বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম : সুসংবাদ নয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ আগস্ট ২০২৩, ১:২৪:৩৮ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
আজকাল বিশ্বজুড়ে বিশ্ব মা দিবস বেশ ঘটা করেই পালিত হওয়া শুরু হয়েছে। মা দিবসের পর সবার বিশ্ব বাবা দিবস পালন শুরু হয়ে গেছে। বাবা দিবস নিয়ে ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ‘সকল বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন জনকন্ঠ পত্রিকায় (১৮.৬.২০২৩)। এতে বাবা দিবস নিয়ে তিনি দু’টি গল্পের অবতারণা করেছেন। গল্প দু’টিই আমেরিকার। অর্থাৎ বাবা দিবসের বা মা দিবসের ধারণা প্রথম আসে আমেরিকার ব্যক্তির মাথা থেকেই।
প্রথম গল্পটি হলো, ডড নামের এক মার্কিন মহিলার মাথায় প্রথম পিতৃ দিবসের ধারণাটি আসে। ডড তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি ১৯শে জুন, ১৯১০ সাল থেকে বাবা দিবস পালন করতে থাকেন নিজ উদ্যোগে। দ্বিতীয় গল্পটি হলো, সোনোরা লুইস স্মার্ট নামে আর এক মহিলার মা ষষ্ঠ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা গেলে এই সকল সন্তানদেরকে খুবই যতœসহকারে তাদের বাবা বড় করে তুলেন। তখন বিশ্ব জুড়ে মা দিবস পালন করা হতো। ঐ মহিলার মাথায় তখন আসে বাবা দিবস পালনের চিন্তা। তারপর অনেক ঘটনার পর শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বাবা দিবস পালনকে আইনে পরিণত করেন। আর বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
খুবই ভালো কথা। বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বজুড়ে যখন ‘বাবা দিবস’, ‘মা দিবস’ ঘটা করে পালিত হওয়া শুরু হচ্ছে তখন বিশ্বের মা বাবারা খুবই আনন্দিত হবেন, পুলকিত হবেন; কখনো বা গর্বিত হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বৃদ্ধ/বৃদ্ধা মা-বাবাদের সব আনন্দের মধ্যে এক বেদনার সুর সব আনন্দ/গর্বকে ম্লান করে দেয় একটি শব্দ। সেই শব্দটি বৃদ্ধ/বৃদ্ধা বাবা মায়ের কাছে আজ ভীষণ ভীতির সঞ্চার করে। সেই কলঙ্কিত শব্দটি হলো- ‘বৃদ্ধাশ্রম’। তবে আশার কথা, ভরসার কথা হলো- এই শ্রুতিকটু শব্দটি এখনো বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে তেমন পরিচিতি লাভ করেনি। শহর/বন্দর তথা, তথাকথিত শিক্ষিত/ভদ্র সমাজেই এখনো, এর উপস্থিতি। অন্তত: বাংলাদেশে এই ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটি কতোটুকু ভীতিপ্রদ তা আমার এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেই স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। আমার বর্তমান বাসস্থান শহরতলীর এক গ্রামে। সেই গ্রামের একটি পরিবারের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক খুবই মধুর। সেই পরিবারে ওরা পাঁচ/ছয় ভাই। ধরে নিলাম ছোট ছেলের নাম ‘ক’। ‘ক’ ছাড়া সবাই বিবাহিত। স্ত্রী/সন্তান নিয়ে আলাদা বসবাস তাদের। ‘ক’ বিয়ে তা করেনি। মা/বাবা বর্তমান। মা খানিকটা অসুস্থ। বিবাহিত ভাইয়েরা নিজ নিজ স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ছোট ভাই ‘ক’ই মায়ের চিকিৎসা এবং অন্যান্য দিক দেখাশুনা করে থাকে। দেখে শুনে মনে হয় তাদের দেখাশুনার সব দায়িত্বটাই বোধ হয় তার। একদিন ‘ক’দের বাড়িতে গিয়ে তার মায়ের সামনে পড়তেই ব্যস্ত সমস্ত হয়ে তার মা নিজের ভাষায় বলতে থাকে- ‘ওবা, ‘ক’ ইডা কিতা কয়, আমারে নাকি তারা বৃদ্ধাশ্রমে থইয়া আইব।’
