সিলেটে ডায়াবেটিস রোগীদের সুগার মেশিন, স্ট্রিপ ও ওষুধের দাম বেড়েছে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ২:২৯:৩২ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম
নিরব ঘাতক বলা হয় ডায়াবেটিসকে। সিলেটে ঘরে ঘরে ডায়াবেটিসের রোগী বাড়ছে। এদিকে, রোগী বাড়ার সাথে, বেড়েছে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম। কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম সর্বনিম্ন ১৬ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। মূল্য বৃদ্ধির জন্য ডলারের দাম বাড়ার অজুহাত দেখানো হচ্ছে। অন্যদিকে, মূল্য বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেটের কারসাজি থাকতে পারে বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
সিলেটে ডায়াবেটিস রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে একমাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল। এই হাসপাতালে বর্তমানে নিবন্ধনকৃত ১ লাখ ৩১ হাজার ১৯৯ জন রোগী রয়েছেন। তার মধ্যে পুরুষ ৬৪৯১২ জন এবং মহিলা রোগী ৬৬২৮৭ জন।
হাসপাতালের সূত্র মতে, ২০২২ সালের জুন মাস থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত নতুন নিবন্ধন করেছেন ৭৫০০ রোগী। তবে নিবন্ধনের বাইরে সিলেটে কয়েকগুণ রোগী রয়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
বিশাল এই রোগীদের অধিকাংশই ওষুধ নির্ভর। আবার সচেতন অনেকে ওষুধ না খেয়ে ইতিবাচক জীবনচর্চায় অভ্যস্থ। নিত্যপ্রয়োজনীয় সেই ওষুধের দাম গত ছয়মাসে কয়েক দফায় বেড়েছে। এতে হিমশিস খাচ্ছেন কম আয়ের মানুষ। খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলছেন, ওষুধের কাচামাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সেগুলোর দাম বেড়েছে। পৃথিবীর চলমান সংকট অব্যাহত থাকলে আরো দাম বৃদ্ধি পাবার আশংকা করছেন তারা। অন্যদিকে, বাংলাদেশের কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির নেতৃবৃন্দ মূল্যবৃদ্ধির জন্য ডলারের পাশাপাশি সিন্ডিকেটকেও দায়ী করছেন।
ডায়াবেটিসের অনেকগুলো ওষুধের মধ্যে রোগীর সুগার মাপার মেশিন ও স্ট্রিপ রয়েছে। রোগসচেতন অধিকাংশ মানুষের ঘরে সেগুলো রাখা হয় নিয়মিত। বাজারে জার্মান, থাইওয়ান, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, চীনসহ বেশ কিছু দেশের স্ট্রিপ পাওয়া যায়। জার্মানের নামকরা কোম্পানি অ্যাকু-চেক উৎপাদিত স্ট্রিপ এর চাহিদা বাজারে বেশী। এই স্ট্রিপ দিয়ে প্রতিদিন ডায়াবেটিসের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক। গত অন্তত ছয়মাস আগে ৫০টি স্ট্রিপের প্রতিকৌটার মূল্য ছিলো ৭৫০ টাকা। বর্তমানে খুচরা বাজারে সেই কৌটা ১১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনেকে ১১৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন।
এই কোম্পানীর স্ট্রিপ এর মতো আরেকটি প্রয়োজনীয় ওষুধ হচ্ছে রোগীর সুগার মাপার মেশিন। অ্যাকু-চেকের একটি মেশিনের দাম আগে ছিল ২৬৫০ টাকা, এখন হয়েছে ৩২০০ টাকা। একই কোম্পানির সুগার মাপার অ্যাকু-কে স্ট্রিপ ১১২০ থেকে ১৩০০ টাকা হয়েছে।
বাগবাড়ী এলাকার বাসিন্দা ফরিদ আহমদ, মধুশহীদ এলাকার নাসির আহমদসহ বেশ কয়েকজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সাথে কথা হলে তারা অভিযোগ করে বলেন, নিয়ম করে ডায়াবেটিসের ওষুধ খেতে হয় প্রতিদিন। কিন্তু এখন যে অবস্থা, ওষুধ চালিয়ে যেতে হলে খাবার সদাই কমিয়ে আনা ছাড়া উপায় দেখছিনা।
ডায়াবেটিস সামগ্রী বিক্রেতা সিলেটের পুরনো প্রতিষ্ঠান ইদ্রিস মার্কেটের সিলেট সায়েন্টিফিক স্টোর্স কর্তৃপক্ষ জানান, ছয় মাসের মধ্যে ডায়াবেটিসের সব প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধিটা এর পেছনে অন্যতম একটা কারণ।
সিলেট নগরীর তালতলা জীবিকা ফার্মেসীর কর্ণধার এহতেশামুল হক রানা বলেন, পৃথিবীর বর্তমান যে অবস্থা বিরাজ করছে সেই প্রভাব ওষুধেও পড়েছে। শুধু ডায়াবেটিসের নয়, অধিকাংশ ওষুধের দাম বেড়েছে।
একইভাবে অন্তত ছয় মাসের ব্যবধানে ১১৫০ টাকার জি-এম (৫৫০) সুগার মাপার মেশিন বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ টাকায়, ৭০০ টাকার পামচেক ৯০০ টাকা. ১০০০ টাকার বিভা ১৩০০ টাকা, ১০০০ টাকার কইনিস ১২০০ টাকা এবং ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার বেসচেক বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১১০০টাকায়।
