রাজনৈতিক ময়দানে কূটনৈতিক যুদ্ধ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জুলাই ২০২৩, ৬:১৭:২২ অপরাহ্ন
![রাজনৈতিক ময়দানে কূটনৈতিক যুদ্ধ রাজনৈতিক ময়দানে কূটনৈতিক যুদ্ধ](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2023/06/dak-po-sompadoki-300x191-1-150x150-1.jpg)
শেখর ভট্টাচার্য
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রে থাকেন জনগণ। এটি নুতন কোন কথা নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুঃখজনক হলেও সত্য সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় জনগণকে অনেকটা নীরবতার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। জনগণ বিযুক্ত হয়ে অগণতান্ত্রিক অনেক শক্তি রাজনীতির অংশীজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনমতকে উপেক্ষা করার রাজনীতি কোনভাবেই গণতন্ত্রকে টেঁকসই করে তুলতে পারেনা। বাংলাদেশের রাজনীতি এই মুহুর্তে আবর্তিত হচ্ছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচন যতোই এগিয়ে আসছে, রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং বিশ্বশক্তির তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচনে যতগুলো অংশীজন রয়েছে এর মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন ভোটার বা জনগণ । গণপ্রজাতন্ত্রে নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাররাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় কোন রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের দৃষ্টিতে উপযুক্ত। সারা বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো সারা বছর ভোটাদের মন জয় করার জন্য তাদের পিছনে ছোটে থাকেন। উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো হাতে নেয়া হয়ে থাকে জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে। যে সমস্ত দেশে ভোটারকে উপেক্ষা করে বৃহৎ শক্তির সহানুভূতি কামনা করা হয় সে সমস্ত দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে ভঙ্গুর ও অপুষ্ঠ হয়ে পড়ে এ কথাটি বলার প্রয়োজন পড়েনা।
প্রতিটি নির্বাচনের মতো আগামী ডিসেম্বর, জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের পেছনে না ছোটে, ছোটছে ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর ঢাকাস্থ দূতাবাস গুলোতে। অনেকেই সে সব দেশের প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের, ওই দেশের সরকারের মতামত তাদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য লোবিষ্ট নিয়োগ দিচ্ছেন।আমাদের একান্ত অভ্যন্তরীন বিষয়ে প্রভাবশালী দেশ গুলোকে নাক গলাতে আমরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি তা’ নিকট কিংবা অদূর ভবিষ্যতের জন্য কতো বড় বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে, তা’ কী আমাদের নাগরিক সমাজ কিংবা রাজনৈতিক দল গুলো বুঝতে পারছেন না? তাঁরা বুঝতে পারছেন না এ কথাটি শুভ শক্তি সম্পন্ন মানুষেদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বিভিন্ন সাক্ষাতকারে বলে থাকেন ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য কিংবা, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের উদেশ্যে
বিশ্বের যে কোন দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে তারা প্রস্তুত। কী অদ্ভুত, দায়িত্বহীন বক্তব্য। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো মনে হয়।
বাংলাদশের স্বাধীনতার বয়স বায়ান্ন থকে তিপ্পানর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সময় জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতির পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয় শক্তিদের নির্বাচন ব্যবস্থায় যুক্ত করা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চীন, রাশিয়া, যুক্ত্ররাষ্ট্রের সরব কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করে সচেতন জনগণের লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আছে। মাত্র কয়েকদিন পূর্বে ৬ জুলাই এক টুইট বার্তায় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘কিছু ইউরোপীয় ও মার্কিন রাজনীতিবিদেরা বাংলাদেশে ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে চিঠি প্রকাশ করেছেন বলে আমরা জেনেছি। এটা নব্য-উপনিবেশবাদ এবং সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের আরও একটি অপচেষ্টা।’ রুশ দূতাবাসের ওই বিবৃতি প্রকাশের পরদিন পাল্টা অবস্থান প্রকাশ করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। এক টুইটে মার্কিন দূতাবাস ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে আনে। মার্কিন দূতাবাসের টুইট বার্তায় বলা হয়, ‘ইউক্রেনের ক্ষেত্রে কি এই নীতি মানা হয়েছে?’ কী আশ্চর্য, ঢাকার মাঠে রুশ-মার্কিন কূটনৈতিক যুদ্ধ।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের টুইটের আগে একই দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ইভান স্টিফেনেককে একটি চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে অর্থবহ সংলাপের তাগিদ দেন। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর একে অন্যের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানানোর বিষয়টি এবারই প্রথম নয়। রাশিয়ার সর্বশেষ মন্তব্যের মাসখানেক আগে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে চীন। গত মাসে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশের বিশেষায়িত নিরাপত্তা বাহিনী র্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকে সমর্থন করে চীন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও অখ-তা রক্ষায় চীন সব সময় সমর্থন দেবে।