সুন্দর জীবনের আহবান স্কুল ব্যাংকিং
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুলাই ২০২৩, ৪:২১:১৫ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম
ধনী কিংবা গরিব-সবার জীবনে সঞ্চয়ের বিকল্প নেই। ছোট ছোট সঞ্চয় ভবিষ্যতের জন্য অনেক বড় উপলক্ষ তৈরী করতে পারে। সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এগারো বছর আগে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে সরকার। মূলত স্কুল জীবন থেকে শিশুদের মধ্যে সঞ্চয় সম্পর্কে উদ্দীপনা তৈরী করার লক্ষ্যে সেই কার্যক্রম শুরু হয়। সিলেট বিভাগে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তিন লক্ষ ১৯৬টি হিসাব খোলা রয়েছে। সেই হিসেব অনুযায়ী টাকা রয়েছে ১১৩ কোটি টাকা। তবে এই কার্যক্রমে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো এগিয়ে থাকলেও বিদেশী ব্যাংকগুলো পিছিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিটি মানুষের জীবনে সঞ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধ্যমত সঞ্চয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সুন্দর ভবিষ্যতের বীজ। অথচ, সময়মতো সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে না ওঠার ফলে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের জীবনের অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা কাঙ্খিত সুফল থেকে বঞ্চিত হয়।
সঞ্চয় না থাকার ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না। অনেক সময় অর্থের অভাবে শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, পরিবারের স্থায়ী একটি সঞ্চয়ের অভাবে অনেক সময় শিক্ষা জীবনে অনেক বড় বড় সুযোগ আসলেও সেটি কাজে লাগানো সম্ভব হয় না।
অথচ সারা দেশের মতো সিলেটের সরকারি-বেসরকারি সবগুলো ব্যাংকে স্কুল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অনেক অভিভাবক সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, অথবা তারা সে বিষয়ে অবগত নন। আর গুরুত্ব না দেয়ার খেসারতও একসময় দিতে হয় অনেক পরিবারকে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোরও একটি দায় রয়েছে। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বদ্ধু কিংবা যেভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাবার কথা সেভাবে করছে না-এমনটা মনে করছেন অনেক অভিভাবক।
এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে সিলেটে বড় একটি ভূমিকা রেখেছে ঢাকা ব্যাংক। তাদের নেতৃত্বে সিলেটে স্কুল ব্যাংকিং সম্মেলন গতকাল শনিবার নগরীর
আমান উল্লাহ কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে সিলেট জেলার ৫০টি বিদ্যালয়ের প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অংশগ্রহণ করেন।
স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জন্য যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা, মূলত তা-ই স্কুল ব্যাংকিং। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে দেশে ২০১০ সাল থেকে স্কুল ব্যাংকিং চালু করা হয়। খুব সহজে এই হিসাব খোলা যায়। এ হিসাব থেকে কোনো চার্জ কাটা হয় না। চেক বই নিতে গুণতে হয় না বাড়তি টাকা। জমা বই, ডেবিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন সুবিধাও এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। আর স্কুল ব্যাংকিংয়ের আমানত মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী আমানত, যা স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগযোগ্য।
যে সকল ছাত্রছাত্রীর আয়ের উৎস নেই; তারা তাদের মা-বাবা, ভাই- বোন, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় উপহার স্বরুপ নগদ যে অর্থ পেয়ে থাকে তা থেকে কিছু বাঁচিয়ে জমা রাখার জন্য একটি সেভিংস হিসাব খোলাই স্কুল ব্যাংকিংয়ের উদ্দেশ্য বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে ওঠবে। আর
এই অভ্যাস একদিন অনেক বড় প্রশান্তি বয়ে আনতে পারে।
সরকারি অগ্রগামি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক হুমায়ুন। তিনি জানান, এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে জানতে পেরে দশ বছর আগে একটি হিসাব খুলেছিলাম। তারপর থেকে মেয়ের মধ্যে জমানোর খুব আগ্রহ দেখি। যখনই হাতে টাকা আসে ; সে ব্যাংকে জমা রেখে দেয়। মেয়ের জমানো ছোট ছোট সেই সঞ্চয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচটা নিয়ে আমাদের আর ভাবতে হচ্ছে না।
একই স্কুলের আরেকজন অভিভাবক দিপালী বলেন, যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে স্কুল ব্যাংকিংয়ে হিসাব খোলার পর থেকে। একই সাথে তার মেয়ে ব্যাংকিংয়ের অনেক বিষয় বুঝতেও সক্ষম হয়েছে। যা পরিবারের বড়রাও জানে না।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের যুগ্ম পরিচালক সিতাংশু শেখর রায় জানান, আমরা স্কুল ব্যাংকিং খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংগুলোকে এ বিষয়ে বেশকিছু নির্দেশনাও দেয়া আছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরী করার জন্য ব্যাংকগুলোকে স্কুলে স্কুলে যাওয়ার জন্যে তাগিদ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, সিলেট বিভাগে সরকারি পর্যায়ে স্কুল ব্যাংকিংয়ে এগিয়ে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, বেসরকারি পর্যায়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী এগিয়ে রয়েছে ইসলামি ব্যাংক। যদিও সরকারি- বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আরো বেশী এ বিষয়ে কাজ করা দরকার রয়েছে। ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, আম্বরখানা শাখার এফ এ ভিপি এবং ম্যানেজার জ্যোতিলাল গোস্বামী এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ৬ বছর থেকে ১৮ বছরের নীচে যেকোন ছাত্রছাত্রী স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় হিসাব খুলতে পারবে। এই হিসেব মা, বাবা অথবা যেকোন আইনগত বৈধ অভিভাবকের মাধ্যমে খোলা ও লেনদেন পরিচালিত হয়ে থাকে।
তিনি আরো জানান, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত সিলেট বিভাগে সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তিন লক্ষ ১৯৬টি হিসাব খোলা হয়েছে। সেই হিসেব অনুযায়ী টাকা রয়েছে ১১৩ কোটি টাকা। তবে এই কার্যক্রমে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো এগিয়ে থাকলেও বিদেশী ব্যাংকগুলো পিছিয়ে রয়েছে। তিনি জানান, ছাত্রছাত্রী স্কুল ব্যাংকিং শুরু করলেও ১৮ বছর পর সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবে রূপান্তরের সুযোগও রয়েছে।
এদিকে, গতকাল ঢাকা ব্যাংকের অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় সম্পর্কে উৎসাহিত করা এবং তাদের সঞ্চয়ের মানসিকতা গড়ে তোলা।
সকাল ৯টায় পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে স্কুল ব্যাংকিং কনফারেন্সের উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ বেতার সিলেটের উপস্থাপক, ওয়ান ব্যাংক কর্মকর্তা সুকান্ত গুপ্ত এবং বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের উপস্থাপক রোহেনা দিপুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেট অফিসের নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা ব্যাংকের হেড অব রিটেইল বিজনেস এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মোঃ ইকবাল মহসিন ও সিলেট জেলার শিক্ষা অফিসার আবু সৈয়দ মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ।
এছাড়াও অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপক ও আঞ্চলিক প্রধান ও ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের হেড অব স্টুডেন্ট ব্যাংকিং মোহাম্মদ সাইফুর রহমানসহ ২০০ অধিক ব্যাংক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আসর বসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ২০১০ সালে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেন। শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে।