সিলেটিদের রবীন্দ্রানুরাগ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ৫:৩৫:২২ অপরাহ্ন
সেলিম আউয়াল
১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ সিলেটে এসেছিলেন। ওই সময় সিলেটে ব্যস্ত সময় কাটে তাঁর। প্রতিদিনই ছিলো একটির পর একটি কর্মসূচি। সিলেটের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। সফরের দিনগুলোতে ছোট্ট শহর সিলেটে ছিল প্রাণের উচ্ছ্বাস। একশো বছর পর ২০১৯ সালে সিলেটবাসী পালন করে রবীন্দ্রনাথের সিলেট সফরের একশো বছর পূর্তি। প্রায় সপ্তাহ জুড়ে ছিল অনুষ্ঠানমালা।
রবীন্দ্রনাথ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে সিলেট শহরে প্রবেশ করেছিলেন। সেই গাড়িতে তার সাথে আসন গ্রহণ করেছিলেন সিলেটের পাঠানটুলার অধিবাসী কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ মৌলবি আবদুল করিম। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মৌলবি আবদুল করিম রচিত ÔIslam’s contribution to the science and civilizationÕ বইটির চমৎকার ‘ভড়ৎধিৎফ’ লিখে দিয়েছিলেন জ.ঘ. ঞধমড়ৎব.. সেই ‘ভূমিকা’য় রবীন্দ্রনাথ দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন যে, হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায় পাশাপাশি বাস করলেও একে অন্যকে খুবই কম জানে। তিনি বদ্ধদুয়ার খুলে দিতে সকলের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। মৌলবি আবদুল করিম রচিত ‘মধ্যযুগের ভারতীয় ইসলামের ইতিহাস’ বইটির এক বড়োসড়ো আলোচনা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ভারতী পত্রিকায়।’
রবীন্দ্রনাথ সিলেটে অনেকগুলো সিরিয়াস প্রোগ্রামে বক্তব্য রেখেছিলেন। পাশাপাশি পারিবারিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন। শহরের চৌহাট্টা সিংহবাড়িতে গিয়ে দুই শিশুর নামও রেখেছিলেন। সেখানে কবিকে আমন্ত্রণকারী গোবিন্দনারায়ণ সিংহের ছেলে গোপেন্দ্রনারায়ণ সিংহের বড় ছেলে এবং কন্যা সুরোবালার কন্যার নামকরণ অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন। কবি গোপেন্দ্রনারায়ণ সিংহের ছেলের নাম রাখেন ‘শুভব্রত’ আর সুরোবালার কন্যার নাম রাখেন ‘দীপ্তি’।
রবীন্দ্রনাথ নানা সময় বিভিন্নজনকে ছয় হাজারের বেশি চিঠি লিখেছিলেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন পত্রপ্রাপক ছিলেন সিলেটের। সিলেটের পত্রপ্রাপকদের মধ্যে একজন ছিলেন কিশোর সৈয়দ মুজতবা আলী। তখন তার বয়েস চৌদ্দ বছর। রবীন্দ্রনাথ সিলেট সফরকালে এমসি কলেজের হোস্টেলে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। রবীন্দ্রনাথ ‘আকাক্সক্ষা’ বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতা সূত্রে মুজতবা একটি চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথকেÑ ‘আকাক্সক্ষা উচ্চ করতে হলে কী করা উচিত?’ আগরতলা থেকে কবিগুরু আসমানি রঙের প্যাডে মুজতবাকে চিঠির উত্তর লিখেছিলেন। সেই সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশ^ভারতীতে জার্মান ভাষার অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর চেয়ে সাত বছর বেশি বয়েস, অর্থাৎ একুশ বছর বয়েসী সিলেটের এক সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ কবি কলকাতায় গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের হাতে ১২শ টাকার একটি চেক তুলে দিয়েছিলেন। সেটি ছিলো কবির সিলেট সফরের এক যুগ পর, আজ থেকে প্রায় ৯২ বছর আগে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ‘বিচিত্রা’ নামের বাড়ির দোতলায় রবীন্দ্রনাথের হাতে ‘দুর্গতদের দুঃখহরণের জন্য’ ১২শ টাকার চেকটি তুলে দিয়েছিলেন। তরুণ সেই কবির নাম অশোক বিজয় রাহা। সেদিনের তরুণ কবি প্রচন্ড আবেগে নিজের লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। ‘নমস্কার’ নামের সেই কবিতাটি ছিলো রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত।
রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে সিলেটে গঠিত হয়েছিলো ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী পরিষদ’। এই পরিষদের পক্ষ থেকে চেকটি প্রণামী হিসেবে কবিকে নিবেদিত হয়। আর পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে অশোক বিজয় রাহা রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন কলকাতায়। তখন তার বয়স একুশ বছর। পোস্টাফিসের গোলযোগের জন্যে টাকা পাবার সংবাদ অশোক বিজয় রাহার কাছে না পৌঁছায় তাকে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। টেলিগ্রামটি ছিলো :
Santiniketan
To Ashokebijoy Raha
khadimnagar
Sylhet.
Already Acknowledged donation
Letter follows, My repeated thanks.
