আলেক্সি নাভালনি, রাশিয়ার ম্যান্ডেলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ আগস্ট ২০২৩, ৩:১০:৪৫ অপরাহ্ন

অ্যাডভোকেট আনসার খান
রাশিয়ার পুতিনবাদী স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিখ্যাত ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলেক্সি নাভালনির নেতৃত্বে ২০১১ সালের শেষদিকে রাশিয়ায় সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে এবং পুতিনবাদী অগণতান্ত্রিক শাসনের ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে মস্কোর রাস্তায় একটি ব্যাপক ও বিশাল বিক্ষোভ-গণআন্দোলনের তরঙ্গ শুরু হয়েছিলো। আন্দোলনের রাজপথে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশে জ্বলন্ত বক্তৃতার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন নাভালনি এবং তার বক্তব্য পুতিন শাসনের ভিত কাঁপিয়ে তুলেছিলো। তার রাজনৈতিক দলের নাম, “ভবিষ্যতের রাশিয়া।” প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে সরাসরি মুখোমুখি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠেছেন আলেক্সি নাভালনি।
নাভালনি একজন আইনজীবী, রাজনীতিক,মানবাধিকার এবং দুর্নীতিবিরোধী কর্মী। রাশিয়ার সরকারি-বেসরকারী দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের লক্ষ্যে তিনি “দুর্নীতিবিরোধী ফাউন্ডেশন” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে পুতিন সরকারের বিশাল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন কারাগারে থেকেও। কারাগারে থাকা নাভালনিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাকে “বিবেকের বন্দী” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং মানবাধিকার বিষয়ক কাজের জন্য ইইউ তাকে “সাখারভ পুরস্কারে” ভূষিত করেছে। তিনি আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রাশিয়ার মুক্তিকামী মানুষের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছেন এবং তার নেতৃত্বে পুতিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ধ্বংসস্তুপের উপর আবারও গণতান্ত্রিক রাশিয়ার পূনঃউদ্ভব হবে, এমনটিই মনে করেন রাশিয়ার মুক্তিকামী জনগণ।
নাভালনি পুতিন শাসনের অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক হুমকি হয়ে উঠেছিলেন এবং তাকে পুতিনের প্রধান শত্রু গণ্য করে নাভালনিকে তীব্রভাবে দমনের জন্য নানা মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি এবং এমনকি বিষ প্রয়োগে হত্যারও চেষ্টা করা হয়। মিথ্যা এবং সাজানো মামলায় কারান্তরে গোপন বিচারে নাভালনিকে শাস্তি দেওয়া হয় এবং সাকুল্যে মোট সাড়ে এগারো বছরের দীর্ঘমেয়াদের কারাদ-ে দন্ডিত হয়ে এখন তিনি নির্জন কারাগারে কারারুদ্ধ।
কারাগারে থাকা নাভালনির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস নিরোধক আইনের মামলাসহ ছয়টি ফৌজদারী মামলার বিচার চলছে এবং ওই মামলাগুলোর বিচার সম্পূর্ণভাবে কারাগারের বন্ধ দরজার পেছনে এজলাস বসিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওইসব মামলায় তার ত্রিশ বছর পর্যন্ত কারাদ- হতে পারে। ইতিমধ্যে সন্ত্রাস নিরোধক আইনের মামলায় তার বিশ বছরের সাজার আবেদন জানিয়েছেন সরকারি প্রসিকিউটরগণ। আগষ্টে এই মামলার রায় হওয়ার কথা রয়েছে। নাভালনির কারাদ- হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার চেয়েও বেশি হতে পারে। উল্লেখ্য, শেতাঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের জেরে দক্ষিণ আফ্রিকার শেতাঙ্গ শাসকরা মিথ্যা সাজানো মামলায় ম্যান্ডেলাকে সাতাশ বছরের কারাদ- দিয়েছিলো। নাভালনিকে কারাগারে রাখা, “তাকে রাশিয়ার ম্যান্ডেলার সংস্করণে পরিণত