ছোট হয়ে আসছে আমাদের মন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুলাই ২০২৩, ১১:৫৫:৫৫ অপরাহ্ন
গোলাম সারওয়ার
বেশির ভাগ ব্যবসায়ী অসৎ বা অসাধু। অথচ ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য ছিল বা মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেবা করা। সেবার বিষয়টি আজ অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। অথবা সেবা সাইনবোর্ডে ফাঁকি দেওয়াই যেন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুধ বিক্রেতা একটা প্রতিষ্ঠান আমাদের শহরে রাতারাতি ব্র্যান্ড হয়ে গেল। বিশাল সাইনবোর্ড, দুধ বিক্রয় সংক্রান্ত। বেশ কয়েকটা শাখাও খুলেছে এরা। রীতিমত দুধ সাপ্লাই দেওয়ার কথা সাইনবোর্ড অনুযায়ী। কিন্তু ক্রমেই এরা দুধ সাপ্লাই থেকে সরে আসছে। প্রায়ই এদের দোকানে দুধ পাওয়া যায় না। দুধের পরিবর্তে মিষ্টিজাত দ্রব্যে ঘর ভর্তি। মিষ্টির সাথে হরেক রকমের ব্রেড-বিস্কুট, চকলেট, খেজুর ইত্যাদি পণ্যে ঘর ভর্তি দেখা যায়। তবে হঠাৎ হঠাৎ দুধ পাওয়া যায়। আমরা মনে করি দুধ বিক্রয়ের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দুধ সরবরাহে অনিয়ম এক ধরনের দুর্নীতি।
এই ধরনের দুর্নীতি এখন সর্বত্র। রুখে দাঁড়ানোর কেউ নেই। দুষ্ট চক্রে এখন বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার। প্রধানমন্ত্রীরও এখন বলার কিছুই নেই। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে এমনটা হচ্ছে, নাকি ডলারের সংকটে হচ্ছে, ডেঙ্গু নাকি করোনা? ফলে একশন-রি-একশনে পরিণত হচ্ছে না অথবা রি-একশন একশনে পরিণত হচ্ছে না।
জাতীয় টাস্কফোর্সের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ৪৪ পার্সেন্ট, অথচ আমাদের স্থানীয় বাজারে কমেছে ২.১৭ পার্সেন্ট। আদা বেড়েছে ১৭২ পার্সেন্ট, এর বিপরীতে আমাদের এই বাংলায় বেড়েছে ২২২.২২ পার্সেন্ট। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে কমলে আমাদের দেশে খুব একটা কমে না। কিন্তু বিশ্ববাজারে একটু বেড়ে গেলে আমাদের স্থানীয় বাজারে অনেক অনেকগুণ বেড়ে যায়।
সিন্ডিকেট এখন ছোট ব্যবসায়ীরা করে না। অবশ্য ছোট ব্যবসায়ীদের সে সাহসও নেই। সিন্ডিকেট করার সাহস বড় ব্যবসায়ীরাই করে। তবে সরকারের উচ্চ মহলে সুবিধা না হলে বড় ব্যবসায়ীরাও সিন্ডিকেট করার সাহস পায় না। সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী-মিনিস্টার এখন ব্যবসায়ী এবং বলতে দ্বিধা নেই এরা বেশির ভাগই রক্তচোষা বাদুরের মত অসৎ ব্যবসায়ী। একের পর এক পণ্যে সিন্ডিকেট করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। আজ ডিমে তো কাল আলুতে সিন্ডিকেট করে পয়সা তুলে নিতে হবে ঘরে, এই অবস্থা আর কি। এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে আর কিছু থাকবে না। ব্যাংক হয়ে যাবে অসৎ ব্যবসায়ীদের পকেট। ওরা পকেট থেকে দয়া করে যদি পয়সা বের করে দেয় তখন পয়সার দেখা মিলবে আর কি।
পাবলিক নিয়েই সরকার। অথচ পাবলিকের বলার কিছুই নেই। পাবলিক বড় জোড় মানববন্ধন করতে পারে। তাতে কার কী? সরকার বলি বা প্রশাসন বলি- এরা কি এসব দেখে? বা দেখলেও কী করার আছে? পণ্যের কারসাজিতে ভোক্তা অধিকারেরই বা কী করার আছে? চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া এদের কিছুই করার নেই। তবে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের জরিমানা করে হালকা বাহবা নিতে চায়। এই উল্লুকেরাও বুঝে এখানে জরিমানা করে লাভ নেই। গোড়ায় যে গলদ এদের না বুঝার তো কথা নয়।
