বিজ্ঞান মনস্কতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১০:৫১:২২ অপরাহ্ন
রঞ্জিত কুমার দে
পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানের জয়জয়কার। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের সাথে এগিয়ে চলেছে সভ্যতা। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই বিজ্ঞানমনস্কতার দারুণ অভাব। অনেক দেশের মানুষের মতো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষও বিজ্ঞানমনস্ক নয়। বিজ্ঞানের অসাধারণ সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করেও আমাদের চিন্তা চেতনায় তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, গতানুগতিক চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন অসংখ্য মানুষ এখনও সব আকড়ে ধরে আছে। অথচ বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি থাকা একান্ত প্রয়োজন। বিজ্ঞানমনস্কতা বলতে বোঝায় বিজ্ঞান সম্মত সচেতনতা। আমাদের মধ্যে এমন বোধ জন্মানো যাতে আমরা সঠিক তথ্য ও সত্য উদঘাটন করে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা কার্যকর করতে পারি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন করার, তুলনা করার, যাচাই করার মানসিকতা অপরিহার্য। আর যাচাই করলেই সত্য তথ্য প্রমাণিত হবে। সুতরাং প্রশ্ন করার এবং উত্তর যাচাই করার যে মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি, সেটাই বিজ্ঞানমনস্কতা।
অতীতের ভালো যা কিছু মানুষ তা থেকেই শিক্ষা নেয়। যা কিছু যুক্তি তর্কে বিবেচনায়, পরীক্ষা নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ তা মানুষ নির্দ্ধিদায় মেনে চলে। বস্তুত কিছু আকস্মিক বা অস্বাভাবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি মানুষের মনে কুসংস্কার হয়ে বাসা বেঁধেছে। কোনো এক সুদূর অতীতে হাঁচি ও টিকটিকির শব্দ উপেক্ষা করে কোথাও যাত্রা করায় দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেটিই মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে কুসংস্কারে রূপ নিয়েছে। আগুন, কৃষি, পশুপালন, তামা-লোহা নিষ্কাশন পদ্ধতি, ব্রোঞ্চ তৈরির কলাকৌশল অ্যালকোহল, পাকা চামড়া, চাকা, নৌকা, ক্যালেন্ডার সহ অনেক কিছু আবিষ্কারের যুগকে বলা হয় প্রাক-বৈজ্ঞানিক যুগ। এমনকি খ্রিস্টের জন্মের তিন-চারশ বৎসরের মধ্যে লিউসিপাস ও ডেমোক্রিটাস কেবল যুক্তির সাহায্যে ‘অ্যাটম’ এর অস্থিত্ব কল্পনা করেছিলেন। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে বিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটেছে। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের সাথে মানুষ তার ধ্যান-ধারণার পথে সন্ধান পেয়েছে নতুনত্বের। মুক্তি ও পরীক্ষা নিরীক্ষার আলোকে মানুষ তার ধারণা ও বিশ্বাসকে সত্যের সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে মানুষ বিশ্বজগতের নিয়ম কানুন উন্মোচন করেছে, তা অধিগত করছে এবং বিজ্ঞানের সত্য ও মুক্তির সন্ধান লাভ করেছে। পরবর্তীতে মানব কল্যাণের প্রয়োজনে তা কাজে লাগিয়েছে। মানুষের মনে দীর্ঘকাল যেসব অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বদ্ধমূল ছিল, বিজ্ঞানের যুক্তি ও সত্যানুসন্ধানের প্রক্রিয়ায় সেসবের মূল উৎপাদিত হয়েছে।
গতানুগতিক বিশ্বাসেও জীবন যাপনে এদেশের মানুষ এতটাই অভ্যস্ত যে, তারা নতুন ধারণা, নতুন জ্ঞান বা নতুন চেতনাকে জানতে বা ধারণ করতে আগ্রহী নয়। এক সময় শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান আদরণীয় ছিল। বিজ্ঞান মনস্কতার প্রতি আগ্রহও লক্ষণীয় ছিল। কিন্তু ইদানীং এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তাই বলে যে বিজ্ঞানমনস্কতা হ্রাস পাচ্ছে না নয়। কেননা শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তবে তা সন্তোষজনক পর্যায়ে নয়।
বিজ্ঞান মনস্কতার প্রতিবন্ধকতা: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই যে বিজ্ঞানমনস্ক নয়, এর কতগুলো কারণ বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এগুলো হলো-
১. এদেশের মানুষ গতানুগতিক ধ্যান ধারণায় অভ্যস্ত ও বিশ্বাসী।
২. তারা বিজ্ঞানসম্মত ও কল্যাণকর নতুন কোনোকিছুকেই সহজভাবে গ্রহণ করে না।
৩. তারা বিজ্ঞানসম্মত নয় বলেই নিজেদের সম্পর্কে সচেতন নয়।
৪. অর্ধশিক্ষিত ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শ অনুসরণ করতেই ভরসা পায়।
৫. এদেশে শিক্ষিতের হার কম, তাই সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগে।
৬. নারীরা অতিমাত্রায় রক্ষণশীল হওয়ায় বিজ্ঞানমনস্কতার হার কম।
৭. অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের সক্রিয়তায় বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি তেমনভাবে গড়ে উঠতে পারেনি।
বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলেই বিজ্ঞানসম্মত হওয়ার উপায় রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত করে প্রকৃত সুখ ও স্বচ্ছ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।
বিজ্ঞানমনস্কতা সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেননা বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানমনস্কতার অনুষঙ্গ ছাড়া আমাদের আধুনিক সুসভ্য জীবন অচল। কেবল থাকবে সহযোগিতা ও সহানুভূতি, ¯েœহ-মমতায় শ্রদ্ধায় সাবলীল উৎসারণ আর বিজ্ঞানমনস্কতার কার্যকর বাস্তবায়ন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।