করতে পারে” -বলছেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নাভালনির সাথে সম্পর্কিত সবকিছুই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। তার সহযোদ্ধাদের বেশিরভাগ এখন কারাগারে আটক এবং অনেকেই বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাসত্ত্বেও দমে যাননি নাভালনি। তিনি মন্তব্য করেছেন, “আমাদের পথ কখনও গোলাপের পাপড়ি বিছিয়ে দেওয়া হয়নি, এখনও তাই। আমরা সকল বাধা অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক রাশিয়া বিনির্মানে কাজ করে যাবো।”
কারাগারে আটক থেকে, নাভালনি, ম্যান্ডেলার মতো, শুধুমাত্র নিজের জীবনের জন্য, নিজের অধিকারের জন্যই নয়, রাশিয়ার জনগণকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অত্যাচার-অবিচার, নিপীড়ন-নির্যাতনের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য, তাদের মৌলিক মানবাধিকার আদায়ের জন্যও লড়াই করে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
বর্তমানে দন্ডভোগরত নাভালনিকে কারাগারের যে ব্যাঙ্কে রাখা হয়েছে বিদ্রোপাত্মকভাবে একটি “বন্ধুত্বপূর্ণ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প” বলে অভিহিত করা ব্যাঙ্কটি দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যান্ডেলার নির্জন কারাগারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যেখানে, রীবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলা ২৭ বছরের দন্ডভোগ করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসকদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে।
একজন আমেরিকান সাংবাদিক সাইমন শাস্টারের সাথে একটি চিঠি বিনিময়ে, নাভালিন তার বর্তমান জীবনকে “কারাগারের মধ্যে কারাগারে” বলে বর্ণনা করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার বন্দীদশা যেমন দক্ষিণ আফ্রিকায় শেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসনের বৈধতাকে ক্ষুন্ন ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো বিশ্বপরিমন্ডলে, তেমনি নাভালনির প্রতি ক্রেমলিনের প্রতিশোধমূলক নিপীড়ন ও মিথ্যা মামলায় তাকে কারাগারে আটক রাখা, ক্ষমতায় থাকা পুতিনের বৈধতা ও ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে। এটিকে পুতিনের বর্বর শাসনের উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে সর্বত্র।
কারাগারে থাকাসত্ত্বেও কর্তৃত্ববাদী শাসক ভøাদিমির পুতিনের সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ হলেন ওই নাভালনি। দ্য ডেইলি মেইল পত্রিকায় এডওয়ার্ড লুকাস লিখেছেন, নাভালনি কেবল রাশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব-ই নন, তিনি পুতিনের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথাও বটে। পুতিন চাইছেন যে “রাষ্ট্র ও সমাজ তার করা নতুন নিয়ম মেনে চলবে, যেখানে আপনাকে সম্পূর্ণ আনুগত্যের নীতিতে, আমাদের শাসনের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে চলতে হবে। আপনার উচ্চাকাঙ্খার কোনো অধিকার নেই, আপনার ক্ষমতার জন্য লড়াই করার কোনো অধিকার নেই, আনুগত্য মেনে চলা হলো আপনার আচরণের প্রধান নীতি।” এসব হলো পুতিনের চরম কর্তৃত্ববাদী শাসনের বহিঃপ্রকাশ।