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের জনগণই যথেষ্ট। যে দেশের জনগণ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সকল মিত্র, চীনের মত দেশের সমর্থন পুষ্ট শক্তিধর পাকিস্তানী বাহিনীর পচানব্বই হাজার সেনাকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করাতে বাধ্য করতে পারে সে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বৃহৎ শক্তিধর কোন দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে বলে এদেশের মানুষ মনে করেনা। এই যে রাশিয়া, চীন, যক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এই সর্বনাশা খেলার জন্য দায় নিতে হবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বৃহৎশক্তি এবং প্রতিবেশী দেশ সমূহের পরোক্ষ হস্তক্ষেপের জন্য আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কোন দায় নেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রভাবশালী দেশ সমূহকে আমন্ত্রণ না জানালে এই অযাচিত আলোচনা ও সহায়তার প্রশ্ন আসতো বলে আমারা মনে করিনা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর দুই দিনের বাংলাদেশ সফরের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সফর কালীন সময় এবং এর পরে ঢাকায় সরকারী দল এবং বিরোধী দল সমুহের মধ্যে আলোচনার ঝড় ওঠে। সে ঝড় তাদের সফর শেষ হওয়ার পরও অব্যাহত আছে এবং অনুমান করা যায়, আগামী কিছুদিন তা চলবে। তাদের সফরকে কেন্দ্র করে এরকম মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, আমাদের দন্ডমুন্ডের কর্তারা হাজির, তাদের নির্দেশনাই স্থির করবে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনের ভবিষ্যত। বিদেশীদের আমন্ত্রণ করে দন্ডমুন্ডের কর্তা সাজানোর এই ন্যাক্কারজনক খেলা আমাদের দেশের রাজনইতিক দল এবং রাজনীতি চর্চার দেউলিয়াত্ত্বর বহিপ্রকাশ ছাড়া কিছুই বলা যাবেনা। রাজনীতির লক্ষ্য যদি হয় নিরাপদের ক্ষ্মতার স্বাদ আস্বাদন তাহলে আমাদের দেশের রাজনীতির মাঠে এরকম ভাবে আরও দীর্ঘ কাল বিদেশী কুশীলবদের নৃত্য আমারা দেখতে পাবো বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পূর্ণ নির্বাচন কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। আর এই নির্বাচনী মাঠে জনগণের অংশ গ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে ক্রমাগত। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যদি জন অংশগ্রহণকে উৎসাহিত না করা যায়, নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকে উঠে আসা কর্মীদের স্থান দেয়া না হয়, তাহলে নিবাচন প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশ গ্রহণ কিভাবে আমরা প্রত্যাশা করত পারি। রাজনৈতিক দল গুলোর নেতৃত্বে যদি ব্যবসায়ী, সামরিক, বেসামরিক আমলারা থাকেন তাহলে গণমুখী রাজনীতির বিকাশ কোন দিনই সম্ভব নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল গুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করে গণমুখী করে তোলা, প্রান্তিক মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া নীরবতার সংস্কৃতি ভংগের জন্য কাজ করতে বলা চলমান রাজনৈতিক গতি প্রবাহের বাইরে গিয়ে প্রলাপ বকার সমতুল্য। সারা দেশ জুড়ে রাজনৈতিক আলোচনার মূল বিষয় হলো, নির্বাচন ব্যবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য আদর্শগত কোন মতভেদ আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। ক্ষমতার মসনদে আরোহন করার উপায় যে দেশে রাজনীতির মাঠের সব চেয়ে বড় এজেন্ডা, সে দেশে আদর্শ ভত্তিক রাজনীতির কথা বলতে পারে বোকা, পাগল কিংবা অর্বাচীন শিশুর দল। প্রিয় পাঠক ভেবে দেখুন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে টেনে কতো নিচে নামিয়েছি আমরা সকলে মিলে।
আমাদের এই বাংলাদেশে জন-অংশগ্রহণ মূলক রাজনীতির গৌরবময় ঐতিহ্য আছে। ১৯৬৫ সালে যখন সম্মিলিত বিরোধী দলের সম্মেলনে ৬ দফাকে অগ্রাহ্য করে দেয়া হলো তখন বঙ্গবন্ধু ছুটেছিলেন জনতার কাছে, ছুটে বেড়িয়েছিলেন বাংলার মাঠে, প্রান্তরে। এই সময় তিনি প্রায় প্রতিটি জেলায় জনগণের সামনে ৬ দফা তুলে ধরেছিলেন। বাঙালির ম্যাগনাকার্টা ৬ দফা নিয়ে বিদেশী দূতাবাস কিংবা বিদেশী কোন সরকারের কাছে ধর্ণা দিতে যেতে হয়নি তার। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস রেখেছিলেন জনশক্তির ওপর। সেই শক্তির প্রতি বিশ্বাস আমাদেরকে এনে দিয়েছিলো ৬ দফার পথ বেয়ে হাজার বছরের স্বপ্নের স্বাধীনতাকে। গণভিত্তিক রাজনীতির পাঠ নেয়ার জন্য আমাদেরকে কাঙালের মতো ছুটতে হবেনা কোথাও উদাহরণ আমাদের দেশেই আছে। রাজনীতি, নির্বাচনের দেউলিয়াপনাত্ব ঘোছাতে হলে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে আমাদের নাগরিকদের ওপর। রাজনীতির খোল-নলচের পরিবর্তন করতে হলে রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে নুন্যতম শর্তে ঐক্যের প্রয়োজন। আমরা চাইনা ক্ষমতার পটপরিবর্তনের জন্য ইসরায়েলের নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির মতো মানুষের সমর্থন ও ষড়যন্ত্র। রাজনীতি কে আমরা ফিরিয়ে দেই আমাদের নাগরিকদের হাতে, আজনীতির ড্রাইভিং সিটে আমরা দেখতে চাই প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব।
লেখক : প্রাবন্ধিক।