উদ্ধার হচ্ছে সুনামগঞ্জে বেদখল হওয়া সেই ৫টি খাল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুলাই ২০২৩, ৪:১১:৩৯ অপরাহ্ন
![উদ্ধার হচ্ছে সুনামগঞ্জে বেদখল হওয়া সেই ৫টি খাল উদ্ধার হচ্ছে সুনামগঞ্জে বেদখল হওয়া সেই ৫টি খাল](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2023/07/p-4-10.jpg)
কামার খাল দিয়ে অভিযান শুরু # স্বাগত জানালেও মাঝপথে থমকে যাওয়া নিয়ে বেলা’র শঙ্কা
কাউসার চৌধুরী
উচ্চ আদালতের আদেশে অবশেষে সুনামগঞ্জ শহরে অবৈধভাবে বেদখল হওয়া ঐতিহ্যবাহী কামার খাল উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল দশটা থেকে সুনামগঞ্জ পৌরসভা ও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন যৌথ এ অভিযান শুরু করে। সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) সালমা পারভীনের নেতৃত্বে শুরু হয় অভিযান। সুনামগঞ্জ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম সাবেরীন সাব্’ুর পরিবারের অবৈধভাবে নির্মিত দোকানকোঠাটি উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ অভিযান। এরপর অন্যান্য স্থাপনা উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে চলে সুনামগঞ্জ শহরের কামার খাল উদ্ধার অভিযান। কেবল কামার খালই নয়; পর্যায়ক্রমে তেঘরিয়া খাল, বড়পাড়া খাল, নলুয়াখালী খাল ও বলাইখালী খালের উপর নির্মিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে পাঁচটি খাল দখলমুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
উদ্ধার অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। খাল উদ্ধারে উচ্চ আদালতে রিট করেছিল বেলা।
বেলার সিলেট বিভাগের সমন্বয়ক এডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার গতকাল শনিবার বিকেলে সিলেটের ডাককে বলেন, এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। সুনামগঞ্জ শহরের অভ্যন্তরের পাঁচটি খাল উদ্ধারে উচ্চ আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, আমরা এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন চাই। মাঝপথে অভিযান থমকে যায় কিনা এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ইতোপূর্বেও অভিযান শুরুর পর মাঝপথে অভিযান থমকে যাওয়ার নজির রয়েছে।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত জানিয়েছেন, কামার খালের মধ্য দিয়ে শুরু হলো এ অভিযান। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, পর্যায়ক্রমে বাকি খালগুলোও উদ্ধার হবে। প্রথমদিনে অন্ততঃ ৬০/৭০ ভাগ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আজও উদ্ধার অভিযান চলবে বলে জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে প্রথমদিনে
কামার খালের উপর নির্মিত দোকানপাঠ, বাসাবাড়িসহ নানা ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এর আগে উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে পাঁচটি খালের উপর নির্মিত অবৈধভাবে স্থাপনা সরিয়ে নিতে জেলা তথ্য অফিস মাইকিং করে। ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে নিজ দায়িত্বে মালামাল ও স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। অন্যথায় ১৫ জুলাই থেকে উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম শুরু হবে মর্মে জানানো হয়।