-Rabindranath Tagore
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর শান্তিনিকেতন চরম অর্থ সংকটে পড়লে, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিধ্বস্ত মাধ্যমিক স্কুলের ঘরটির নির্মাণে সহায়তা করার জন্য ১৯৪৬ সালে রবীন্দ্র পার্ষদ অনিল চন্দকে মৌলভীবাজার পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় মৌলভীবাজারের সাবডিভিশন্যাল অফিসার ছিলেন আর.বি. ভাগাইওয়ালা। রবীন্দ্র সাহিত্যপ্রেমী ভাগাইওয়ালা মৌলভীবাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাঁদা তুলে অনিল চন্দের হাতে দিয়েছিলেন। এভাবেই সিলেটের সাথে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরিদেরও সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ওই টাকা দিয়ে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরাতন শিক্ষা ভবনের নতুন ছাত্রাবাস তৈরি করেন।
অবশ্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবারের সাথে সিলেটের মানুষের সম্পর্ক অনেক পুরনো। ‘বালাধন হত্যা মামলায় সিলেটের চা-বাগানের নিরীহ মণিপুরি যুবকদের পক্ষে মামলা লড়েছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী কামিনীকুমার চন্দ (১৮৬৩-১৯৩৬)। এই মামলায় অর্থ সহায়তা দান করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। [..] কামিনীকুমার ছিলেন ভারতীয় পূর্ব রেলের আইনজীবী। তিনি বিনা ভাড়ায় রেলের ‘সেলুন’ ব্যবহার করতে পারতেন। তিনি বাস করতেন শিলচরে। রবীন্দ্রনাথ তাই রেলের সঙ্গে শিলচরের ‘চর’ যুক্ত করে কামিনীকুমারকে ডাকতেন ‘রেলচর’ বলে।
রবীন্দ্রানুরাগের পাশাপাশি ব্যতিক্রমও আছেÑ রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয়েছিল সিলেটে। ‘কবির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে চারদিকে যখন আনন্দ, সভা-সমিতি, কবির জয়জয়কার, ঠিক সেই সময়ে সুরমা উপত্যকার শিলচরের ভুবনমোহন বিদ্যার্ণব তাঁরই সম্পাদিত সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকায় দুই কিস্তিতে (১৩ ও ২০ মাঘ ১৩২০; ২৬ জানুয়ারি ও ২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৪) গীতাঞ্জলিকে উপলক্ষ করে কবিকে আক্রমণ করেন। লিখলেন : …চরণধূলার তলে মাথা নত করিয়া দিতে হইলে শারীরিক বল প্রয়োগে স্কন্ধদেশ আকর্ষণ করিতে হয়। অতএব এস্থানে রসভঙ্গ দোষ ঘটিয়াছেÑ শান্তরসের উপলখ- দ্বিখ-িত হইয়া রোদ্ররসের উৎস প্রবাহিত হইয়াছে।’ […] চোখের জলের অহঙ্কারকে ডুবাইবার শক্তি নাই। প্রমাণ ভারতীয় ষড়দর্শন ও আধুনিক রসায়ন। অতএব কবির উক্ত রূপ আকাক্সক্ষাÑ ভারতীয় কবিত্বের মত্ত প্রলাপ।’
সমালোচক ভুবনমোহন বিদ্যার্ণবÑ বিখ্যাত দেশব্রতী ও নির্র্ভীক সংবাদপত্রসেবী। শিলচর থেকে ১৯১১-তে প্রকাশিত সুরমা ও সিলেট থেকে ১৯২০-এ প্রকাশিত ‘জনশক্তি’র তিনি ছিলেন সম্পাদক। সেই ভুবনমোহনের গীতাঞ্জলি সমালোচনা সিলেট-কাছাড়ে রবীন্দ্রানুরাগীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এর প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন মৌলবীবাজারের মুন্সেফ উপেন্দ্রকুমার কর (১৮৭৭-১৯৫৫)। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে উপেন্দ্র কর ‘সুরমা’ পত্রিকার ২১ অগ্রহায়ণ, ১৩২১ (৭ ডিসেম্বর ১৯১৪) লেখেন প্রতিবাদ। সুরমা পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে তাঁর প্রবন্ধ বেরোয়। এই প্রতিবাদের সঙ্গে উপেন্দ্রকুমার আরও আলোচনা যুক্ত করে ‘গীতাঞ্জলি’ সমালোচনা (প্রতিবাদ) নামে ১০৪ পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করলেন ১ আশি^ন ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৪ সেপ্টেম্বর ১৯১৪)। মৌলভীবাজারের চন্দ্রনাথ প্রেসে মুদ্রিত বইটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন।’
‘১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ সিলেটে এসেছিলেন। ‘বিপুল আয়োজনে কবি সার্বভৌমের সংবর্ধনা হয়েছিল সিলেটে। সেইসব অনুষ্ঠানে যোগ দেননি রবীন্দ্রবিদূষক প-িত ভূবনমোহন বিদ্যার্ণব। তবে রবীন্দ্র প্রয়ানে (৯ আগস্ট ১৯৪১) শিলচরে বারিবর্ষণের মধ্যেই সহ¯্রাধিক জনতা প-িত শ্রীযুক্ত ভুবনমোহন বিদ্যার্ণব মহাশয়ের নেতৃত্বে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।’
রবীন্দ্রপ্রয়াণে ভুবনমোহন বিদ্যার্ণবের মতো শোকাহত হয়েছিলেন সিলেটের মানুষ। তাই ‘কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য শ্রীহট্টের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কতকগুলি দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়।’ (সংক্ষেপিত)