ওখানে নাকি ‘ক’কে দেখতে পাইতাম না, আমার অন্য পুলারা, পুলার বউরা, আমার নাতি/নাতনি কেউরে নাকি দেখতে পাইতাম না। ওখানে আমি কেমনে থাকুমা বাবা? ক’রে একটু বুঝাইয়া কও আমারে যাতে ঐ বৃদ্ধাশ্রমে না লইয়া যায়। আমার বড় ভয় লাগেরে বাবা।’ যারে পায় তারেই নাকি ‘ক’ এর মা এমন কথা বলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর ‘ক’ এলো। তাকে এসব কথা বললে ‘ক’ বললো, তার আম্মা নাকি নিয়মমত ঔষধ খায় না, নিয়ম মেনে চলেন না। তাই ভয় দেখানোর জন্যই তার বৃদ্ধাশ্রমের ভয় দেখানো। এর ফলে তিনি নাকি সব কাজ নিয়মিত করেন। বৃদ্ধাশ্রমের ভীতি কেমন তা তো এই ঘটনাটিই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এটাতো কোন বানানো গল্প নয়। বৃদ্ধাশ্রম ভীতির এক বাস্তব ঘটনা ‘ক’ নামক ব্যক্তিটির মায়ের জীবনে।
এই ক’দিন আগে ‘বাবা দিবস’ নামক দিবসটি বিশ্বজুড়ে পালিত হলো। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সেটি পালিত হলো সে খবরটি হয়তো আমরা জানি না। বাংলাদেশে এ নিয়ে পত্র-পত্রিকা-রেডিও-টেলিভিশনে দিবসটির গুরুত্ব প্রচার করা হয়েছে। অবশ্য গ্রামীণ জীবনে এর প্রভাব একেবারেই নগণ্য। পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধের ছড়াছড়ি লক্ষণীয়। বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের বৃদ্ধাশ্রম জীবনের অনেক করুণ কাহিনীর খবর আসে খবরের কাগজের পাতায়। একটি খবর-রফিকুল ইসলাম পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। চার ছেলে তার। ২ জন ডাক্তার, ২ জন ইঞ্জিনিয়ার। সবাই আমেরিকা প্রবাসী। বছর খানেক আগে তার স্ত্রীকেও আমেরিকা নিয়ে গেছে সন্তানেরা। বাবা অসুস্থ থাকায় তাকে নেয়া হয়নি। ভদ্রলোকের স্থান হয়েছে নারায়ণগঞ্জের বৃদ্ধাশ্রমে। দুর্ভাগা পিতা রফিকুল ইসলামের শারীরিক অবস্থা যাই হোক মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে তা অনুভব করা সম্ভব নয়। তারপরও রফিকুল ইসলামদের প্রত্যাশা ভালো থাকুক সন্তানরা। কারণ, অনেকে বলেন- বাবারা চোখ দিয়ে কাঁদে না, কলিজা দিয়ে কাঁদে। কিন্তু সকল সন্তানেরা তা বুঝতে পারে না। এটাই হলো সকল বাবাদের দুর্ভাগ্য। আর এই দুর্ভাগা বাবারা আবেগের বশে প্রথম জীবনে জীবনের কিছু কিছু বিষয় চিনতে-জানতে ভুল করে ফেলেন। যেমন- পুত্রকে চেনা যায় বিবাহের পর আর কন্যাকে যৌবনে, স্বামীকে স্ত্রীর অসুস্থতায় আর স্ত্রীকে স্বামীর দারিদ্র্যতায়, বন্ধুর পরিচয় বিপদে, ভাইয়ের পরিচয় লড়াইয়ে আর সন্তান চেনার উপায় হলো বার্ধক্যে। আর সন্তানেরাও একসময় বিভিন্ন কারণে বাবাদের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা, মনের ভাষা কোন এক সময় বুঝতে ভুল করে বসে। বিশেষ করে তারা যখন কারো স্বামী হয় কারো স্ত্রী হয়। আসলে সত্য কথাটি হলো- বাবারা চোখ দিয়ে কাঁদে না, কলিজা দিয়ে কাঁদে। কিন্তু সকল সন্তানেরা তা বুঝতে পারে না। এটাই হলো সকল বাবাদের দুর্ভাগ্য।
তবে একটা বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটি লন্ডন-আমেরিকা-কানাডা-অষ্ট্রেলিয়া সহ ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে খুব একটা বেমানান নয়। সেখানকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৃদ্ধাশ্রম ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়। ঐসব দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী তা মেনে নিয়েছেন। সামাজিক ব্যবস্থাটিই তা মেনে নিতে বাধ্য করেছে। সেখানে আবেগ-অনুভূতি-প্রেম-প্রীতি-¯েœহ-মমতা-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা কোন কিছুই জীবনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলতে পারে না। শুনেছি সেসব দেশে নাকি আঠারো বছরের বয়সের পর মা বাবাকে ছেড়ে গিয়ে নিজেরা নিজেদের জীবন-সংসার গড়ে তুলে ছেলেমেয়েরা। বাবা মা’দের আর কোন কন্ট্রোল থাকে না তাদের ওপর। আর্থিক কোন সাহায্য সহযোগিতাও চায় না সন্তানরা বাবা মায়ের কাছে। সবাই যার যার করে চলতে চায়। কারো ওপর কারো নির্ভরতা আর থাকে না। ফলে মায়ার বন্ধনও অন্যরূপ ধারণ করে। সেসব দেশের বাস্তবতার নিরিখে। এটা কোন নিন্দনীয় বা দোষণীয় বিষয়ও নয়। বরং উল্টোটা হলেই নিন্দার ঝড় ওঠে সামাজিক বাস্তবতায়।
কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিত্রটি একেবারেই অন্যরকম। এখানে স্ত্রী পুত্র কন্যা বাবা মা ভাই বোন পুত্রবধু নাতি-নাতনি নিয়ে এক স্বর্গীয় আবেশ আজো বিরাজমান সমাজে সমাজে ঘরে ঘরে। এগুলো বৃদ্ধাশ্রম তো নয়ই বলতে গেলে আশ্রম। তপোবন। শান্তিনিকেতন। শান্তির সুর বাজে কানে কানে। পুত্রবধুদের মায়াবী ডাক, নাতি নাতনির দুষ্টু দুষ্টু খেলা বৃদ্ধ/বৃদ্ধাকে দীর্ঘায়ূ হতে সাহস জোগায়। কবি গুরুর সাথে গোপনে গোপনে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চায়- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে’।
তারপরও মাঝে মাঝে আঁধার ঘনিয়ে আসে শান্তির নীড়ে। মানবতা বিবর্জিত তথাকথিত সার্টিফিকেট সর্বস্ব অশিক্ষা-কুশিক্ষার কারণে সহায় সম্বলহীন অসহায় পিতা মাতার শেষ জীবনে নেমে আসে মানসিক নির্যাতন। কোন কোন দুর্ভাগা পিতা মাতার ওপর শারীরিক নির্যাতনও। আর তখনই সুযোগ নেয় বৃদ্ধাশ্রম। হাতছানি দিয়ে ডাকে। বলে- এসো এসো বিদায়ী বন্ধু/বান্ধবী। খোলা আছে দ্বার, সুন্দর ভূবনের মায়া তোমার ছাড়িতেই হইবে। আমি বৃদ্ধাশ্রম, আমিই তোমাদের শেষ ঠিকানা। নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তবে আশার কথা, ভরসার কথা- ওটি কয় কুলাঙ্গারের কুকর্ম ছাড়া বাংলার ঘরে ঘরে এখনো সুবাতাস বয়। সে বাতাস উড়িয়ে দেয়, গুড়িয়ে দেয় বৃদ্ধাশ্রম। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম, দুঃসংবাদই, কোন সুখবর নয়।
তবে এই নিবন্ধ শেষ করার আগে একটি গল্প বলতে চাই। গল্পটি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বন্ধুবর অধ্যক্ষ পরিমল কান্তি মহোদয়ের কাছে শ্রুত। গল্পটি এ রকম খ্রিস্টপূর্ব প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বে চীনের বিখ্যাত দার্শনিক ধর্মগুরু কনফুসিয়াস একদিন দেখলেন এক শক্ত-সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী এক যুবক কাঁধে এক বৃদ্ধকে নিয়ে যাচ্ছে তাকে খর¯্রােতা নদীতে ভাসিয়ে দিতে। কনফুসিয়াস জিজ্ঞেস করলে যুবকটি জানালো- বৃদ্ধটি তার জন্মদাতা বাবা। তখন কনফুসিয়াস বলেছিলেন, দ্যাখ বাবা, তুমি যখন তোমার বাবার মতো একদিন বৃদ্ধ হবে তখনও এই নদীটি থাকবে। তোমার ছেলে দেখছে তুমি তোমার বাবাকে নদীতে ফেলতে যাচ্ছো। তোমার ছেলে তা দেখছে এবং শিখে নিচ্ছে। যুবকটি জানালো এটা নাকি তাদের সামাজিক নিয়ম। কনফুসিয়াস বলেছিলেন, তুমি বৃদ্ধ হলে তোমার ছেলেও এমনিভাবে তোমাকে কঁাঁধে করে নিয়ে নদীতে ফেলবে। যুবকটি চমকে উঠলো। ভয় পেয়ে বললো- এটা কি সত্যি? কনফুসিয়াস বললেন সত্যি। তখন কনফুসিয়াস তাকে বলেছিলেন যাও বাবাকে নিয়ে ঘরে ফিরে যাও। সমাজের সবাইকে তা বলো। যুবকটি ফিরে গেলো। ঘটনাটি সবাইকে তা বললে আর কেউ এমন কাজ করতে সাহস পেলো না। সমাজের কিছু কিছু অকৃতজ্ঞ সন্তান ধর্মগুরু কনফুসিয়াসের এই গল্পটি পড়বে কিনা তারাই জানে।