কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ও ইকারুসের ডানা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ আগস্ট ২০২৩, ২:৪১:৫২ অপরাহ্ন
শেখর ভট্টাচার্য
‘দর্শক স্বাগত জানাচ্ছি, আমি অপরাজিতা। বাংলাদেশের টেলিভিশন ইন্ড্রাস্টিতে প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স প্রেজেন্টার হিসেবে থাকছি।’ অপরাজিতার পরে হয়তো বাংলাদেশে আরও উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সংবাদ পাঠ করা হবে। কিন্তু অপরাজিতা দর্শকদের কাছে সব সময় প্রথম হয়েই থাকবে। গত ১৯ জুলাই বুধবার সন্ধ্যে সাতটার খবর পাঠ করে ‘অপরাজিতা’। গাঢ় নীল শার্ট ও কোট পরিহিত অপরাজিতার সংবাদ পাঠ দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা অপরাজিতা কোন মানুষ নয়। সংবাদ পাঠের সময় অন্য সংবাদ পাঠক অপরাজিতাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘অপরাজিতা আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। প্রথম দিনে দর্শকদের জন্য কী খবর নিয়ে আসছেন, প্রথম দিনে কী থাকছে আপনার কাছে। জবাবে অপরাজিতা স্বাভাবিক মানুষের মতোই, অন্য সংবাদ পাঠককে বলা শুরু করে, ‘আপনাকে ধন্যবাদ’। ‘আপনাদের মতো করে আমিও চেষ্টা করবো নিউজ পড়ার। কতটুকু সম্ভব হবে জানি না।’
পরে খবর পড়া শুরু করার পূর্বে দর্শকদের উদ্দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই পাঠক বলে, ‘দর্শক স্বাগত জানাচ্ছি, আমি অপরাজিতা। এরপরই খবর পাঠ শুরু হয়। এমনকি অপরাজিতা প্রতিনিধিদেরকেও তার খবর পাঠের সাথে যুক্ত করে।
আমাদের দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা ও ব্যবহার খুব সীমিত। তাই অপরাজিতা ১৯ জুলাই দর্শকদের চমকে দিয়েছিলো। এর আগে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর, বুধবার রাজধানী ঢাকায় রোবট রেস্টুরেন্টের যাত্রা শুরু হয়। এটি বাংলাদেশে প্রথম রোবকি রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টে রোবটের মাধ্যমে কাস্টমারদের খাবার সরবরাহ করা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি নতুন মাইলফলকের সূচনা হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সংগঠিতভাবে শুরু হয় অনেক পূর্বে। যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে আমাদের মতো দেশে পঠন , পাঠন, চর্চা শুরু খুব বেশি দিনের কথা নয়। ১৯২০ সালে ‘রুশম’স ইউনিভার্সেল রোবটস’ নামে একটি সায়েন্স ফিকশন থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। জন ম্যাকার্থি সর্বপ্রথম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, এ আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামক টার্ম বা পরিভাষাটি ব্যবহার করেন ১৯৫৫ সালে। ১৯৫৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের হ্যানোভারে অবস্থিত, ডার্টমাউথ কলেজের এক কর্মশালায় প্রথম এআই গবেষণা ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ।
ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন গবেষণালয় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য সংবাদ নিলে বুঝা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানা প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে আমরা কতোটুকু পিছিয়ে আছি। এই পর্যায়ে বলে নেই আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোন গবেষক নই, এ বিষয়ে আমার যতো ধারণা তা দেশ বিদেশের নানা সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোতে নানা উদ্ভাবনের ধারাবাহিক সংবাদ জানা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়টি কী? একটু সহজ করে বলি। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। কম্পিউটারকে মিমিকস কগনেটিক এককে আনা হয় যাতে করে কম্পিউটার মানুষের মত ভাবতে পারে। যেমন শিক্ষা গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল মেশিন দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগ করে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পত্রিকা ফরচুনের তথ্যমতে, প্রায় পাঁচশ নামকরা প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। প্রথাগত পরিবহণ ব্যবস্থাড় পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমতার বদৌলতে স্বয়ংক্রিয় পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সমাধানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন রোবটকে মানুষের বন্ধুভাবাপন্ন করে তৈরি করা সম্ভব।
জানা যায়, জাপানে ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সংবাদমাধ্যম কোম্পানি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানীর অভিমত, আগামী ১২০ বছরের মধ্যে মানুষ তাদের সব কাজ বুদ্ধিমান মেশিনের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারবে।
