বাঙালি নারীর সাংস্কৃতিক জন্ম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:৪৪:২৫ অপরাহ্ন
রোমেনা আফরোজ
মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৮০ শতাংশ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাঙালি নারী আবহমানকাল ধরে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেও সংসার টিকিয়ে রাখছে, এই দায়টা মূলত কার? কেন একজন নারী অসম্মানজনক জীবনকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। এটা কি শুধুই সাংস্কৃতিক আধিপত্য, নাকি আর্থিক অক্ষমতা কিংবা তৃতীয় কোনো শক্তি কাজ করছে এর পেছনে?
বর্তমান সময়ে গণতন্ত্র বহুল চর্চিত বিষয় হলেও তা যেন রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারে বিষয়টিকে শুধুমাত্র নির্বাচনের মধ্যে গ-িবদ্ধ করে ফেলেছি। পরিবারে গণতন্ত্র না থাকলে রাষ্ট্রে কখনোই গণতন্ত্রের যথাযথ বিকাশ সম্ভব নয়। কারণ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই পারিবারিকভাবে নারীর প্রতি জুলুমের সংস্কৃতি অব্যাহত রাখলে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রাষ্ট্রেও ঘটবে। পরিবারের কাছে নারী যেমন দুর্বল সত্তা, রাষ্ট্রের কাছেও তেমনি সাধারণ মানুষ। তাই দুর্বলতার সুযোগে এক পক্ষ সুবিধা নিলে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রও দুর্বলের ঘাড়ে চেপে বসার সুযোগ পেয়ে যাবে। রাষ্ট্রের কাছ থেকে গণতন্ত্র প্রত্যাশার পূর্বে অবশ্যই পরিবারে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। না হলে গণতন্ত্র হবে অসম্পূর্ণ এক অধ্যায়।
বাঙালি সমাজে শিশুকাল থেকে বিভেদ এবং বিভাজনের পাঠ আরম্ভ হয়। এই প্রয়াসেই যেন একটা ছেলের হাতে তুলে দেয়া হয় বন্দুক, মেয়েরা খেলা করে পুতুল নিয়ে। যদি বন্দুক হয় যুদ্ধের প্রতীক, তবে পুতুল সংসারের। জন্মলগ্ন থেকে ছেলেশিশুকে তার লিঙ্গের জন্য পূজা করা হয়। তারা তুলনামূলকভাবে পড়াশোনা করে বেশি। তারা যখন তখন চৌকাঠ ডিঙাতে পারে। তাদের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই সাংস্কৃতিক জন্ম এবং সুযোগ-সুবিধা পুরুষদের মধ্যে একটা কর্তৃত্বপরায়ণ ভাবের জন্ম দেয়। ওদিকে মাসিক হওয়ার কারণে নারীদের ভাবা হয় পাপী, অচ্ছুৎ এবং নিম্নবর্গের আধা মানুষ। তারা দুর্বল এবং দাস শ্রেণি। এ কারণে গৃহস্থালির মত সহজ কাজকর্মে তাদেরকে নিযুক্ত রাখা হয়। এ ধরণের বৈষম্য দেখতে দেখতে একটা মেয়েশিশু বড় হয়। তার অবচেতন মনে অধস্তন বিষয়টি গভীরভাবে প্রবেশ করে। নিজের অজান্তে সামাজিক অনাচারে মানসিকভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
আমাদের সমাজে একজন মেয়ের পথ চলার জন্য প্রয়োজন হয় বাবা নামক পুরুষের। তারপর দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে ভাই এবং স্বামীর। নারী এতটাই অক্ষম এবং পরাধীন যে, তার গর্ভে জন্ম নেওয়া ছেলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাখে। নারীর মনে যে-সাংস্কৃতিক দীনতা জায়গা দখল করে নেয়, তা দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব। এই দীনতা, যেটা আবার ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স, তা নারীর চিন্তার পরিসরকে সীমিত করে রাখে। নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া মানুষের স্নায়ুতে নতুন কেমিকেল তৈরি হতে পারে না। তাই নতুন চিন্তা, ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে নারীরা যে পিছিয়ে থাকবে এটাই স্বভাব-সিদ্ধ।
বাঙালি সমাজে এখনো বৈবাহিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে পুরুষসমাজ। শহরের চিত্র কিছুটা ভিন্ন হলেও টাকা-পয়সা, আসবাবপত্রের মত নারীকেও পুরুষের সম্পত্তি ভাবা হয়। যৌনতার ক্ষেত্রেও নারীকে কখনো ছাড় দেওয়া হয় না। এখানেও বৈষম্য। পুরুষ শক্তিশালী তাই সে অধিকার করে, উপরে উঠে ভোগ করে দুর্বলকে, এমনটাই বাঙালি সমাজে ভাবা হয়। সম্পর্ক সহিংসতার পথে গেলেও মেনে নিতে হয় নারীকে। আসলে পরিবারিক সমর্থন না থাকলে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন। তাই শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সত্ত্বেও অনেক নারী ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। একজন পুরুষ যখন নারীর অসহায়ত্বের এই দিকটি বুঝতে পারেন তখন বেড়ে যায় অত্যাচার। আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া নারীর সংখ্যাও কম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘প্রিভেনটিং সুইসাইড: আ গ্লোবাল ইমপারেটিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি থাকলেও বাংলাদেশে নারীর আত্মহত্যার হার বেশি। (প্রথম আলো)