ছয় মাস আগে থাইওয়ানের জি-ওয়ান এডভান মেশিনটি ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেই মেশিন বর্তমান বাজারে ১৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এভাবে বেশ কয়েকটি দেশের সুগার মাপার মেশিন পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। যেগুলোর মূল্য ছয় মাসের ব্যবধানে তিন থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে সিরিঞ্জের দাম। তিন মাস আগে জেএমআই এর সিরিঞ্জ বিক্রি হয়েছে ৩৭০ টাকায়। বর্তমানে সেই সিরিঞ্জ ৪১০টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
স্ট্রিপ এবং সুপার মাপার মেশিনের মতো বেড়েছে ওষুধের দাম। কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম সর্বনিম্ন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। স্কয়ার কোম্পানীর ডায়াবেটিসের প্রতি পাতা কমপ্রিড (৮০ এমজি) ট্যাবলেট ৭০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ টাকা, নিপ্রো জেএমআই’র লিজেন্টা এম (৫০০এমজি) প্রতি পিস বারো টাকা থেকে ১৩ টাকা, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল এর ডাইমেরল (৮০এমজি) প্রতিপিস ৭ থেকে ৮ টাকা, স্কয়ার কোম্পানীর ডিগলিমেট (৫০০ এমজি) প্রতি পাতা ১৬ থেকে ২০ টাকা, লিগজিড়/এম (৫০০এমজি) পাতা প্রতি ১৫ থেকে ১৮ টাকা, বেক্রিমকো’র ট্রানেডা (৫০ এমজি) পাতা প্রতি ১৫ থেকে ১৮ টাকা হয়েছে। ওষুধের সাথে বেড়েছে ডায়াবেটিক রোগীদের ইন্সুলিনের দাম।
ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছেন, ডলারের দাম বাড়ায় টাকার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ওষুধের কাঁচামাল, প্যাকেজিং ও বিদ্যুৎ সবকিছুতেই দাম বেড়েছে। কিন্তু সেভাবে ওষুধের মূল্য সমন্বয় হয়নি। সে জন্য তারা এটাকে মূল্যবৃদ্ধি না বলে উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে দামের সমন্বয় বলছেন।
সিলেট চেম্বারের সাবেক পরিচালক ও ওষুধ ব্যবসায়ী মুকির হোসেন চৌধুরী বলেন, অধিকাংশ কাঁচামাল বিভিন্ন দেশ থেকে আনতে হয়। অনেক ওষুধ আছে, যেগুলো সরাসরি বিদেশ থেকে আসে। বর্তমানে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সবকিছুর দামই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বেড়েছে ওষুধের দামও।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল’র একজন কর্মকর্তা সাগর চন্দ্র। কথা হলে তিনি জানান, আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করি। সবকিছু বলতে পারছিনা। তবে ওষুধের দাম বাড়ার বিভিন্ন কারণের একটি কারণ হচ্ছে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি। ডেনমার্কভিত্তিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নভো নরডিস্ক। বাজারে তাদের বেশকিছু ইন্সুলিন রয়েছে। কথা হলে তিনিও দাম বৃদ্ধির জন্য ডলারকে দায়ী করেছেন।
এ ব্যাপারে কথা হলে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট মইনুল হোসেন বলছেন, ‘সবাই ডলারের দোহাই দিয়ে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করছে। এর পেছনে একটি সিন্ডিকেটও কাজ করছে, সে ব্যাপারে কেউ কথা বলেনা।’
ডায়াবেটিস রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে কথা হলে সিলেট ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান আহমদ জানান, ‘শুধু বৃদ্ধি নয়, লাগামহীনভাবে বেড়েছে। তিনি বলেন, সিলেটে ডায়াবেটিস রোগী কল্পনার বাইরে। তার মধ্যে আশি ভাগ মানুষ জানে না, তার রোগের কথা। অন্যদিকে এ চিকিৎসা ব্যয়বহুল। যে অবস্থায় মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে, এতে বিপাকে পড়বেন কম আয়ের মানুষ।’
দেশে বর্তমানে এক কোটি ৩১ লাখ ডায়াবেটিক রোগী রয়েছেন। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হতে পারে। অন্তত ১৩০ কোটি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত অবস্থায় থাকতে পারেন। রোগ মোকাবিলায় কাঠামোগত বিভেদ ও দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে এমন পরিস্থিতি হতে পারে। বিশ্বে প্রতিটি দেশেই ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বে আনুমানিক ৫২ কোটি ৯০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। রোগটি মানুষের মৃত্যুর শীর্ষ ১০ কারণের একটি। এ ছাড়া, ডায়াবেটিস বহু মানুষের শারীরিক সক্ষমতাও কেড়ে নেয়।