স্টাম্পফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের দাবি, তাদের তৈরি করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহজেই শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা করে মানুষের মৃত্যু কবে হবে, সেটা গণনা করে বলে দেবে। ৫০টিরও বেশি দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য রোবট তৈরি করছে, যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করবে এবং শত্রুকে মোকাবিলা বা হত্যা করার মতো কাজগুলো করবে। বর্তমানে এ ধরনের রোবট এবং ড্রোনের গবেষণায় প্রচুর অর্থও ব্যয় করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রোবট ২০৫০ সালের মধ্যে সব মানবিক কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে রোবট। শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে নানা ব্যবসায়িক কাজে এর ব্যবহার বাড়ছে। এর বাইরে বেশি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে প্রতিরক্ষা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, নতুন প্রযুক্তির কারণে বিশ্বে ১৩ কোটিরও বেশি কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। ডাটা অ্যানালিস্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপার, সোশ্যাল মিডিয়া স্পেশালিস্ট এ ধরনের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে। এ ছাড়া শিক্ষক বা কাস্টমার সার্ভিস কর্মীর মতো কাজ, যাতে কিনা অনেক সুস্পষ্ট মানবিক গুণাবলির দরকার, সেরকম অনেক কাজও করতে সক্ষম হবে যন্ত্র।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে ক্রমাগত একটি ভয় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা হলো মানব সম্পদের ব্যবহার ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা। রোগ নির্ণয়, রোগ নিরাময়, উৎপাদনের মতো ইতিবাচক দিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যাপক প্রভাব কাজে লাগতে পারে, এটি এখন প্রমাণিত। এর সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েও বিজ্ঞানী ও নীতি নির্ধারকদের মধ্যে সতর্কতার সাথে আলোচনা চলছে।
‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ এর মতে, ২০২২, ২০২৩ সালের মধ্যে রোবটের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। ইলন মাস্ক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নকে ‘দৈত্যকে ডেকে আনার শামিল’ আখ্যায়িত করে এটাকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর হুমকি হিসাবে অভিহিত করেছেন।’
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, ‘এরা এক সময়ে আমাদের অতিক্রম করে যাবে। এর ফলে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে।’ গুগলের প্রধান নির্বাহী সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার রুখতে নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলা। কীভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার হতে পারে, তা নিয়ে আগেই ভাবা উচিত। শুধু নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করলেই চলবে না, সে প্রযুক্তির ব্যবহার যেন মানবসভ্যতার বিপক্ষে না যায়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ হিসাবে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি জোরদার করতে হবে। মোটকথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক ব্যবহার কঠোরভাবে রোধ করে এর ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে কোন উদ্ভাবনের ইতি, নেতি দুটো দিকই রয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্সের (এজিআই) দিকে এগোবে। এটি এমন একটি সীমা যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠবে বা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে। মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও চ্যাটজিপিটির উদ্ভাবক ওপেন এআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য এজিআই অর্জন। প্রতিষ্ঠানটির নথি অনুযায়ী, তারা এজিআই অর্জনের লক্ষ্য ঠিক রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে ধারণা করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এজিআই অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
নীতিবিদ্যার সেই সর্বজনীন কথাটি মনে রাখতে হবে। চাকু দিয়ে সার্জন যেমন অস্ত্রপোচার করে রোগীর দীর্ঘ দিনের রোগ নিরাময় করতে পারেন একই ভাবে চাকু যখন দুর্জনের হাতে পড়ে তখন সেই চাকু মানুষের জীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীক পুরাণের সেই গল্পটির কথা আমাদের স্মরণ করা উচিৎ; কারাগারের নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ভাস্কর ডিডেলাস এক জোড়া মোমের ডানা আবিষ্কার করেন। একটি তাঁর নিজের জন্য এবং অন্যটি পুত্র ইকারুসের জন্য। ডিডেলাস ইকারুসকে বার বার সতর্ক করে দেন, সে যেন ডানা ব্যবহার করে বেশী উপরে না ওঠে ,কারন এতে সূর্যের তাপে মোম গলে যেতে পারে । কিন্তু ইকারুস পিতার কথায় কান না দিয়ে , আকাশে ওড়ার আনন্দে সব ভুলে যায়,একসময় উড়তে উড়তে অনেক উপরে উঠে যায় ইকারুস। প্রখর সূর্য তাপে মোম গলে গিয়ে পাখা ভেঙ্গে যায় আর ইকারুস সমুদ্রে পতিত হয়ে চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্ভাবন যেনো মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত সৃষ্টিশীল চিন্তার উৎসকে ধ্বংস করতে না পারে । মানুষের কল্যাণের জন্য এ আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমস্ত গবেষণা নিবেদিত হোক, উদ্ভাবিত হোক, ব্যবহৃত হোক অবারিত ভাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।