বাজারকেন্দ্রিক অশুভ চক্র
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০১:২৭ অপরাহ্ন

রাহমানা শাব্বীর চৌধুরী
ব্যবসায়ীরা যাই বলুন- বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থা না মুক্তবাজারের সাথে তুল্য না প্রতিযোগীতামূলক বাজারনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বরং বলা চলে বাজার ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিবাদী ধারায়। ফলে কার নিয়ন্ত্রণে এ বাজার তা কেউ জানেন না। এক দিকে উৎপাদক পর্যায়ে ন্যায্যমূল্য মিলছে না, অন্যদিকে একই পণ্য মাত্রাতিরিক্ত মূল্যে কিনতে গিয়ে ক্রেতা হয়রানি অন্তহীন। মাঝখানে মুনাফা যাচ্ছে মধ্য স্বত্বভোগী ও কালোবাজারিদের পকেটে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। তাই সাধারণ মানুষ কেমন আছেন সেটি বোঝার অন্যতম উপায় বাজার মূল্যায়ন। বাজারে নিত্যপণ্যের কেনাবেচার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
অতিসাম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে বিগত কয়েক বছরের সাথে বর্তমান বাজার পরিস্থিতির তুলনা করে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। ঢাকার মানুষের বড় একটি অংশ ভোক্তা হিসেবে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে পৌঁছে গেছে, সেই চিত্র প্রতিবেদনটিতে ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদক সরেজমিন এক নারীকে ২০ টাকায় দোকান থেকে দুটা ভাঙা ডিম কিনতে দেখেন। তাকে প্রশ্ন করেন- কেমন আছেন, উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ দুটো ভাঙা ডিম দুপুরে ভাজি করে পরিবারের পাঁচ সদস্য মিলে খাব। বুঝেন এবার কেমন আছি।’ বাজারে মাছ-গোশত বিক্রি কয়েক বছরের তুলনায় বড় দাগে কমে গেছে। খালি চোখেই এটি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পত্রিকাটি গরিবের আমিষের উৎস পাঙ্গাশ মাছের দামের চিত্র ও বাজারে এর বেচাকেনা কেমন তার তুলনা করে দেখিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে এক কেজি পাঙ্গাশ ঢাকার বাজারে ১১১ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ১০ বাজারের চিত্র ছিল- ছোট ও মাঝারি পাঙ্গাশ প্রতি কিজি বিক্রি হয়েছে ১৮০-২২০ টাকা। দুই কেজির বেশি ওজনের পাঙ্গাশ ২৫০ টাকা দরে বিক্রিয় হয়েছে। দাম বেড়েছে ২৭৭ শতাংশের বেশি। নিম্ন আয়ের মানুষের আমিষের আরেকটি উৎস ফার্মের মুরগি ও ডিম। ২০২০ সালে এক কেজি মুরগির গোশত ছিল ১২৫ টাকা। এখন ২০০ টাকার বেশি। একই সময় ডিমের ডজন ৯০-১১০ টাকা ছিল। বর্তমান মূল্য ১৫০ টাকার আশপাশে।
তবে এগুলোর দাম সীমা ছাড়ালেও বিক্রি কমেনি। নিশ্চিত বলা যায়, যারা অন্য মাছ-গোশত খেতেন তাদের একটি বড় অংশ এখন পাঙ্গাশ, ব্রয়লার ও ডিমের খরিদ্দার হয়েছেন। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি থেকে সৃষ্ট উচ্চদামের চাপে ৯৬ শতাংশ পরিবার গোশত খাওয়া কমিয়েছে, মাছ ৮৮ শতাংশ ও ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৭৭ শতাংশ পরিবার। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গত মার্চের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জলাশয় ডোবা নালা ও সামুদ্রিক মাছের দাম আকাশছোঁয়া। ছোট চিংড়ি মানুষ শাকপাতা ও সবজি রান্নায় ব্যবহার করত, বাজারে এক হাজার টাকার ঊর্ধ্বে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকার কাছাকাছি। চাষের মানসম্পন্ন মাছের দাম ৬০০ টাকার নিচে নেই। গরুর গোশতের দাম ৮০০ টাকা। খাসির দর এক হাজার টাকার বেশি। এসবের বেশির ভাগের দাম দুই বছর আগে অর্ধেকের কম ছিল। কিছু ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। নিম্নবিত্তের মানুষ এসব মাছ-গোশত খাবেন এখন তা কল্পনা করতেও আর পারেন না। প্রতিদিন বেঁচে থাকতে যে খাদ্যপণ্য দরকার তার প্রতিটির দাম সীমার বাইরে। পত্রিকাটি ২০২০ সালের সাথে বর্তমান বাজারমূল্যের তুলনা করে দেখিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ৩০ টাকার মোটা চাল বর্তমানে ৫০ টাকা, ৩৫ টাকার আটা ৬৫ টাকা, ১০০ টাকার সয়াবিন তেল বর্তমানে ২০০ টাকা।
এভাবে আলু-পেঁয়াজ ডালসহ প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম এখন সেই তুলনায় দ্বিগুণ। ঢাকার বাজারের সাথে এখন সারা দেশের পণ্যমূল্যচিত্র খুব একটা পার্থক্য নেই। দুই বছর আগের তুলনায় মানুষের আয় গড়ে দিগুণ বাড়েনি তা নিশ্চিত; বরং অনেক ক্ষেত্রে আয় কমেছে। সাথে মূল্যস্ফীতি প্রকৃত আয় আরো কমিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে প্রতিটি পরিবারে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। করোনাকালে সানেমের এক জরিপে দেখা গিয়েছিল- ৪২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। দারিদ্র্যসীমার উপরে যারা রয়েছেন; তাদের বড় অংশটি বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। দেশের অল্পসংখ্যক মানুষ লাগামহীন বাজারে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন। এদের মধ্যে মূলত রয়েছে ক্ষমতাসীনরা। যারা অবাধে নানা দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছেন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, পণ্যমূল্য নিয়ে হিমশিম খাওয়া মানুষ কোনোভাবে সরকারের নজরে আসছে না। এ অবস্থায় বাজারকেন্দ্রিক যে অশুভ চক্র রয়েছে কোনো কারণে তা-ও ‘ভাঙতে উদ্যোগী হয় না সরকার, সেটি এক রহস্য।