পুতিনের এই চরম কর্তৃত্ববাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রধান চ্যালেঞ্জার হলেন আলেক্সি নাভালনি। তাই নাভালনিকে প্রতিরোধ করাই পুতিনের মৌলিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নানান মিথ্যা মামলায় নাভালনিকে কারাগারে আটক রাখতে সচেষ্ট রয়েছে পুতিন সরকার। রাশিয়ান সরকার নাভালনিকে একজন চরমপন্থী হিসেবে অভিহিত করেছে এবং তিনি রাশিয়াকে দূর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিদেশীদের সহযোগিতায় কাজ করছেন। তাই নাভালনির বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে তাকে আজীবন কারাগারে আটক রাখতে চায় পুতিন সরকার, অভিযোগ নাভালনি সমর্থকদের। তবে এই রক্তচক্ষু আমলে নেননি নাভালনি। ২০১১ সাল থেকেই নাভালনি, পুতিনের সর্বাত্মকবাদী শাসন ও তার সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করে চলেছেন। সত্যিকার অর্থে, পুতিন নাভালনির ছায়াকেও ভয় পান। পুতিন ভয় পান, নাভালনির, কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, যা রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারী শাসক পুতিনের শাসনের পরিবর্তন চায়। “কারাগারে নাভালনি, রাশিয়া যা হয়ে উঠেছে তার অনুস্মারক এবং রাশিয়ার জনগণ যে তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছে তার প্রতীক হয়ে উঠেছেন নাভালনি।” রাশিয়ার ভেতরে পুতিন শাসনের জন্য ভয়ংকর ভয় ধরিয়ে পুতিন বিরোধী আন্দোলনের নেতা নাভালনি লিখেছেন, রাশিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য “আমাদের কোনোভাবেই পুতিনের শারীরিক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।”
“মুক্তগণমাধ্যমের ধ্বংস, সুশীল সমাজের জন্য হুমকি এবং ন্যায়বিচারের ক্রমাবনতি ও চরম দুর্নীতি, -সন্দেহ নেই যে একটি অস্বচ্ছ, জবাবদিহিহীন রাশিয়ান রাষ্ট্র অবশেষে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হবে” -মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইকেল ম্যাকফাউল।
রাশিয়ায় পুতিনের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী শাসনে চলমান রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং চরম দূর্নীতি গণবিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে, যা পুতিনের শাসনকে বিধ্বস্ত করে ফেলবে, গণমাধ্যমকর্মী, গণমানুষ এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন যতই বাড়তে থাকবে, পুতিন শাসনের পতনের ঝুঁকি ততই বাড়বে বলে মনে করেন নাভালনি। তবে কখন এটি ঘটতে পারে, বা এরজন্য কতটা রক্ত ঝরবে, সেই ধারণা দেননি তিনি।
নাভালনি তার জীবন নিয়ে শংকিত, তা সত্ত্বেও তিনি কর্তৃত্ববাদী পুতিন শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। বিবেকের কন্ঠস্বর হিসেবে তিনি নীরব থাকতে অস্বীকার করেছেন আদালতে দাঁড়িয়ে। নাভালনি বলেছেন, পুতিন রাশিয়ার শক্তি এবং অন্যাান্য সম্পদ ব্যবহার করার জন্য “একটি নীতিহীন, ধূর্ত ও নির্মম রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য” চেষ্টা করছেন, যেখানে বিবেকের স্বাধীনতা, জনগণের কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে পুতিন তার সাম্রাজ্য গড়তে সচেষ্ট। পুতিনের সেই স্বপ্ন পূরনের প্রধান বাধা নাভালনি এবং তাই নাভালনিকে রাশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে মরণকামড় দিয়ে চলেছেন, বাকী জীবন যাতে কারাগারের নির্জন সেলে থাকতে হয় সেই লক্ষ্যে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছেন পুতিন, এমনটি মনে করে নাভালনি সমর্থকরা। তবে নাভালনির সমর্থকরা তাকে “দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার একটি রাশিয়ান সংস্করণ” হিসেবে অভিহিত করেছেন, যিনি একদিন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বীরের বেশে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে আসবেন।
সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি নিউজ, রয়টার্স, ভিওএ নিউজ, স্কাই নিউজ, দ্য উইক, ডেইলি মেইল, ওপেন ডেমোক্র্যাসি, টাইম ম্যাগাজিন।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।