স্কুলিং ও শিশুদের মন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০২৩, ১:৪৩:০৩ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
সরকারের শিক্ষা বিভাগ যদিও শিশুদের স্কুলে ভর্তির জন্য ছ’বছর বয়স নির্ধারণ করেছেন কিন্তু দেখা যাচ্ছে বেসরকারী স্কুলগুলোতে বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে ৪ বছরের কম বয়সের শিশুদেরও ভর্তি করা হচ্ছে। এভাবে শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়ে স্কুলে পাঠাবার পর শিশুমনে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তা লক্ষ্য করার প্রয়োজনীয়তা অভিভাবকরা খুব একটা বোধ করেন বলে মনে হয় না। দেখা যায় কোন রকমের প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ করে কোন একদিন মা-র কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ক্লাসে শিশুটিকে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে।
শিক্ষা বিভাগের নির্দিষ্ট ভর্তি বয়সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বর্তমানে এ জাতীয় দুগ্ধপোষ্য শিশুদের স্কুলে ভর্তি করার রেওয়াজ যখন চালু হয়ে গেছে, তখন অভিভাবকদের জেনে রাখা ভাল প্রাক স্কুল ভর্তি সময়ে বাড়িতে তাদের কিছুটা প্রস্তুতি প্রয়োজন। যে সমস্ত অভিভাবক কোন প্রস্তুতি ছাড়া শিশুদের স্কুলে ভর্তি করে থাকেন দেখা যায় তারা ভর্তির সপ্তাহ খানেক অথবা তারও কিছুটা বেশী সময়ব্যাপী সেখানেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
আগেই বলা হয়েছে শিশুদের প্রাক বিদ্যালয় প্রস্তুতির অভাব। এতদিন শিশুটি বাড়ীতে সবসময় মা-বাবার কোলে ও পরিবারের সবার আদরে অভ্যস্থ জীবন কাটিয়েছে। হঠাৎ করে সে পরিচিত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণ অপরিচিত মহলে তার শিশুমন হাহাকার করে উঠে। এ বিচ্ছিন্নতাবোধ শিশুটিকে একান্ত অসহায় অবস্থায় ফেলে দেয়। তখন তার হৃদয় বাঁশপাতার মতো কাঁপতে থাকে। প্রথম কিছুদিন স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার কোন সান্ত¡Íনা বাক্য শিশুটির মনকে শান্ত ও আশ্বস্ত করতে পারে না। অনেক সময় শিশুটি স্কুলে যেতে অনিহা প্রকাশ করে। অবশ্য স্কুলে যাবার এ অনীহার অন্য কারণও থাকতে পারে। যেমন শিক্ষকের রূঢ় আচরণ অথবা ক্লাসে কোন উগ্র শিশুর উপস্থিতি ও আচরণ ইত্যাদি।
প্রাক-বিদ্যালয় প্রস্তুতি বহুলাংশে বাঁচাতে পারে এ আবেগাহত শিশুটিকে। এখানে মা-বাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্কুলে ভর্তির আগে অভিভাবকদের দেখে নিতে হবে, তাদের প্রতিবেশীদের কোন কোন সমবয়সী শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে এবং সে সমস্ত শিশুদের সঙ্গে নিজের শিশুটিকে পরিচিত করে তুলতে হবে। অভিভাবকদের তাদের একত্রে খেলার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আবার অন্যের শিশু নিজের মতো নয় এ জাতীয় ভাবনা না থাকাই ভাল। এভাবে পরিচয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে নতুন অবস্থায় ক্লাসে এ শিশুগুলো নিজেদের আর সম্পূর্ণ অসহায় ভাববে না। কাঁদার প্রবণতা অতি স্বল্প সময়ে তিরোহিত হবে ও অপরিচিত পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।
তদুপরি শিক্ষকরা যদি শিশুদেরকে তাদের আন্তরিক ও মধুর ব্যবহারে আপন করে নেন তাহলে কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। দেখা গেছে, অনেক অভিভাবক আছেন, যারা দুরন্ত শিশুদের স্কুলের ভয় দেখিয়ে শান্ত করতে চান। ফলে শিশুদের মনে স্কুল সম্বন্ধে একটি ভীতির সৃষ্টি হয়। এ জাতীয় ভীতি সঞ্চার সম্পূর্ণ অনুচিত। এ অবস্থায় বিদ্যালয়ে শিক্ষককে ঘিরে এক অজানা আশঙ্কা শিশুটির মনকে সন্ত্রস্ত করে তোলে।
আরো কিছু শিক্ষণীয় বিষয় প্রাক-ভর্তি তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে ভাষা শিক্ষা। সে বিষয়ে মা-বাবার দায়িত্ব সমান। তিন-চার বছর বয়সের শিশুদের খেলাধূলা হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যম। পিতা-মাতা যত বেশী সম্ভব খেলাচ্ছলে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা শিশুদের সঙ্গে বলবেন ততই ভাল। বাড়ীর বাগানে গিয়ে ন্যাচার স্টাডি বা প্রকৃতি জ্ঞান, অর্থাৎ রকমারি ফুল-ফলের নাম শিশুদের শিখাবেন। মা-বাবা শিশুকে সামাজিক উৎসবগুলোতে অবশ্য নিয়ে যাবেন। তাতে তারা ঘরের বাইরে মেলামেশার সুযোগ পেয়ে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে সামাজিকতার ভাবনার জন্ম নিবে। ভাষা শিক্ষা বিদ্যালয়ে সাফল্যের ভিত্তি স্থাপন করে থাকে।
শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। তাই মা-বাবা এর সুযোগ নিয়ে শিশুটির সামনে কিছুটা সময় প্রতিদিন বই খোলা রেখে সশব্দে পড়াশোনা করবেন। দেখবেন শিশুটি তখন এগিয়ে আসবে। ছবির বই সামনে রেখে এটা কি, সেটা কি-অনুরূপ প্রশ্ন করে উত্তর বলে দিবেন এবং অবশ্যই তার কাছ থেকে উত্তর চাইবেন। দেখবেন আপনার শিশু মুখ খুলছে, উচ্ছ্বসিত হয়ে জবাব দিচ্ছে। আপনি তখন প্রশংসা করে তাকে আরো উৎসাহিত করবেন। শিশুটি যখন রাগ, হতাশা অথবা ক্ষুধা বা আনন্দ প্রকাশ করে মা-বাবা তোমার রাগ হয়েছে, তোমার ক্ষুধা পেয়েছে-এ জাতীয় সংবেদনশীল কথাবার্তা বলে তাদের ইমোশন্যাল ডেভেলপমেন্টের জন্য সাহায্য করতে পারেন। লক্ষ্য করা গেছে দু’বছর থেকে পাঁচ বছরের শিশু ২০০ থেকে ২০০০ শব্দ এভাবে শিখে নিতে পারে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অধিকাংশ অভিভাবক আজকাল শিশুদের যথাযথ প্রতিপালনে অসমর্থ হয়ে নিজেদের শিশুদের অভ্যাস, মনোভাব, ধারণা, বাসনা, প্রত্যাশা ও চালচলন লক্ষ্য করে নিজেরা প্রতিপালিত হচ্ছেন। প্রস্তুতি নিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে শিশুটি জীবনে সমষ্টি স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে ও ধীরে ধীরে স্কুলের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়বে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তখন সদ্য-আগত শিশুদের আশা, প্রত্যাশা, অনুরাগ ও আসক্তি সংবেদনশীল মন নিয়ে বুঝে নিতে হবে। শিশুদের প্রতি রুক্ষ ব্যবহার বা রক্তচক্ষু না দেখিয়ে তাদের রসহাস্য ব্যবহার করতে হবে। তা হলে তারা বিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশে অভ্যস্থ হয়ে উঠবে।
অধিকাংশ অভিভাবকদের ধারণা তাদের শিশুরা মিথ্যা বলে না। প্রকৃত পক্ষে তারা শিশুদের সারল্যকে সত্যকথন বলে ভূল করেন। তাদের মিথ্যা বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বিদ্যালয়ে যখন শিশুরা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। হয়তো শিশুটি নিজে ঝগড়ার সূত্রপাত করেছে কিন্তু যখন সে বুঝবে দোষ তার উপর চলে আসবে তখন সে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে উপস্থিত হয় এবং নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে প্রতিপন্ন করতে চায়। নিজেকে বাঁচাবার জন্য অনর্গল মিথ্যা বলতে থাকে। সে জানে তার আচরণ শিক্ষক অননুমোদিত, তাই সে নিজেকে বাঁচাবার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়। বাড়ীতে অনেক অভিভাবকদের কঠোর শাসন থেকে আত্মরক্ষার খাতিরে বা আত্মঅবমাননা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তারা মিথ্যা বলতে দ্বিধাবোধ করে না। লক্ষ্য করা গেছে, অভিভাবক যত বেশী কঠোর তাদের শিশুরা তত বেশী মিথ্যাচারী। শিশুদের এ প্রবণতা থেকে উদ্ধার করতে হলে অভিভাবক রূঢ় ব্যবহার পরিহার করে সংবেদনশীল মন নিয়ে শিশুদের সমস্যা ও প্রত্যাশা সম্বন্ধে অবহিত হবেন ও ধৈর্য সহকারে তাদের বুঝিয়ে তাদের মিথ্যা বলার প্রবণতাকে খর্ব করবেন। মনে রাখবেন, অপমান এবং বিব্রতবোধ ব্যাপারে শিশুমন ভীষণ সচেতন। অভিভাবক শাসন করবেন কিন্তু সেটি যেন দ-দাতার প্রবল অত্যাচার না হয়।
বলতে দ্বিধা নেই, প্রায় সব শিশু কোন না কোন সময় চুরি করে থাকে। তবে চুরি করা কি তা না জেনে তারা সেটি করে। তারা ভাবে-তাদের পছন্দের জিনিসটি নেয়ার অনুমতি চাইলে তা সে হয়ত পাবে না। পাঁচ বছর বয়সের আগে শিশুরা একত্রে মিলেমিশে খেলে না। খেলতে শুরু করলে অন্য শিশুটির হাতে আকর্ষণীয় কোন খেলনা থাকলে সেটি তোলে নেয়ার প্রবল বাসনা শিশুটিকে পেয়ে বসে এবং সুযোগ বুঝে হাতে তুলে নেয়। এ জাতীয় প্রবণতা থেকে শিশুটিকে রক্ষা করতে অভিভাবককে স্পষ্ট ভাষায় তাকে বুঝাতে হবে কাউকে না বলে অন্যের জিনিষ গোপনে আনা গুরুতর অন্যায়। সঙ্গে সঙ্গে তুলে আনা জিনিষটিকে ফেরৎ দিয়ে আসতে হবে এবং অনুরূপ জিনিষ শিশুটির হাতে দিয়ে তাকে আশ্বস্থ করতে হবে। Elezabeth Bowen বলেছেন There is no end to the violation committed by children on children quietly talking aloneÕ|
ভাল করে লক্ষ্য করে দেখবেন তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে। কখনো কখনো প্রতিশোধ-স্পৃহা তাদের উন্মুক্ত করে তোলে। প্রচ-ভাবে সামান্য প্ররোচনায় অস্থির হয়ে অন্যকে, স্কুলে সহপাঠীকে বুট দিয়ে আঘাত করে, কখনো চিৎকার করে নখ দিয়ে আঘাত করতে থাকে। শিশুদের স্বভাব অনেকটা বিড়ালের মত হিংস্র। ক্লাসে শান্ত হয়ে বসতে চায় না, কোন কিছু মনোযোগ দিয়ে শুনতে চায় না। ইতস্তত দৌঁড়াদৌড়ি করে, জানালার রড ধরে অনবরত উঠানামা করে, অনবরত কথা বলে এবং সুযোগ পেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়-যা স্বভাবত অভিভাবকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকে। এ অস্বাভাবিকতা অবদমিত করা বিশেষ জরুরী কেননা, এটি অভ্যাসে পরিণত হলে তা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়সে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই বলে এ কচিকাঁচা শিশুদের শারীরিক শাস্তি বিধেয় নয়। এতে উল্টো ফল হবে। শিশু একঘেয়ে হয়ে যাবে এবং যদি সে শাস্তি-ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে তাহলে সে একটি ‘অহমৎু পযরষফ’ হয়ে দাঁড়াবে।
বর্তমানে শারীরিক শান্তি সম্পূর্ণভাবে বেআইনী। দেখবেন কিছু সংখ্যক আলোচ্য বয়সের শিশু মা-বাবাকে বিশেষ করে মা-কে রাগ হলে অথবা অভিমানাহত হলে মারতে থাকে। এ ব্যবহার তাদের অনুকরণপ্রিয় এবং শিখেছে অন্যের কাছ থেকে। অনেক সময় শিশুদের মধ্যে ঔদ্ধত্যের জন্ম নেয় অসুস্থ পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেও। মনে রাখতে হবে ‘ঠরড়ষবহ নবমবঃং ারড়ষবহপব’ এমতাবস্থায় মা-বাবাকে শিশুটির সঙ্গে সংবেদনশীল কথাবার্তায় লিপ্ত হতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্কের দৃষ্টিভঙ্গি শিশুর ওপর চাপিয়ে দিলে চলবে না। পরিবারের সদস্য হিসেবে তার অধিকার আছে। সে অধিকার পদদলিত করলে চলবে না। সীমানা নির্ধারণ করলেও তার আবদার ও আবেগকে সম্মান দিতে হবে। দেখবেন তখন শিশুটির অনেক ঔদ্ধত্য কমে গেছে। শিশুটির মানসিক স্বাস্থ্যের সজীবতার যোগান দেয়ার জন্য নিম্নলিখিত টিপস লক্ষণীয়।
শিশুটিকে পারিবারিক কলহ-বিবাদ থেকে দূরে রাখতে হবে। টেলিভিশনের হিংস্র দৃশ্যগুলো যাতে শিশুরা অনুকরণ না করে সেদিকে অভিভাবককে সতর্ক থাকতে হবে। শিক্ষাদানের নামে স্কুলে শিশুর ওপর শিক্ষকদের অত্যাচার করা চলবে না। স্কুলে যাবার সময় মা শিশুদের পেট ভরে খেতে দিবেন। দেখা গেছে যে, শিশু ঠিকমতো আহার করে স্কুলে যায় সে স্কুলে খোশমেজাজে থাকে, মনোযোগী হয়, শেখে ভাল এবং তার অস্থিরতা পরিশীলিত হয়। শিশুরা আদরের প্রত্যাশী। ভালবাসা, আদর ও ক্রমাগত মোটিভেশনই পারে তাদের চিত্ত জয় করতে। মনে রাখতে হবে-‘অ পযরষফ রং হড়ঃ ধ াধংব ঃড় নব ভরষষবফ নঁঃ ধ ভরৎব ঃড় নব ষরঃ’।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।