মনুষ্যত্বের অবজ্ঞা কাম্য নয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুলাই ২০২৩, ১:৩৯:৫৬ অপরাহ্ন

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কবে বলেছেন- ‘এক সময় যে মানুষ মনুষ্যত্বের খাতিরে টাকাকে অবজ্ঞা করতে জানত এখন সে টাকার খাতিরে মনুষ্যত্বকে অবজ্ঞা করছে’। কবিগুরুর জামানায় তাঁর উক্তিটি প্রাসঙ্গিক ছিলো বলেই তিনি তা বলেছেন। আজ শুধু কবিগুরুর বঙ্গদেশেই নয়, সারা বিশ্বজুড়েই তাঁর এ বক্তব্যটি সমভাবে প্রযোজ্য বলেই তো প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বলি, অস্ত্রের কারবার বলি, আধুনিক সমরাস্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধ যুদ্ধ মরণখেলার কথাই বলি সবই হচ্ছে টাকার খাতিরে। সেটা প্রত্যক্ষই হোক বা পরোক্ষই হোক, মূল কিন্তু টাকা টাকা এবং টাকা। সবকিছুই হচ্ছে মনুষ্যত্বকে অবজ্ঞা করে, অপমান করে। কখনো কখনো ভূলুন্ঠিত করে।
আমাদের মতো অতিসাধারণ মানুষের পক্ষে বিশ্বের খবরাখবর জানা কতটুকুই বা সম্ভব। পত্র পত্রিকার মাধ্যমে অনেক মানুষ, মানুষের মনুষ্যত্বের হালচাল, টাকা, টাকার কারণে নিজের মনুষ্যত্বে কিভাবে অবজ্ঞা নিজেরাই করে তার খবর জানলে কখনো কখনো অবাক হতেই হয়। যেমন ধরা যাক আমাদের দেশের চাকরীজীবীদের কথাই। চাকরী ক্ষেত্রে অনেক পদ পদবীর কথা আমরা জানি। সরকারি চাকরীর ক্ষেত্রে তো সচিব পদবীটি সর্বশেষ স্তর। এর পরই তো মন্ত্রী মহোদয়গণ। চাকরী জীবনে সচিব হওয়ার ভাগ্য ক’জনারই হয়। সে তো সৌভাগ্যের ব্যাপার।
তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় একজন সচিব অবশ্য একজন বড় মাপের মানুষ। তাঁর মনুষ্যত্বও অনুকরণীয় হওয়া উচিত। তাঁর মনুষ্যত্ব প্রশংসার দাবী রাখবে। এটাই মানুষের কাম্য। এমনি এক সাবেক সচিবকে নিয়ে ৬ জুন ২০২৩ তারিখের দৈনিক ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় একটি শিরোনাম হলো- ১২ ব্যাংক হিসাবে ১৩ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন। ১০ বছর অনুসন্ধানের পর সাবেক সচিব প্রশান্তের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা।’ দুদকের এ মামলার রায় কি হবে এখনই হয়তো জানা যাবে না। তবে প্রশান্তের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগ যদি মিথ্যা হয়ে থাকে তাহলে প্রশান্ত বাবুতো দুদকের বিরুদ্ধেও পাল্টা মামলা করতে পারতেন কিন্তু তিনি কি তা করেছেন বা এমনি করার সৎ সাহস কি তার আছে?
এবার নজর দেয়া যাক ব্যাংকিং জগতের দিকে। ১৩ জুন ২০২৩ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার একটি সচিত্র শিরোনাম ব্যাংকিং আকাশের আলোকে আঁধার কিভাবে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দেয় সে চিত্রটি ফুটে উঠেছে। শিরোনামটি হলো- ‘বাচ্চুসহ ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি’। এ প্রসঙ্গে দৈনিক আমাদের সময় শিরোনাম লিখে- ১৩ বছর পর বাচ্চুর বিরুদ্ধে চার্জশিট বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ৫৯ মামলার ৫৮টিতেই বাচ্চু আসামি, ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ আসামি ব্যাংকের ৪৬ জন, ঋণগ্রহীতা ১০১ জন।’ এখানে একটি কথা আগেই বলে রাখা দরকার যে, আত্মসাৎকৃত ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা তো আসলে এদেশের জনগণ বিশেষ করে বেসিক ব্যাংকের সম্মানিত গ্রাহকগণেরই। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে তো চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো সরকারি সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই। এটাতো সবারই জানা যে, ক্ষেতের ধান রক্ষার জন্য ক্ষেতের চারদিকে দেয়া হয় বেড়া। এই বেড়াই যদি কৃষকের কষ্টের ধান খেতে শুরু করে দেয় তখন অবস্থাটা কেমন হতে পারে তাতো ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন ও বুঝেন। সবকিছু জেনে বুঝেও ঐ ‘বেড়া’র বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে কেন যে ১৩টি বছর লেগে গেলো সে ব্যাপারে দেশের জনগণ বিশেষ করে বেসিক ব্যাংকের গ্রাহকগণ তো নানা প্রশ্ন উত্থাপন করতেই পারেন। প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন ব্যাংকটির সাধারণ কর্মচারী/কর্মকর্তাগণ। কারণ কোনো না কোনোভাবে বদনামের ভাগ তো তাদের ওপরও বর্তায়। যদিও তারা কোন অবস্থাতেও দোষী নন। দায়ী নন। ঐ যে বলে না, সঙ্গগুণে লোহা ভাসে।
শুধু কি বাচ্চু কেলেঙ্কারি। আরো আরো কতো কেলেঙ্কারির কথা স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যায় সময়ের ¯্রােতে সে হিসেব কে রাখে। ঐ যে হলমার্ক কেলেঙ্কারির কথা। প্রশান্ত হালদারের কথা। ব্যাংকিং অভিধানে সুন্দর সুন্দর শব্দাবলি বাংলা ভাষাকে কতোই না সমৃদ্ধ করছে। যেমন ‘ইচ্ছাকৃঋণ খেলাপি’ ‘সুদ মওকুফ’ ইত্যাদি। আরে খেলাপিতো খেলাপিই।
ব্যাংক কোম্পানি আইন কতবারই না সংশোধন হলো। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমছে না, বেড়েই চলেছে। বলি কার ঋণ আর ঋণের সুদ কে মওকুফ করবে। আমার টাকার সুদ তুমি মওকুফ করার কে? জনগণের টাকার সুদ মওকুফ কে দেয় জনগণের চাকরেরা। কৃষকের পাঁচ হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘরছাড়া হয় কৃষক। কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা না করলে ছোটখাটো ব্যাংক ম্যানেজারের বিরুদ্ধে চাকরী বুঝি যায় যায়। সার্টিফিকেট মামলা করে ম্যানেজার চাকরী বাঁচায়। ২ হাজার ৬৫ কোটি ৬৮ লাখ ১৪৫ টাকা আত্মসাতের মামলায় চার্জশিট দেয়া হয় এক যুগ এক বছরে। কাকে আর বলে শুভঙ্করের ফাঁকি? এই ফাঁকির কারণেই খেলাপি ঋণ আদায়ের খাতায় শুধু বাকী আর বাকী। বিচারের বাণী এখানে নিভৃতে শুধুই কাঁদে আর কাঁদে। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন তাইতো বলেন, ‘সমাজের প্রথম কাজ হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।’ আমরা কি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পেরেছি? দেখে শুনে মনে হয় আমাদের দেশের ঋণখেলাপিদের যেন কোন পাপ পুণ্য নাই। ওদের শুধুই যেন সুখ-দুঃখই আছে। বিশ্বকবি একবার বলেছেন, ‘জন্তুদের সুখ-দুঃখ আছে কিন্তু পাপ পুণ্য নেই’। তাহলে কি ওরা জন্তুর কাতারে বসবাস করেন? আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ সবাই গর্ব করে বলেন- ‘লজ্জা নারীর ভূষণ’।
এখন প্রশ্ন হলো লজ্জা কি শুধুই নারীদেরই থাকতে হবে? বড় বড় পুরুষ-কর্তা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কি লজ্জা ভূষণ নয়। যে আব্দুল হাই বাচ্চু সাহেব জাতীয় পার্টির একজন সম্মানিত এমপি মহোদয় এবং বেসিক ব্যাংকের এককালের চেয়ারম্যান, যার সুন্দর আকর্ষণীয় একটি ছবি ‘বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি’ শব্দাবলির নীচে ছাপা হলো সেটি কি লজ্জার না গৌরবের? এ প্রশ্নটি বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছেই রাখলাম। সাথে সাথে সাবেক সচিব প্রশান্ত বাবুর নামে দশ বছর পরে হলেও দুদকের যে মামলা হলো তাতে কি তার লজ্জা হবার কথা নয়? তার মা বাবা স্ত্রী পুত্র কন্যা ভাই বন্ধু শশুর-শ্বাশুড়ী শালা-শালী তাদের সবার মুখে কি এ খবরে সামান্য হলেও কলঙ্কের কালিমা লেপন হয়নি। তিনি একজন সচিব; বৈধ বেতন তার যত বেশিই হোক না কেন, সংসারের সব খরচ চালিয়ে ১৩ কোটি টাকার লেনদেন তিনি কিভাবে করলেন সে প্রশ্নতো আসতেই পারে। পাপ পুণ্য-স্বর্গ-নরক ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে কি কখনো পরিচয় হয়নি? হলেতো ১৩ কোটি টাকার কথা নিয়ে খানিকটা হলেও ভাবতেন। এখন কি হবে বাচাধন। মানসম্মান চলে গেলে ১৩ কোটি টাকা কি চিবিয়ে খাবেন? আর ‘সাবেক’ হয়ে গেলে তো ডাক্তার সাহেবরা খাওয়া-খাদ্যের ব্যাপারে অনেকটা কার্ফু জারি করে থাকেন। আর এ কারফিউ ভঙ্গ করলে তো নিজেরই ক্ষতি। শ্মশান থেকে সমন জারি হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
