সিলেটের ডাক ও প্রিন্ট মিডিয়ার হালহকিকত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জুলাই ২০২৩, ৩:২৩:১৬ অপরাহ্ন
রতীশচন্দ্র দাস তালুকদার
একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই যখন ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যমের প্রসার ও প্রচার অপ্রতিরোধ্যগতিতে বাড়তে থাকে, তখন অনেকেই ভাবতে থাকেন, অচিরেই বোধ হয় মুদ্রণ মাধ্যমের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে। তবে সবার মুখে ছাই দিয়ে এখনও মুদ্রণ মাধ্যম বহাল তবিয়তে টিকে আছে। ভবিষ্যতে কী হবে, তা অবশ্য ভবিষ্যৎই বলতে পারে, কিন্তু এখনও জেলা-উপজেলা পর্যায়েও নতুন নতুন পত্রপত্রিকা বের হচ্ছে। অবশ্য যুগের সাথে তাল মিলাতে না পেরে কিছু কিছু মুদ্রণ মাধ্যম হারিয়েও গেছে। এ ধরনের অবস্থা কিন্তু সব সময়ই ঘটেছে।
বর্তমানেও আমরা সকালবেলা ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আয়েশ করে পত্রিকায় চোখ বুলাই, দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন খবর আদ্যোপান্ত পড়তে পছন্দ করি। টেলিভিশনের কল্যাণে অনেক খবর পূর্বাহ্নে জানা থাকলেও খবরের আনুপূর্বিক বর্ণনা একমাত্র দৈনিক পত্রিকাতেই পাই।
ইলেকট্রনিক সম্প্রচার মাধ্যমে ‘টকশো’ নামক একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় যাতে বিভিন্ন সংবাদের কিছু বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তবে ইদানীং বিপরীত মতাদর্শী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে এগুলো অনাকাক্সিক্ষত বিতর্কস্থলে পরিণত হয়েছে ফলে এসব অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
এখনও প্রিন্ট মিডিয়াতেই বিচিত্রধর্মী খবরের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ ও বর্ণনা আমার মত অনেককেই আকর্ষণ করে। তাই আমি বিশ্বাস করি অদূর ভবিষ্যতেও এ মাধ্যমের প্রয়ান ঘটবে না, অন্তত আমাদের মত একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অনুরাগ এ মাধ্যমের প্রতি বহাল থাকবে। অবশ্য অন্যতম প্রধান, রক্ত সঞ্চালনকারী বিজ্ঞাপন জগতে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভাগ বসানোর ফলে এ মাধ্যমের স্বাভাবিক গতিধারা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে, তাই প্রায় সব প্রিন্ট মিডিয়াই বর্তমানে অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করছে।
এমন বৈরী পরিবেশে আমরা আনন্দের সাথে লক্ষ্য করছি ‘দৈনিক সিলেটের ডাক’ চল্লিশ বছরে পদার্পণ করছে। শৈশব ও কৈশোর কাল পেরিয়ে পত্রিকাটি মধ্য যৌবনে উপনীত। এটা অবশ্যই মফস্বলের একটি প্রচার মাধ্যমের জন্য শ্লাঘার বিষয়।
সিলেট অঞ্চলে প্রচার সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ স্থানে আছে পত্রিকাটি। সুখের বিষয়, অনেক কাল যাবৎই এ অবস্থান ধরে রেখেছে। অনেক পত্রিকাকে টপকে এ অবস্থান বজায় রাখা নিঃসন্দেহে সংবাদ পরিবেশনে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই সম্ভব হয়েছে।
ইতিমধ্যে এ পত্রিকাটি অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিও মোকাবেলা করেছে, কিন্তু সব ঘাতপ্রতিঘাত ও বাধাবিঘœ অতিক্রম করে মাধ্যমটি আজ তার উজ্জ্বল উপস্থিতিরই জানান দিচ্ছে। সমাজে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ বাস করে সুতরাং কোন প্রচার মাধ্যমের পাঠক বা দর্শক ও ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শী হওয়াই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে কোন সম্প্রচার মাধ্যম যদি সংবাদ পরিবেশনে বিশেষ মতাদর্শকে প্রাধান্য দেয় তবে সে মাধ্যমটি বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলে। এসব মিডিয়া কোনভাবেই খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। আবার একটি প্রচার মিডিয়ার নিরপেক্ষতা অনেকাংশেই মালিকপক্ষের ভূমিকার উপরও নির্ভর করে। মালিক পক্ষ যদি তাদের মতাদর্শ প্রচারের বা তাদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের বাহনরূপে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হন, তবে সেই প্রচার মাধ্যমটির পাঠক প্রিয়তা বা দর্শক প্রিয়তায় ধস নামতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে ঐ সম্প্রচার মিডিয়ার অকাল পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটাই স্বাভাবিক। আবার হলুদ সাংবাদিক বলে নেতিবাচক কিছু কথাও কোন কোন প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে শুনা যায়। এসব অপসংস্কৃতি যে প্রচার মাধ্যম চর্চা করে সে মাধ্যমটি অচিরেই পাঠক ও দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের বৈরী আচরণ, সংবাদ প্রচারে সেনসরশীপ আরোপ বা স্বাধীন সাংবাদিকতা পরিপন্থী বিধি বিধান প্রণয়ন সম্প্রচার মিডিয়ার নিকট অশনি সংকেত রূপেও দেখা দেয়। ইদানীং সেল্ফ সেনসরশীপ বলেও একটি কথা শুনা যায় যা কোন কোন সাংবাদিক চর্চা করেন। এটা কিন্তু কোনভাবেই সুস্থ সাংবাদিকতার উদাহরণ হতে পারে না।
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও সমাজচিন্তক অমর্ত্য সেন এক জায়গায় বলেছেন ‘যে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে কখনও দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের মর্মার্থ অনুধাবন করা খুবই সহজ এবং এর সাথে দ্বিমত পোষণ করারও কোন অবকাশ নেই।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। ১৩৫০ বাংলা ইংরেজি ১৯৪৩ সালে এ উপমহাদেশে চরম দুর্ভিক্ষ হানা দেয়। এ দুর্ভিক্ষ ছিল সম্পূর্ণ মনুষ্যসৃষ্ট। সারা বিশ্ব তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ডামাডোলে কম্পমান, এমনকি ভারত-বার্মা সীমান্ত পর্যন্ত এ মহাযুদ্ধের বিস্তার ঘটেছিল। এ উপমহাদেশ সে সময় ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বিষাক্ত থাবায় নিষ্পেষিত। ইংরেজ সা¤্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠী তখন সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্যশস্য মওজুদ করে দেশে কৃত্রিম খাদ্য সংকটের সৃষ্টি করে। ফলে গ্রাম থেকে লাখে লাখে মানুষ খাদ্যের খোঁজে নিকটবর্তী শহর-বন্দরে ভিড় জমাতে থাকে, কিন্তু খাদ্যের অভাবে অনাহারে-অর্ধাহারে অসংখ্য মানুষ শহরের রাস্তাঘাটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ মহাদুর্ভিক্ষে প্রায় সাতাশ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তখন সংবাদপত্রের প্রচার ছিল খুবই সীমাবদ্ধ এবং বিবেকহীন সরকার প্রচার মাধ্যমের উপর সেন্সরশীপও আরোপ করেছিল। এমনি বাস্তবতায় নিষ্ঠুর ইংরেজ সা¤্রাজ্যবাদীরা কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণসংহার ঘটায়। বর্তমান সময়েও কিছু স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী অবাধ তথ্য প্রবাহ অবরুদ্ধ করে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে দেশকে বহির্বিশ্ব থেকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে দেশের ভিতরে চরম নৃশংসতায় জাতিগত নিধন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে এদের নৃশংস ও পাশবিক আচরণের তথ্যচিত্র কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত হয়েছে। বিশ্ববিবেক আজ এ ঘৃণিত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও উচ্চকন্ঠ হলেও কিছু বিশ্বমোড়লের আস্কারায় এরা অবাধে এ হৃদয়হীন আচরণ চালিয়েই যাচ্ছে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এ স্বৈরাচারী গোষ্ঠীর সাথে এমন একজন জড়িয়ে আছেন যাকে বিশ্ববাসী একসময় গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে ভাবতো এবং যাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়েছিল। শুধু এ একটি দেশই নয়, বিশ্বের আরও অনেক দেশেই এ ধরনের মানবতার বিরুদ্ধে বর্বর ও হৃদয়হীন আচরণ ঘটেই চলেছে, এসব স্বৈরশাসক বিশ্ব মিডিয়ায় তাদের নিয়ে কী প্রচার হলো তা নিয়ে থোড়াই পরোয়া করে।
দৈনিক সিলেটের ডাক আজ চল্লিশ বছরে পা দিতে যাচ্ছে। এতে এ পত্রিকার পাঠক ও অনুরাগী হিসেবে আমরা আনন্দিত ও আপ্লুত। সিলেটের মত মফস্বল শহরে একটি পত্রিকার এতদিন যাবৎ সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ও গৌরব গাঁথাকে বুকে ধারণ করে প্রচার অব্যাহত রাখা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এ জন্য পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আমাদের অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। প্রত্যাশা করি, অনেককাল যাবৎ সাধারণ মানুষের নির্ভীক কন্ঠ হিসেবে পত্রিকাটির গতিধারা নিরঙ্কুশ থাকবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, এমসি কলেজ সিলেট।