‘আমি সখিনা বানু’ ও অন্যান্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুলাই ২০২৩, ৫:৩৭:০৭ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ আব্দুল হক
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসিমউদ্দিন, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, কবি দিলওয়ার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, শহীদ কাদরীর লেখা বারবার পড়েও মনে হয় কোথায় যেনো কি একটা বুঝতেই পারলাম না, অথচ আমাকে বারবার টানছে। হ্যাঁ, শুদ্ধ সাহিত্য এমনই। একবার পড়লে আবার পড়ার আগ্রহ থেকে যায় এবং তখন ওই লেখা সেটা কোনো কাগজের বইয়ে হোক কিংবা ই-বুক হোক অথবা কোথাও কোনো অনলাইনে প্রকাশিত হোক না-কেন, যতœ করে পাঠক তা অনলাইন পোর্টাল থেকে সেইভ করে রেখে দেয় অথবা গ্রন্থটি বুকশেলফে রেখে দেয়। সময় করে আবার পড়তে থাকে এবং
খুঁজে পেতে চেষ্টা করে কবি ও লেখক কি-কথা বলতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যের ভান্ডারে অনেক গ্রন্থ অনেক লেখা জমা হয়ে গেছে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহমদের।
সৈয়দ আলী আহমদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমার কবিতা দিয়ে শুরু করতে হবে, ‘যদি তুমি কবি/ তবে তুমি প্রেমিক।/ যদি থাকো কবিতায়/ আছো তুমি বিপ্লবে,/ মানবতায় আছো,/ আছো শষ্যকণায়,/ আছো ধরনীর ধূলিকণায়।’ তাকে একজন প্রেমিক কবি হিসেবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথায় লেখায় ও সশরীরে উপস্থিতিতে পাওয়া গেছে। তিনি মানবিক, ফুল ফসল প্রকৃতি প্রেমিক এবং তিনি বাংলাদেশের মাটির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মিলে চলেন। ব্যক্তিগত জীবনে একজন সৈনিক, রাজনীতিবিদ, তিনি একজন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তাঁর পরিচিতি সীমানা ছাড়িয়েছে। এসব পরিচয়ের সবকিছুকে ছাড়িয়ে তিনি এক কথায় কথাসাহিত্যিক। তার ‘আমি সখিনা বানু’ কাহিনীকাব্যটি বাংলা সাহিত্যের সফল কাহিনীকাব্য ‘বীরাঙ্গনা’ এবং ‘সুজন বাদিয়ার ঘাট’ এর সাথে এক চমৎকার সংযোজন। তাঁর এই কাহিনীকাব্যের ভাষা সহজ হওয়ায় সমঝদার পাঠক সহজে বুঝতে পারে এবং দৃশ্যকল্প চোখের সামনে চলে আসে। ‘আমি সখিনা বানু’ তে কবি কতোটা সরল শব্দের উপস্থাপনা দেখিয়েছেন তার একটা উদাহরণ দিই- ‘ভোরের আকাশে একা থাকে শুকতারা/ তারেও সঙ্গ দেয় কখনো চাঁদ-/ আমার নিঃসঙ্গ জীবনের কোন সাথী নেই।/ আধো ঘুম আধো জাগরণে এপাশ ওপাশ করি/ সারারাত কেউ যেনো গহীন অবসন্নতায়/ পেচিয়ে নেয় অক্টোপাসের মতো/ নিদ্রার সাগরতলে, খুব গভীরে।/ মন চায় পিষ্ট হতে শক্তিমত্ত আনন্দের কোলে।/ সমর্পণের সুখটুকু স্বপ্নে আসে/ ঘুম ভাঙ্গলেই থাকে না কিছু-/ আমি একা থাকি-খুব একা।’ এভাবেই বাংলাদেশের একজন সখিনা বানুর কথা কবির কলমে কাব্যগাঁথা হয়েছে ‘আমি সখিনা বানু’ নামক কাহিনীকাব্যে। তাঁর ‘সংসার ও সন্ন্যাস’ কাব্যে খোঁজে পাওয়া যায় একজন প্রেমিক পুরুষ সৈয়দ আলী আহমদকে।
এখানে ‘তোমার ভালোবাসা’ কবিতায়- ‘একবার বৈশাখি মেলায় চোখে চোখে চেয়েছিলে,/ আমি চাইলেই চোখ নামিয়ে নিতে-/ একদিন কবিতা পাঠের আসরে তাকিয়েছিলে,/ বেতফলের মতো থোকা থোকা আগ্রহ/ চোখের দৃষ্টিতে ঝুলছিল-/ প্রভাতফেরিতে বলেছিলে,/ ‘কেমন আছেন?’ কি চমৎকার উপস্থাপন।
এই কবিতা পড়ে এগিয়ে গেলে আরও মনকাড়া প্রেমের দেখা মিলে- ‘সেদিন চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে/ খুব কাছে এসে বলেছিলে,/ ‘আপনাকে খুব ভালো লাগে’/ পরদিন চোখে জল নিয়ে খুব লজ্জায়/ নতমুখে অস্ফুটে বলেছিলে,/ ‘তোমাকে ভালোবাসি।’ এভাবেই তাঁর কবিতা পাঠ করলে খুব স্বাভাবিক একজন প্রেমিক কবিকে দেখা যায়। সৈয়দ আলী আহমদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষকে নিবেদন করে লিখেছেন কবিতা। তাঁর ‘নিবেদিত অনূদিত কবিতা’ গ্রন্থে এমন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে আছে কবিতাগুলো। কবি দিলওয়ারকে নিবেদিত ‘সোনালি ঈগল’ কবিতাংশ- ‘একটি সোনালি ঈগল/ মাঝে মাঝে আকাশে ওড়ে ঘুড়ির মত/ মাঝে মাঝে যুদ্ধ বিমানের মতো হাওয়ায় চক্কর কাটে,/ চক্কর কাটে উপরে ও নীচে চি-ই-ই-ই শব্দ করে-/ সেই ঈগল ছোটোবেলার আকাশটা দখল করেই ছিল।’ আমাদের কবি দিলওয়ার এভাবেই আমাদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে আছেন সাহিত্যের আকাশে।
সৈয়দ আলী আহমদের উপন্যাস সমাজের নানান দিকের ইঙ্গিত দিয়ে এগিয়ে গেছে। তাঁর উপন্যাস ‘আতরমুল্লার সাতকাহন’ তাঁর মননশীলতার পরিচয় বহন করে। এখানে সমাজের প্রকাশিত আলোর নীচের অপ্রকাশিত অন্ধকার জগতের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। উপন্যাসের গতি সাবলীল। এই উপন্যাসে প্রকাশকের কথা হচ্ছে, ‘তাঁর ভাষা এবং শব্দচয়ন এর মধ্যে একটি চমক আছে, যা লেখাকে সুখপাঠ্য করে এবং পাঠককে নতুন রসে সিক্ত করবে। আমরা গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।’ তাঁর লেখা ‘ষোলোআনা চৌধুরী’ খুব স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলা একটি উপন্যাস, এতে কোনো সন্দেহ নেই। গল্পে এক সময়ের জমিদার শ্রেণির অহংকার এবং শিক্ষা ও আভিজাত্যের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। আছে প্রেমিক প্রেমিকার
ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য, যা এসময়ের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অস্থির ছেলেমেয়েদের প্রেমের ক্ষেত্রে হিতাহিত জ্ঞান না-হারানোর শিক্ষা দিবে। তার ‘মুভে ফাম’ তাঁর সৈনিক জীবনের জাতিসংঘের হাইতি মিশনের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। বহুবার পাঠে এর মর্মার্থ ধরতে পারা যাবে। সত্য হচ্ছে আমাদের সমাজের পরতে পরতে হাজার ঘটনা সুন্দর শব্দ চয়নে আকর্ষণীয় বর্ণনায় কল্পনার মিশ্রণে নানান চরিত্রে দৃশ্যপটে অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে সাজিয়ে লিখতে পারলেই পাঠকের মনে গেঁথে থাকে বহুদিন। তেমনি এক উপন্যাস হলো সৈয়দ আলী আহমদের ‘ইসরাফিলের বাঁশি’। গল্পের প্লট সিলেটের এমসি কলেজের হলেও, এই উপন্যাসে মূলত বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির আড়ালে ঘটে চলা অন্ধকার দিক তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাস নতুন গল্প লেখকদের গল্প লেখার এক চমৎকার কৌশল শিক্ষা দিবে। এপর্যন্ত তাঁর গ্রন্থ সমূহের মোড়কে কবি ও লেখক হিসেবে তাঁর নাম সৈয়দ আলী আহমদ হলেও, তাঁর ‘রাজনীতির ধারাপাত’ গ্রন্থের মোড়কে দেখতে পাই লেখক হিসেবে নাম হয়েছে লে. কর্ণেল সৈয়দ আলী আহমদ (অব.)। গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বাস্তবতার ভিত্তিতে লেখক তাঁর গবেষণা ব্যঙ্গাত্মক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
সৈয়দ আলী আহমদ সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সুনামগঞ্জ জুবিলী স্কুল, সিলেট এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়া শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭০ সালে ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হন। তিনি ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন প্রথমে ১৯৭৭ সালে সুনামগঞ্জ কলেজে প্রভাষক হিসেবে। ওই বছরই ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। পরে ১৯৮৩ সালে আমেরিকায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৯৫-৯৬ সময়ে হাইতিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশ নেন। এরপর ১৯৯৯-২০০০ সালে কুমিল্লা সেনানিবাস ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবং ২০০১-২০০২ সালে সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৩ সালে কর্মজীবন থেকে অবসরে যান। কিন্তু তিনি সমাজ সচেতন হিসেবে সবসময় সমাজের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন।