বৃদ্ধাশ্রম বনাম মূল্যবোধ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১০:৪২:১৪ অপরাহ্ন

সুব্রত দাশ
গত ১ আগস্ট ২০২৩ খ্রি. তারিখে দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পাতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রজেন্দ্র কুমার দাসের ‘বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম : সুসংবাদ নয়’ শীর্ষক লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। লেখাটি পড়তে স্বাভাবিকভাবে যতটুকু সময় লাগার কথা তার চেয়ে একটু বেশিই সময় লেগেছে। লাইনের পর লাইন পড়ে যাচ্ছিলাম আর বিষয়ের সূত্র ধরে নিজ জীবনে দেখা কিছু কিছু ঘটনার ছবি মানসপটে ভেসে উঠছিলো।
লেখক বিশ্ব মা দিবস, বাবা দিবস এর প্রচলনের ইতিহাস তুলে ধরে লেখার সূত্রপাত করেন এবং বলেন, এ দিবসগুলি পালনে মা-বাবারা আনন্দিত হবেন, পুলকিত হবেন, কখনোবা গর্বিত হবেন- যা স্বাভাবিক। কিন্তু বৃদ্ধ মা-বাবাদের সব আনন্দের মধ্যে এক বেদনার সুর সব আনন্দ গর্বকে ম্লান করে দেয় একটি শব্দ। সেই শব্দটি বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে আজ ভীষণ ভীতির সঞ্চার করে। এবং সেই কলঙ্কিত শব্দটি হলো- ‘বৃদ্ধাশ্রম’। এই ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটি কতটুকু ভীতিপ্রদ, তা লেখক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালদ্ধ একটি ঘটনার উল্লেখের মাধ্যমে তুলে ধরেন। তিনি খবরের পাতা থেকে রফিকুল ইসলাম নামীয় একজন চিকিৎসক, যার চার ছেলের ২জন ডাক্তার, ২জন ইঞ্জিনিয়ার, কিভাবে তাঁর ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রমে হলো, সেই মর্মান্তিক কাহিনী উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেছেন, বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি লন্ডন-আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে মানানসই হলেও বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে তা একেবারেই বেমানান। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের যৌথ পারিবারিক পরিবেশকে আশ্রম, তপোবন, শান্তি নিকেতন ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করেছেন। লেখাটি শেষ করেন চীনের বিখ্যাত দার্শনিক ধর্মগুরু কনফুসিয়াসের একটি গল্প দিয়ে। যেখানে একজন যুবক তার বৃদ্ধ বাবাকে খর¯্রােতা নদীতে ভাসিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তখন কনফুসিয়াস বলেছিলেন, দ্যাখো বাবা, তুমি যখন তোমার বাবার মতো বৃদ্ধ হবে তখনও এই নদীটি থাকবে। তুমি বৃদ্ধ হলে তোমার ছেলেও এমনিভাবে তোমাকে কাঁধে নিয়ে নদীতে ফেলবে। যুবকটি নিরস্ত হয়েছিল। এবং এই ঘটনার সূত্র ধরে সামাজিক অনাচারটি বন্ধ হয়েছিল।
সবকিছুই লেখক সাবলিল ভাষায় তুলে ধরেন- যার কিছুটা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো। লেখাটি অত্যন্ত সময়োপযোগি, যা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে খুবই সহায়ক। এটি অত্যন্ত শিক্ষামূলক যা আমাদেরকে ভাবায় বা ভাবতে বাধ্য করে। চমৎকার এই লেখাটির জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। তবে লেখাটির মাধ্যমে একটি ভুল বার্তা পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারে। এই ভাবনা থেকেই আজকের এই পাঠ প্রতিক্রিয়ার অবতারণা।
সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নানা বাস্তবতার যৌথ পরিবারগুলি আজ আর নেই বললেই চলে। জীবন জীবিকার ধরনও বদলেছে। বেড়েছে গতি, বেড়েছে চাপ। বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের এই দুনিয়ায় লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটছে মানুষ। চারদিকে অস্থিরতা, মনুষ্যত্ব, বিবেক, সততা, নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত, মূল্যবোধের অবক্ষয়, তা তো এক চরম বাস্তবতা। করোনাকালীন সময়ে আমরা এমন খবরও সংবাদপত্রে দেখতে পেলাম যে, সন্তান তার বৃদ্ধ বাবা কিংবা মাকে চটের বস্তার ভিতর ঢুকিয়ে জঙ্গলে ফেলে এসেছে। অনেক যুবক-যুবতী নিজ নিজ স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি নিয়ে আলাদা বসবাস করছে এবং তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতার কোন খোঁজখবর রাখছে না। অনেক অসহায় পিতামাতাকে পূত্র ও পূত্রবধূ ধারা পরিত্যাক্ত হয়ে অসহায়ভাবে ভীক্ষাবৃত্তি করে জীবন ধারণ করতে দেখা যায়। সম্ভবত এমন বাস্তবতার নিরিখেই পিতামাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। আইনটি বৃদ্ধ পিতামাতার দুর্দশা লাঘবে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমার নিজ জীবনে দেখা কিছু ঘটনা হতে একটির কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ধরা যাক ‘ক’ তার স্ত্রী ‘খ’, স্কুল পড়–য়া দুই সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে শহরে বসবাস করেন। ‘ক’ ও ‘খ’ দুজনই উচ্চশিক্ষিত এবং সরকারি চাকরীজীবি। বৃদ্ধা খুবই অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। ‘খ’ এর কথা হলো কোনভাবেই শাশুড়িকে বাসায় রাখাটা সম্ভব না। তিনি বিছানাপত্র পায়খানা প্র¯্রাব করে নষ্ট করে ফেলেন। বাসার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনাও ঠিকভাবে হচ্ছে না। তাই বৃদ্ধাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। একদিন বৃদ্ধা আমাকে কাছে পেয়ে বলেন, তিনি গ্রামের বাড়িতে যেতে চান না। তাকে জোর করে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে গেলে তিনি মারা যাবেন। বৃদ্ধার অসহায়ত্ব আমি দেখেছি। আমাকে আরো বলেন, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোটাই আমার জীবনে একটি বড় ভুল ছিলো। এক সময় বৃদ্ধাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরের ইতিহাসটি কী হতে পারে তা না বললেও নিজেদের মতো করে ধারণা করে নিতে পারেন। এরকম চিত্র সমাজে অহরহ দেখতে পাওয়া যাবে। কিছু কিছু ঘটনা সংবাদপত্রের কল্যাণে বা অন্য কোন মাধ্যমে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তা প্রকৃত চিত্রের নির্দেশক নয়। এর ব্যাপকতা আরও বিশাল। অনাহারে-অনিদ্রায়, বিনা চিকিৎসায়, অনাদরে, অবহেলায়, অসম্মানজনকভাবে কত যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন তার হিসাব কে রাখে! এমন বাস্তবতায় বৃদ্ধাশ্রম একটি বিকল্প অবলম্বন হতে পারে বলে আমি মনে করি। তবে আমাদের লক্ষ্য থাকবে এমন বাস্তবতা যাতে তৈরী না হয় যাতে করে একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে তার শেষ জীবনে এসে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। তবে যদি বৃদ্ধাশ্রমের সত্যিকার প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতা এই সমাজ রাষ্ট্রে বিদ্যমান থাকে আর আমরা যদি বৃদ্ধাশ্রম শব্দটিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করি, তাহলে এর উপযোগিতা কিন্তু এতটুকু কমে যায় না। মোদ্দাকথা, সমস্যার কোন সমাধান হবে না। বরঞ্চ সমস্যা সমাধানের মন্দের ভালো একটি বিকল্প ব্যবস্থাকেও গলাটিপে বিনষ্ট করা হবে, যা কাম্য নয়। জীবন সায়াহ্নে এসে সকলেই চাইবেন একটু সম্মান, একটু নিরাপত্তা, ভাত-কাপড়-চিকিৎসার নিশ্চয়তা এবং একটি স্বাভাবিক মৃত্যু। বর্তমান সমাজ
বাস্তবতায় বৃদ্ধাশ্রম যদি সামান্য হলেও অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দুর্দশা লাঘবে একটি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে তাতে মন্দ কী।
বৃদ্ধাশ্রম শব্দটির প্রতি যেন ঘৃণা তৈরি না হয়। যেখানে ব্যাক্তি, পরিবার কিংবা সমাজ ব্যর্থ হয় প্রবীণ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নর-নারীকে উপযুক্ত সম্মান জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা বিধানে সেখানে এটিকে দেখা দরকার প্রবীণবান্ধব একটি বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাই লেখকের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি কলঙ্কিত নয়, কলঙ্কিত হচ্ছে তারা, যারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বৃদ্ধাশ্রমের দিকে ঠেলে দেয়। তাই বৃদ্ধাশ্রম শব্দটির প্রতি কোন নেতিবাচক ধারণা নয়। বরং আমরা এটিকে ইতিবাচকভাবে কিছু হতভাগ্য মানুষের জীবন সায়াহ্নের আশ্রয় হিসেবে দেখতে পারি।
লেখক ব্রজেন্দ্র কুমার দাস এর ‘বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম : সুসংবাদ নয়’ শীর্ষক লেখায় আবেগের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। হয়তোবা বিগত দিনের যৌথ পারিবারিক জীবনের আনন্দময় স্মৃতিতাড়িত হয়ে স্বাভাবিকভাবেই নষ্টালজিক হয়ে পড়েছিলেন। তার এই লেখায় সমস্যা সমাধানে বৃদ্ধাশ্রমের উপযোগিতার দিকটি এবং সমস্যা সামাধানের আশু বিকল্প ব্যবস্থা কী হতে পারে তা আলোচিত হলে বা স্থান পেলে লেখাটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠত। ধারণা করি, তখন হয়তোবা তিনি ‘বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম, দুঃসংবাদই, কোন সুসংবাদ নয়’ এমন সরল সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতেন না।
সুশিক্ষা, নীতিনৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রীয় আইনকানুনসহ নানাভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কোন বৃদ্ধ পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমের মতো কোন প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবতে না হয়। মানবতা বিবর্জিত কার্যকলাপ, মনুষ্যত্বহীনতা, স্বার্থপরতার প্রতি তৈরী হোক যুথবদ্দ ঘৃণা, বৃদ্ধাশ্রমের প্রতি নয়।
লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, সিলেট।