সাধারণত মনে করা হয়, বিবাহিত জীবনে নির্যাতন সহ্য করার মূল কারণ হলো আর্থিক অসংগতি। আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেই যে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হত এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ আর্থিক সচ্ছলতা থাকার পরেও অনেক নারী নির্যাতন মেনে নেন। বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮৭ লাখ। সংখ্যাটা একেবারে ফেলনা নয়। একজন কর্মজীবী নারীকে একই সাথে সংসার এবং চাকরি দুটোই সামলাতে হয়। সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে বাঙালি পুরুষ গৃহস্থালি কাজকর্ম থেকে দূরে থাকেন। এই বৈষম্য মেনে নিয়েও নারীরা সংসার করছেন। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে (২০১৬) মোট গার্মেন্টস কর্মীদের প্রায় ৫৪ শতাংশ হলো নারী অর্থাৎ ৪০ লাখের মধ্যে ২২ লাখ নারী কর্মী। এটা শুধু চাকরি ক্ষেত্রের হিসাব। শহরের প্রান্তিক নারীরা বাসাবাড়িতে কাজ করে থাকেন। এই নিম্নবর্গের পুরুষের মধ্যে বহুবিবাহ, দায়িত্বহীনতা, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের প্রবৃত্তি থাকলেও নারীরা বিষয়টা মেনে নেন। তাই এক বাক্যে আর্থিক অসংগতিকে নির্যাতন সহ্য করার মূল কারণ হিসেবে ধরা যায় না।
মূলত ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় মানসিক শক্তির। একবার নিজ শক্তিকে আবিষ্কার করতে পারলে পারিবারিক অসমর্থন কিংবা আর্থিক অসংগতি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু শিশুকাল থেকে নারীর মধ্যকার এই শক্তিটাকে ধীরেধীরে ধ্বংস করে ফেলা হয়।
তবে কি বিষাক্ত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য যৌনতা একটা কারণ হতে পারে? যেহেতু বাঙালি সমাজে নারীর বহুবিবাহের বিষয়টা দৃষ্টিকটু, তাই এটা একটা কারণ। তবে দু’একটা ভিন্নতা থাকলেও নারীরা জৈবিক চাহিদাকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ভাবেন না। কারণ বোধোদয়ের পর থেকে তাদের কাছে যৌনতাকে একটা গোপন বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তাই যৌনতা নিয়ে ভাবার মানসিকতা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত থাকে।
ভারতীয় যোগী সাদ গুরু বলেছেন, যৌনতার মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে রুনানুবন্ধাহ গড়ে উঠে। প্রথম যখন দুজনের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয় তখন নারীর শরীর শুক্রাণুকে মনে করে ফরেন বডি বা জীবাণু। তাই এসিড নিক্ষেপ করে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার সম্পর্কের সময় চিনে রাখে শুক্রাণুকে। রুনানুবান্ধার মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে অসংখ্য স্মৃতি, তথ্য আদান-প্রদান হয়। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে জন্ম নেয় মায়া। দুর্বল মানুষের জীবনে এই অনুভূতি খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। তাই নারীর ক্ষেত্রে সম্পর্ক থেকে বের হওয়া কিছুটা কঠিন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, বাঙালি নারীরা যদি রুনানুবান্ধার বেড়াজালে আটকা পড়ে থাকেন, তাহলে পাশ্চাত্যের নারীরা কীভাবে বন্ধনটা এড়িয়ে যান?
এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, পুঁজিবাদের জন্মভূমি হলো পাশ্চাত্য। এর হাত ধরে এসেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ নারীকে দিয়েছে সাংস্কৃতিক মুক্তি। এখানে মুক্তি শব্দটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সামগ্রিক অর্থে এর নেতিবাচক প্রভাব আছে, যা নিয়ে পরে কোথাও আলোচনা করা হবে। পাশ্চাত্যের নারীরা আর্থিকভাবে সক্ষম, একই সাথে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তাদেরকে সর্বোচ্চ সমর্থন যোগায়। তাই বহুপূর্বেই রুনানুবান্ধার সম্পর্ক পুঁজিবাদী মনস্তত্ত্ব এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সেই পরিবর্তন দীর্ঘসময় ধরে চর্চা করতে করতে প্রবেশ করেছে রক্তের মধ্যে। সমাজের বেশিরভাব ব্যক্তি যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, ভোগবাদ যেখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের কাছে রুনানুবান্ধার মত বিষয়গুলো একেবারে ঠুনকো। তাদের কাছে ব্যক্তি মানে ঈশ্বর। ঈশ্বর মানে ব্যক্তি। কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক জন্মের ইতিহাসটা সহ্য করার, মেনে নেওয়ার। বাঙালি সমাজে একজন মেয়ে পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরাচার দেখতে দেখতে বড় হয়। বড় হতে হতে বৃত্তের বাইরে কল্পনা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
মূলত বাঙালি সাংস্কৃতিক জন্ম, আর্থিক অসংগতি, পারিবারিক পিছুটান এবং অশিক্ষা বাঙালি নারীর সহ্য করার অপসংস্কৃতির মূল কারণ। পুঁজিবাদের হাত ধরে একসময় বাংলাদেশেও পাশ্চাত্যের মত পরিবর্তন আসবে। সম্প্রতিককালের ডিভোর্সের হার বৃদ্ধি সেই পরিবর্তনের ঈঙ্গিতও দেয়। তবে হাওয়া-বদল থেকে সামগ্রিক অর্থে সামাজিক কল্যাণ পেতে হলে অবশ্যই পুঁজিবাদ সম্পর্কে জানতে হবে। অন্যথায় পুঁজিবাদী আগ্রাসনে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকবে না।
লেখক : কলামিস্ট।