঁকিতে ফেলে দিয়ে থাকে। অন্যদিকে এইসব অস্ত্র বিশ্বের কোনো না কোনো অংশের নিরীহ মানুষদের ওপর নিষ্ঠুরতা ও দমন-পীড়নে বা একরাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্র দখলের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উদাহরণ টানা যেতে পারে।ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের নিরীহ সাধারণ জনগণকে হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। সিরিয়া, ইরানের মতো দেশগুলোতেও নিরীহ সাধারণ জনগণের উপর অস্ত্রের অপব্যবহার অব্যাহত রয়েছে।
দক্ষিণ সুদানের মতো সংঘাতে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে ২০২২ সালে সামরিক ব্যয় ৫০ শতাংশেরও বেশি হয়েছে এবং এর ফলে ৭.৭ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ৬৩ শতাংশ চরম ক্ষুধার মুখোমুখি হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাতে শুধুমাত্র ২০২২ সালে ১৯ দেশের ১১৭ মিলিয়ন মানুষকে চরম ক্ষুধার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অক্সফামের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৯০০০ হাজার মানুষ সংঘাত চালিত ক্ষুধায় মারা যায়।
শান্তিপ্রিয় মানুষেরা আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, অস্ত্রেরঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ পৃথিবীতে বসবাস করতে চায় বলেই অস্ত্র প্রতিযোগিতামুক্ত বিশ্বব্যবস্থা প্রত্যাশা করে। তাই সকল ধরণের অস্ত্র উৎপাদন, বিপণন ও ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে বিশ্ববাসী। বিশ্বনেতারা সেটি কানে তোলবেন কী?
সূত্র : এসআইপিআরআই, অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনাল, ফেয়ার ম্যাগাজিন, ইকোনমিস্ট।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।