আর তখন ১৩ কোটি আর ১৩ হাজার কোটি টাকা-ডলার একই কথা। তবে এই বাচ্চু সাহেব বা প্রশান্ত বাবুই কিন্তু শেষ কথা নয়। আরও কত যে সাহেব/বাবু সমাজে বিদ্যমান সবার খবর কি আর দুদকের পক্ষে রাখা সম্ভব? সেদিন একটা খবরে দেখা গেল কানাডার তথাকথিত বেগম পাড়ার মালিক নাকি অধিকাংশই আমলা সাহেবরা। ভাবতে অবাক লাগে, তারা কি জানি এক বিশেষ কামলা। এই ‘কামলা’দের বিরুদ্ধেও নাকি কানাডায়ই মিটিং মিছিল হয়। ওদের অবৈধ টাকার হিসাব চায় মিছিলকারীরা। ঐ বেগমরা তো নারী। ঐ বেগম নারীদের কি লজ্জা নেই? লজ্জা কি তাতের ভূষণ নয়? আসলে তো নয়। আসলে সত্যিকার অর্থে সমাজের কাছে তারা তো ‘কলঙ্কিনি রাই’।
এসব কথা বোধ হয় বলে আর শেষ করা যাবে না। কবিগুরুর যে উক্তি দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই উক্তিতেই ফিরে যেতে হলো। অর্থাৎ এখন হরদম দেখা যাচ্ছে যে, মনুষ্যত্বের খাতিরে আমরা টাকাকে অবজ্ঞা করতে পারছি না। টাকার খাতিরে মনুষ্যত্বকে আমরা অহরহ অবজ্ঞা করেই যাচ্ছি। ফলে হচ্ছেটা কি? টাকাকে খাতির করে মনুষ্যত্ব থেকে আমরা অনেকটাই দূরে সরে যাচ্ছি। দালান কোঠা, বাড়ি-গাড়ি-ধন-সম্পদ-পদ-পদবি এসব নিয়ে তথাকথিত বড় হবার প্রবল ইচ্ছার কাছে বন্দী হয়ে আমরা সত্যিকার অর্থে সুখী হতে পারছি না। অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম, উল্লেখিত বাচ্চু সাহেবের আর কতো বড় হবার দরকার ছিলো? পত্রিকার পাতায় কলঙ্কিত শিরোনাম হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কোন সুখের সাগরে সমাজ আর দেশের বাচ্চুরা ভেসে বেড়াচ্ছেন তারাই জানেন। তবে যে সাগরেই তারা ভাসুন না কেন, অনেক পুরানো একটি গানের কলি কিন্তু সুখের আশায় বড় হবার ঘরে হানা দেবেই দেবে। আর সেটি হলো ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনো অনলে পুড়িয়ে গেল’।
এ প্রসঙ্গে বন্ধুবর অধ্যক্ষ পরিমল কান্তি দে’র মুখে শুনা একটি ঘটনার কথা খুবই প্রাসঙ্গিক মনে করছি। বিশেষ করে উল্লেখিত সাবেক সচিব প্রশান্ত এবং তার সগোত্রীয়দের জন্যতো বটেই। ঘটনাটি হলো-
স্বামী রঙ্গনাথানন্দ যখন বেলুর মঠের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তাঁকে নাকি একবার ওঈঝ অফিসারদের এক প্রশিক্ষণ ক্লাশে বক্তৃতা দেবার জন্য নেয়া হয় এবং সেখানে তিনি নাকি বলেছিলেন- ‘As an executive you are a citizen of India. Before appointment you were a citizen of India and after retirement you will be also a citizen of India and you are to serve the Nation.’ এখন প্রশ্ন হলো- এই বক্তৃতার সারমর্মটি কি শুধু ই-িয়ার জন্যই প্রযোজ্য? সংশ্লিষ্টজন কি একটু ভেবে দেখবেন?
এবার বিদায় নিতে গিয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি উক্তি খুবই মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, ‘অন্তরে পরম ঐশ্বর্য পেয়েও যিনি পরম ভিক্ষু, অনন্ত আসক্তির ভোগের মাঝে যিনি নিরাসক্ত, নির্লোভ নিরভিমান নিরহঙ্কার সেই পরম অভেদজ্ঞানী পরম সাম্য সুন্দরের প্রতীক্ষায় আমি দিন গুণছি।’
এক্ষেত্রে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কবির মতোই বাংলাদেশের সকল মানুষই প্রতীক্ষায় দিন গুনছেন। এ দিন গুণার শেষ কবে কে জানে। আমরা সে আশায়ই রইলাম। আর সবকথার শেষ কথা হলো- আশাই জীবন। নিরাশা নয়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।