প্রসঙ্গ : শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ আগস্ট ২০২৩, ১১:৪৬:৫৪ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশাভিত্তিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি নির্ধারণ করে সরকারের নি¤œতম মজুরি বোর্ড। সে হিসেবে সরকার ৪৪টি খাত নির্ধারণ করে এসব খাতের শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এখনো দেশের সবচেয়ে বড় খাত কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। গৃহশ্রমেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শ্রমিক কর্মরত থাকার পর এই শ্রমিকদের জন্যে নেই নির্ধারিত মজুরি। আবার নারী শ্রমিকরা বরাবরই পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পান। অভিযোগ আছে, পোশাক খাত ছাড়া নিয়মিত ভিত্তিতে অন্য খাতগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ। এর ফলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে শ্রমিকদের জীবনধারণ করা হয়ে পড়েছে অতি কষ্টের।
প্রসঙ্গত, নি¤œতম মজুরি বোর্ডের নিয়মিতভাবে মজুরি পর্যালোচনা করে নি¤œতম মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর নি¤œতম মজুরি পুনর্বিবেচনা করার বিধানও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কাজটি উপেক্ষিত হচ্ছে। শ্রম সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন খাতে কাজ করে। কিন্তু দেখা গেছে, মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত খাতগুলোর মধ্যে কোনো খাতে মজুরি আড়াই হাজার টাকা, আবার কোথাও সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ৯০০ টাকা। শ্রমিকদের অভিযোগ, অনেক সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না। এর মধ্যে সিরামিকস ও সিমেন্ট কারখানাকে এই বোর্ডে নতুন খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও এ দুটি খাতের মজুরি এখনো নির্ধারিত হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী দেশে কৃষি শ্রমিক আছেন ৭৭ লাখ। বিবিএসের কৃষি ও পল্লী পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে একজন কৃষি শ্রমিক গড়ে দৈনিক ৩৮৬ টাকা মজুরি পান। আবার তারা প্রতিদিন যে কাজ পান, তাও নয়। দেশের সব জেলার পল্লী এলাকার ৫৭ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এই টাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুই বেলা শাক-সবজি দিয়ে খেয়ে পরে থাকাও অত্যন্ত কষ্টকর। শ্রমিক সংগঠনগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের পরিবহন খাতে মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। ২০২০ সালের ২১ জুলাই পরিবহন শ্রমিকদের জন্য নি¤œতম মজুরির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ হিসেবে একজন চালকের বেতন সর্বোচ্চ ২০ হাজার ২০০ থেকে সর্বনি¤œ ১৪ হাজার ৪০০। চালকের সহকারীর বেতন ১০ হাজার ৭৫০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে এই শ্রমিকদের বেতন বাড়ার কথা। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাকালীন বাসচালক ও তাঁদের সহকারীরা কেউই নির্ধারিত বেতন পান না। যত ট্রিপ, তত টাকা- এই চুক্তিতে তারা বাস চালান। মালিকের জমা, লাইন খরচ, জ্বালানি খরচ ও নিজেদের খাওয়ার খরচ বাদ দেওয়ার পর চালক ও সহকারী নিজেদের আয় বুঝে নেন। নির্দিষ্ট মজুরি না থাকায় বেশি ট্রিপের আশায় চালকরা বেপরোয়াভাবে বাস চালান। ফলে হরদম সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। সড়কে লাশের মিছিল চলতেই থাকে।
কপাল বদলায়নি গৃহশ্রমের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদেরও। এখনও চুক্তি ভিত্তিতে দেশের গৃহশ্রমিকরা কাজ করছেন। গৃহ শ্রমিকরা অনেক সময় মালিক কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। একজন নারী গৃহশ্রমিককে এক সাথে ৩/৪টি বাসায় কাজ করতে হয়। প্রতিটি বাসায় সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা করে পেলে মাস শেষে তিনি পাবেন মাত্র ৮ হাজার টাকা। এই আট হাজার টাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কিভাবে দিনাতিপাত করেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘ আন্দোলনের পরও চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবনের উন্নতি হয়নি। ২০২২ সালে দীর্ঘ আন্দোলনের পর অবশেষে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এর আগে ১২০ টাকা মজুরিতে তারা কাজ করতেন। যদিও শ্রমিকদের দাবি ছিল দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার। দেশের ১৬৭টি চা বাগানে শ্রমিক প্রায় ১ লাখ। একজন শ্রমিকের মজুরির ওপর কমপক্ষে পাঁচজনের ভরণপোষণ নির্ভর করে।
