একাত্তরের সহযাত্রীরা হাতে মিলাও হাত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুলাই ২০২৩, ১২:৫৮:২৯ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
ভদ্রলোক কোন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন। সরকারি অফিসের চাকুরে। তারপরও তিনি আমার স্যার। স্যার বলেই সম্বোধন করি। তিনি আমার পুত্র-কন্যাসহ অনেককেই প্রাইভেট পড়ান। এক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট সুনামও রয়েছে। আরো উল্লেখ্য যে, পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখার একজন নিয়মিত পাঠকও তিনি। আমার এবং আমার পরিবারের একজন আপনজনও তিনি।
ক’দিন আগে রাস্তায় হাঁটছি; দেখা হলো। কিন্তু একি হলো। আমাকে দেখেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। কারণ কিছুই নয়। আমার লেখালেখি নিয়ে তার যত কথা। উত্তেজনা। আপত্তি। এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগলেন- ‘আর কতো চাটুকারী, কতো তেলমালিশ, শেখ হাসিনার বন্দনা করে আপনারা আর কি পেতে চান? মুক্তিযোদ্ধার ভাতা আরো বাড়াতে চান? আপনার লেখা আর পড়তে ইচ্ছে করে না। ঘেন্না করি। ঘেন্না করি।’ আমার স্যার ভদ্রলোকের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে সবকিছু শুনলাম। তাৎক্ষণিকভাবে কোন উত্তর দিতে চাই নি। তার শারীরিক ভাষার মধ্যে কিছু বলার সুযোগই পাইনি। অনেকটা ভয়ই পেয়েছিলাম। এ যেন এক বিনা মেঘে বজ্রপাত।
ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম স্যার একি বললেন? এ কি শুধুই সত্যি সত্যি স্যারের মনের কথা? নাকি আরো কেউ কেউ এমনটি ভাবেন। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি- কোথায় দোষটা আমার? উত্তর পাইনি। তবে এটাও জানি যে ব্যক্তিপূজা কোন ভালো কাজ নয়। তা কখনো কাম্য হতে পারে না। কিন্তু এটাতো সত্যি যে, ব্যক্তিকে ঘিরেইতো দেশ-সমাজ-জাতি-সরকার-রাষ্ট্র-অর্থনীতি-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি। আর ব্যক্তির সুকর্ম যখন প্রতিষ্ঠানের আকার ধারণ করে তখনতো কোন ব্যক্তি আর ব্যক্তিগত সীমানায় আবদ্ধ থাকেন না। হয়ে ওঠে সত্যিকার অর্থেই এক আশা জাগানিয়া প্রতিষ্ঠান। যেমনটি হয়ে উঠেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ। লাখো মুক্তিযোদ্ধা, লাখো শহীদের প্রাণ বাঙালির কাঙ্খিত সোনার বাংলা, আজকের বাংলাদেশ। তারপরের ইতিহাস তো কারো অজানা থাকার কথা নয়। এলো কলঙ্কিত ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আর রেহানা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য কেউই খুনীদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। হাসিনা রেহানার কি দুর্ভাগ্য, বিদেশের নির্বাসিত জীবনকেই আলিঙ্গন করলো। পিতার সাধের বাংলাদেশে তাদের ঠাঁই হলো না। পচাত্তরের পর হাসিনা বিহীন বাংলাদেশের অবস্থা কেমন ছিলো আমার শ্রদ্ধেয় সেই স্যারের অজানা থাকার তো কথা নয়। হরেক নামের জঙ্গিবাহিনী তথা বাংলা ভাই সহ অনেক ভাইয়ের স্মৃতি তো এতো সহজে ভুলে যাবার কথা নয়।
তারপর শেখ হাসিনা ফিরে এলেন। কিছু দিন পর রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিলেন। দেশ এগিয়ে যাওয়া শুরু হলো। অশান্ত চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি হলো। শান্তি ফিরে এলো। বিদ্যুতে আলোকিত হলো সারা বাংলাদেশ। পদ্মাসেতু উত্তর বঙ্গের চেহারা বদলাতে শুরু করলো। মেট্রোরেল দেখলো ঢাকাবাসী। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারকার্য সম্পন্ন হলো। যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন স্তব্ধ হলো। বিশ্ববাসী চেয়ে চেয়ে দেখলো। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে নতুন করে নাকি ভেবে দেখতে অনুরোধও করেছিলো। শেখ হাসিনা কী তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে একটুওতো সরে দাঁড়ালেন? শক্ত হাতে হাল ধরলেন। কারো রক্তচক্ষুর পরোয়া তিনি করলেন কি? করেননি। বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে কেউ যদি এই বাস্তব সত্যগুলোকে কোনোভাবে, কোনো পরিস্থিতিতে স্বীকার করেই থাকেন তাহলে সেটাকে কি চাটুকারিতা বলে ধরে নেয়া যায়? ধরে নিলে আর যা-ই হোক না কেন, তা সুবিচার নয়। সবার কাছে সবাই তো সুবিচারই প্রত্যাশা করে। এ নিয়ে কারণে অকারণে পানি ঘোলা করা যাদের সহজাত অভ্যাস তারা সমাজের জন্য কতোটুকু উপকারী সেটাও একটা বিবেচ্য বিষয়।