আমাদের বিরোধীদল এবং ক্ষমতাসীন দল সবসময়ই ক্ষমতায় থাকতে চান। ক্ষমতায় থাকার জন্য যা যা করা দরকার তাই করে আমাদের সরকারগুলো। ফলে দুর্নীতি, দুঃশাসন বাড়তেই থাকে। জিরো টলারেন্সে ক্ষমতা চালানোর সৎ সাহসিকতা কারোরই নেই। তোমরা যে যাই করো আমার ক্ষমতা চাই- এটাও এক ধরনের দুর্নীতি। আর এই ক্ষমতার জন্য দুর্নীতির উৎস। দুর্নীতি, দুঃশাসন, অসৎ সিন্ডিকেট যাই বলি না কেন এই ক্ষমতা কেন্দ্রিকতাই মূল দায়ী।
ক্ষমতার বাইরে যারা আছেন, বা ক্ষমতার বাইরে যারা থাকেন- এরা কখনো নিজেকে ছায়া সরকার মনে করেন না। এদের মূল দাম্ভিকতা হচ্ছে সরকার হবো ছায়া সরকার হবো না। এই যাদের মনোভাব, এদের আমরা কি বলব? এরাও ক্ষমতালিপ্সু কিন্তু দেশপ্রেমিক নন। এরা দেশপ্রেমিক হলে ছায়া সরকার হয়ে কাজ করতেন। দেশে ছায়া সরকার থাকলে ক্ষমতাসীনরা কখনোই দাপুটে হতেন না, স্বৈরাচার হতেন না। ছায়া সরকারের কাজই হলো সরকারের দোষ-ত্রুটি নিরূপণ করে সোজা পথে চলার জন্য বাধ্য করা। কিন্তু আমাদের বিগত বিরোধী দলগুলো শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন করে এসেছে। ক্ষমতায় না থেকেও যে দেশসেবা করা যায়- সেটা আমাদের কোনো বিরোধী দলের মাথায়ই থাকে না।
পূর্বেই বলেছি, একের পর এক সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কাজ ছোট ব্যবসায়ীদের কাজ নয়। মাছের মাথায় পছন ধরলে যেমন দ্রুত মাছ পঁচে যায়- সেই অবস্থা হয়েছে এখন আমাদের। বড় ব্যবসায়ীদের ধরতে হবে। এদের সিন্ডিকেটের জাল ছিঁড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু কে করবে? কাজী নজরুল? শেরে বাংলা একে ফজলুল হক? মাওলানা ভাসানী? বঙ্গবন্ধু? শুধু ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আমরা একালের কাজী নজরুল বা বঙ্গবন্ধুদের চাই না।
আমরা চাই দলমত নির্বিশেষে মানুষের জন্য জাগ্রত হোক আমাদের মানবিকতা। এককভাবে কোনো পরিবার পরিত্রাণ পাক, একক কোনো গোষ্ঠী বা সংস্থা উপরে উঠে যাক- আমরা চাই না। মানুষের মন আজ ছোট হয়ে আসছে শুধুমাত্র স্বার্থপরতার রাজনীতির জন্য। স্বার্থপর রাজনৈতিক আজ নিপাত যাক। তা না হলে ক্রমেই মানুষের মন ছোট হতে হতে বিলীন হয়ে যাবে।
নিত্যপণ্য ক্রয় করতে যদি মানুষের মন ছোট হয়ে যায়, তাহলে আর স্বাধীনতার মূল্য থাকে? স্বাধীনতা যদি গায়ে মাখতে না পারে মানুষ তাহলে সে স্বাধীনতার অর্থ কী? বিশ্ববাজার যদি উদারতা প্রদর্শন করতে পারে, আমরা কেন পারব না? পণ্য ক্রয় করতে আমাদের মন ছোট হয়ে আসছে ঠিকই কিন্তু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কি বড় মনের পরিচয় দিতে পারছে? নিছক ছোট লোক অসৎ, অসাধু- নানান অভিধায় কি এরা অভিশপ্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত করছে না?
উন্নয়নের কারণে যদি আমাদের ট্যাক্স বেড়ে যায়, উন্নয়নের কারণে যদি ডলার সংকট হয়, উন্নয়নের কারণে যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে, উন্নয়নের কারণে যদি আমাদের বাজেট প্রতি বছর ফুলে উঠে- তাহলে সে উন্নয়নের কী দরকার? মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যদি দিন দিন ফুরিয়ে যায়- তাহলে আর সে উন্নয়নের অর্থ কি?