এছাড়া নারী শ্রমিকরা বরাবরই পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় কম মজুরি পেয়ে এসেছেন। বিশেষ করে দিনমজুর ও নির্মাণ কাজে জড়িত শ্রমিকরা এক্ষেত্রে বেশি বঞ্চিত। পুরুষের সমান কাজ করেও নারী শ্রমিকরা কম মজুরি পান। একজন পুরুষ দিনমজুর যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা পান, সেখানে একজন নারী শ্রমিক পান ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা। একজন শ্রমিক হিসেবে নারী শ্রমিক শ্রম আইন অনুযায়ী সব অধিকারের সমান অংশীদার হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। নারী শ্রমিক অধ্যুষিত গার্মেন্ট ও অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে স্বল্প মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নি¤œ পদমর্যাদা, খ-কালীন নিয়োগ, যখন-তখন ছাঁটাই ও অধিক কর্মঘণ্টা কাজ করানো হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র থেকে সাপ্তাহিক ছুটি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় না।
এছাড়া অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সুপেয় পানির অভাব, যৌন হয়রানিসহ অনেক সমস্যা তাদের প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হয়। সমকাজে সমমজুরি ও নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য তো রয়েছেই। কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও তাদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীরা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভাত, কাপড়, মাথা গোঁজার ঠাঁই, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিশাল অংশ এখনো এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও পুষ্টির অভাবে ন্যূনতম মানসম্মত খাবার খেতে না পারায় শ্রমিক-কর্মচারী ও তাদের পরিবারে সদস্যরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারবেন কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই। দেশের সিংহভাগ শ্রমিক নির্মাণ, গার্মেন্ট, পরিবহন, চাতাল, ওয়েল্ডিং, শিপব্রেকিংসহ অসংগঠিত সেক্টরে কাজ করেন। এসব কারখানা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয়, তা দিয়ে কোনোভাবেই পরিবারসহ জীবিকা নির্বাহ করা মোটেই সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব সেক্টরেই মজুরি বৈষম্য রয়েছে। একই সরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন বা তাঁদের মজুরি যেভাবে নির্ধারিত হয়, শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারিত হয় অন্যভাবে। মোট কথা রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।
মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপট এবং মুনাফাখোর ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কয়েক বছর ধরে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতি বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে, শ্রমিক-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এমতাবস্থায় বিশেষভাবে দেশ ও জাতির মূল চালিকাশক্তি সেই শ্রমজীবী মানুষের জীবন একেবারে অসহনীয় হয়ে পড়েছে। দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রথমেই আমাদের শ্রমজীবী মানুষদেরকে সুস্থ, সবল এবং আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের উন্নয়ন মানেই দেশ ও জাতির উন্নয়ন। শ্রমজীবীদের বাদ দিয়ে কখনও জাতীয় উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। তাই শ্রমিক উন্নয়ন ও শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় যা অবশ্য করতে হবে তা হচ্ছে- (১) বাজারদরের সাথে সঙ্গতি রেখে শ্রমিকদের বেতন নির্ধারণ করতে হবে। (২) শ্রমিক-কর্মচারী তথা নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ করে গার্মেন্ট, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, চা-শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, হকার, চাতাল, ওয়েল্ডিং ও গৃহশ্রমিকদের জন্য রেশন প্রথার মাধ্যমে সস্তা, সুলভ মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন- চাল, ডাল, তেল, চিনি সরবরাহ করতে হবে। (৩) শ্রমিক-কর্মচারীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কারখানা ও শিল্পাঞ্চলভিত্তিক আবাসন, হাসপাতাল ও বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। (৪) সরকার ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।