যাক গে সে কথা। এবার আসা যাক আবু সাঈদ চাঁদ এর প্রসঙ্গে। কে এই বিতর্কিত চাঁদ সেটি বোধ হয় কারো অজানা থাকার কথা নয়। দেশের জনমনে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আজ দেখা দিয়েছে- এই চাঁদ কেন প্রকাশ্য জনসভায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কবরে পাঠানোর হুমকি দিলো? দেশে বিদেশে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে কতোই না মায়াকান্না দেখানো হচ্ছে, কিন্তু এই কি গণতন্ত্রের ভাষা? কথায় বলে সংযত জিহ্বা গণতন্ত্রের পরম মিত্র। অসংযত জিহ্বা গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু। এই শত্রুরা যদি গণতন্ত্রের মিত্র হতে চায় তাহলে গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় একটু পরিবর্তন কি আনতে হয় না। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করলো তারা কিন্তু এর আগে হত্যার হুমকি দেয়নি। গোপনেই এই কুকর্মটি করেছে। অথচ আজ প্রকাশ্য জনসভায় প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এই তফাৎটা কিন্তু বুঝতে হবে। একবার দু’বার নয়। বিশবার তো তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয়। কই, এ দেশে তো তারমতো অন্য কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে এমনিভাবে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়নি। হাসিনার প্রতি এমন আক্রোশ কেন। কারণটা বোধ হয় এই যে, শেখ হাসিনার শিরায় শিরায় বঙ্গবন্ধুর রক্তের ¯্রােত বইছে। এ ¯্রােতধারা মানেই তো বাংলাদেশ। এ ¯্রােতধারা বন্ধ করতে পারলেই জয় বাংলার দুর্দিন। খুনীদের সাধের জিন্দাবাদ উল্লাসে মেতে উঠবে। যেমনটি করেছিলো ৭৫ এর ১৫ই আগস্টে।
এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যার হুমকি দিল, প্রতিবাদ জানালো আ’লীগ, তার অঙ্গ সংগঠনগুলো। ডান-বাম-মধ্য সবারই তো বাকরুদ্ধ। দোষেগুণেই তো মানুষ। শেখ হাসিনা তো এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। তাঁকে বিনা বিচারে কবরে পাঠাবার আস্ফালন কোন গণতন্ত্র? কোন সমাজতন্ত্র বা মানবাধিকার? কোন তন্ত্র মন্ত্রইতো হত্যাকা-কে সমর্থন করার কথা নয়। তবে কেন এ নীরবতা। দেশের তথাকথিত সুশীল বাবু-সাহেবরাই বা কেন ঘুমে অচেতন। সময়-সুযোগ এলেই তো তারা কখনো কখনো বড়োই সচেতন। পূব ছেড়ে পশ্চিমা মানবতন্ত্রের ঝা-া হাতে তারা ভীষণ সরব। মসনদের হাতছানি দেখতে পায় শুনতে পায়। হায়রে, সিংহাসনের কতোই না খায়েস। তবে এই দুঃখজনক নীরবতা কারো জন্যই শুভ নয়। বলতে গেলে এ এক অশনিসংকেত।
তবে যারা হত্যার হুমকি দেয়, যারা গোপনে গোপনে হুমকিদাতা তারা তো প্রকৃতিগতভাবেই নীরবতা অবলম্বন করবেই; তাদের জন্য এটা দূষণীয় নয়। কিন্তু যারা একাত্তরে একই পথের পথিক ছিলেন তাদের নীরবতা কখনো কাম্য নয়। হতে পারে পথের বদল কিন্তু গন্তব্যস্থল তো একই। একই পথের পথিক তো সহযাত্রী। যাত্রাপথে একে অন্যের ব্যথা-বেদনা অনুভব করা উভয়ের জন্যেই নিরাপদ। এর ভিন্নতা হলেই আপদ বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। উভয়েরই ক্ষতির কারণ। তাই চলার পথে দাম্ভিকতার কোন স্থান নেই। একে অন্যের পরিপূরক হয়েই চলতে হয়। ব্যক্তিগত বা দলগতভাবে ছোটবড় ভাবনা উভয়কেই দুর্বল করে দেয়। হত্যাকারীরা হয় সংঘবদ্ধ। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণতো একাত্তর থেকে দু’হাজার তেইশ এর বাংলাদেশ। একাত্তরের সহযাত্রীদের বিভেদের কারণেই আবু সাঈদ চাঁদের দল এতো দুঃসাহস দেখায়। কবরের ভয় দেখায় সময়ে সময়ে। আর বিভেদের কারণে একাত্তরের সহযাত্রীরা এগিয়ে আসে না সহযাত্রীর দুঃসময়ে। তাইতো দেখি একাত্তরের সহযাত্রীদের চলার পথে ভাঙ্গনের সুর। ঐক্যে ফাটল। এর দায় কার তা ভেবে দেখার এখনই সময়। তবে এক্ষেত্রে বড়দের দায় দায়িত্বই বেশি। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি প্রদানকারী এক ‘চাঁদ’ পুলিশের হাতে বন্দী হলেও বাংলার আকাশে আরো আরো চাঁদেরা নানা ফন্দির আশ্রয় নেবেই।
তাইতো বলি- যাত্রীরা হুশিয়ার। আবারো হাতে মিলাও হাত। শুনিতে কি পাওনা একাত্তরের সেই গগণবিদারী ডাক- জয় বাংলা।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।