এর আগে কামার খাল, তেঘরিয়া খাল, বড়পাড়া খাল, নলুয়াখালী খাল ও বলাইখালী খালের সীমানা লাল কালি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি রিটের (রিট পিটিশন নং ১০৮১/২০২৩) শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ সুনামগঞ্জ পৌর শহর ও আশপাশের এলাকার পাঁচটি খালের দখলদারদের পূর্ণ তালিকা করে তাদের উচ্ছেদের আদেশ দেন। বেলা’র পক্ষ থেকে জনস্বার্থে ওই রিট মামলা করা হয়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কামার খাল শহরের উত্তরপ্রান্ত উত্তর আরপিননগরে সুরমা নদী থেকে শুরু হয়ে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, বাধনপাড়া, নতুনপাড়া ও মরাটিলা হয়ে দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ঝাওয়ার হাওরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। খালের উৎসমুখের প্রশস্ততা ছিল প্রায় ১২০ ফুট। এসএ রেকর্ড অনুযায়ী কামার খালের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ফুট এবং প্রস্থ ৩৫ ফুট। বর্তমানে খালটির কোনো অস্তিত্ব নেই। কোথাও কোথাও সরু নালায় পরিণত হয়েছে এক সময়ের প্রমত্ত কামার খাল। ধীরে ধীরে খালটি বেহাত হয়ে যাওয়ায় ২০০৫ সালে স্থানীয় লোকজন খালটি দখলমুক্ত করার দাবিতে সোচ্চার হন। বেলা খালটি উদ্ধারে একই সময়ে কার্যক্রম শুরু করে।
স্থানীয় লোকজন জানান, সুনামগঞ্জ শহরের প্রধান খাল হিসেবে পরিচিত কামার খালের উৎসমুখে গড়ে তোলা হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়। দখলদাররা বাণিজ্যিক, আবাসিক ভবন ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে।
# কামার খাল দখলে যাদের নাম
সুনামগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা কাজী শামসুল হুদা সোয়েল ও সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মো. আতিকুর রহমান ২০১৮ সালের ১ জুলাই ৮৪ জন দখলদারের তালিকা তৈরি করেন। তবে, এই তালিকায় অনেক দখলদারের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। খাল দখলে জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, কতিপয় সাংবাদিকও আছেন। ওই তালিকা অনুযায়ী দখলদারদের মধ্যে খুশবুল মিয়ার আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, পৌর কমিউনিটি সেন্টার, উত্তর আরপিননগর প্রাথমিক বিদ্যালয়, মইনুল মিয়ার টিনশেড ঘর, রাসেল মিয়ার টিনশেড ঘর, কামরুল ইসলামের টিনশেড পাকা দোকান ও পাকা বারান্দা, সেলিম মিয়ার টিনশেড পাকা ঘর, মহিমা বেগমের পাকা দ্বিতল বিল্ডিং, অদুদ মিয়ার টিনশেড ঘর ও বাথরুম, আরপিন নগর মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনের বাসস্থান দ্বিতল বিল্ডিং, সিরাজুল ইসলামের দোকান ও টিনের ঘর, আলী নুরের টিনশেড বেড়া, আপ্তাবুন্নেসার টিনের ঘর (লন্ড্রি), আব্দুল মনির রনির টিনের বেড়া, আব্দুল হামিদের পাকা ঘর, খসরু মিয়ার টিনের ঘর, পপি বেগমের সানশেড, পাকা কবরস্থান, ফরহাদ মিয়ার পাকা ঘর, গোলাম হোসেন গংদের টিনশেড ঘর, সুজন মিয়ার টিনশেড বিল্ডিং, পৌরসভা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত গণশৌচাগার এর পাকা ঘর, আবু হানিফার টিনের ঘর, লুৎফুর রহমানের টিনের ঘর ২টি, বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমানের টিনশেড পাকা ঘর, সিরাজ মিয়ার টিনশেড বিল্ডিং, খোরসেদ আলমের টিনের ঘর, রুমি বেগমের টিনের ঘর, মিনু বেগমের টিনের ঘর, মোর্শেদ আলী গংদের টিনশেড বিল্ডিং, খায়রুল ইসলামের টিনশেড পাকা ঘর, রুকম চৌধুরী গংদের টিনশেড পাকা ঘর, লুৎফিয়া হুসাইনিয়া নুরজাহান বখত মাদ্রাসা পাকা ফাউন্ডেশন, মানিক মিয়ার টিনশেড ঘর, সনৎ কুমার সোমের টিনশেড বেড়া, কৃষ্ণ রায়ের টিনশেড পাকা ঘর, চন্দন সাহার টিনের বেড়া, এডভোকেট মইনুদ্দিনের টিনের ঘর, আব্দুল মতিনের টিনের বেড়া, আবু জাফরের অস্থায়ী ছাউনি (চা স্টল), রানু দাসের অস্থায়ী ছাউনি (চা স্টল), গোলাম জাকেরীনের ওয়ার্কশপ (আদালতের রায় ও ডিক্রিপ্রাপ্ত), গোলাম কিবরিয়ার ওয়ার্কশপ (আদালতের রায় ও ডিক্রিপ্রাপ্ত), গোলাম দবীরের টিনশেড পাকা দোকান (আদালতের রায় ও ডিক্রিপ্রাপ্ত ), গোলাম কবিরের টিনশেড পাকা দোকান (আদালতের রায়ও ডিক্রিপ্রাপ্ত), সিরাজুল ইসলামের টিনশেড পাকা দোকান ঘর, যুদ্ধাহত বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাসিমের টিনশেড পাকা দোকান ঘর, মো. আলী খুশনুরের টিনশেড পাকা দোকান ঘর, গোলাম সাবেরীন সাবুর টিনশেড পাকা লেট্রিন, গোলাম কবিরের টিনশেড পাকা লেট্রিন, গোলাম দবিরের পাকা লেট্রিন, গোলাম কিবরিয়ার বাউন্ডারি দেয়াল, যুদ্ধাহত বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাসিমের টিনশেড পাকা লেট্রিন, স্বপন কুমার দাস গংদের টিনশেড পাকা লেট্রিন ও পাকঘর, চন্দন কুমার সাহা গংদের টিনের ঘর, সুদীপ দেবের টিনশেড পাকা ঘর, নানু দেবের টিনশেড পাকা ঘর, আয়েশা আজাদের টিনের বেড়া, দিগ¦ীজয় চৌধুরীর টিনের বেড়া, শামীম তালুকদার ভানুর টিনের বেড়া, কালীবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতল বিল্ডিং, নুর মিয়ার টিনশেড পাকা ঘর, বুলচান্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাকা বাউন্ডারি ওয়াল, আব্দুল হান্নানের টিনশেড পাকা বাথরুম, দিল হকের টিনের ঘর, এনামুল হকের টিনের ঘর, মঙ্গল প্রাচীর টিনের ঘর, সুরঞ্জন পাসীর টিনের ঘর, আব্দুর রউফ জনরের টিনের ঘর, সুনু মিয়ার পাকা বাথরুম, আজর আলী গেদার টিনশেড পাকা দেয়াল,সাকির আহমদের টিনশেড পাকা দেয়াল, তোফাজ্জল হোসেনের আধা পাকা বিল্ডিং, সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের গার্ড রুম, আকবর আলীর টিনশেড পাকা ঘর, রাহেলা খাতুনের টিনের বেড়া ও ঘর, আকবর আলীর টিনের ঘর, বিনয় পালের টিনের ঘর, হাসমত আলীর টিনের ঘর, আরজ আলীর টিনের ঘর, সত্তার মিয়ার টিনের ঘর, খোকন মিয়া গংদের টিনের ঘর এবং মখদ্দছ আলী গংদের টিনের ঘর রয়েছে।
আরও দখলদারের নাম
এদিকে, তেঘরিয়া খালে অবৈধ দখলদার হিসেবে ৫ জনের নাম এসেছে। তারা হলেন- কালীপুরের আব্দুর রহমান, আসক আলী, সুরুজ আলী, ইদ্রিছ মিয়া ও নছির উল্লা।
বড়পাড়া খালে অবৈধ দখলদার হিসেবে বড়পাড়ার ছমির উদ্দিন ও আমিরুল ইসলামের নাম এসেছে। গেল বছরের ২৬ জুলাই সুনামগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে পাঁচ খালের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দখলদারদের মধ্যে কামার খালেই সর্বোচ্চ দখলদার রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর ‘হারিয়ে গেছে সুনামগঞ্জের কামার খাল’ শিরোনামে দৈনিক সিলেটের ডাক-এ একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।