চেংড়া ভূত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ আগস্ট ২০২৩, ৫:৪৫:০০ অপরাহ্ন
সুলতান মাহমুদ
পাহাড়ি টিলায় আমার বসতি। ছোটো একটি ঘরে একা থাকি। ছোটবড় গাছপালায় ঘেরা জঙ্গলের মাঝে আমার ঘর। লোকে বলে এটা নাকি ভূতের টিলা। জাত-বেজাত ভূতের বসবাস এখানে। তাই এখানে কেউ থাকতে চায় না। তবে আমি থাকছি। ভূতপ্রেত মাঝে মাঝে বিশ্বাস করি, মাঝে মাঝে করি না। তবে এখানে উঠে আমি ভূতের দেখা পেয়েছি। চেংড়া টাইপের একটা ভূত। রাতে যখন জানালা খুলে বাতি নিভায়ে শুয়ে পড়ি, ঠিক তখনই চেংড়া ভূতটা গাছের ডালে বসে আমার সাথে গল্প জুড়ে দেয়। সে কী ভয়ংকর চেহারা। কেউ দেখলে জ্ঞান হারাবে। তবে আমি জ্ঞান হারাই না, আমার বুদ্ধি জ্ঞান কম তো, তাই সেটাকে হারানোর ভয় নেই বললেই চলে।
এক রাতে চেংড়া ভূতের সাথে আমার কথা হচ্ছিল। জ্যোৎস্না রাত। চেংড়া ভূতটা ডালে বসা। এ কী চেহারা তার! মাথায় হাতে পায়ে আঘাতের দাগ। রক্ত ঝরছে। লতাপাতা দিয়ে বেন্ডেজ বাঁধা। আমি দেখে রীতিমত চমকে উঠলাম। কীরে, এ কী দশা হয়েছে তোর? সে তখন রাস্তার জনতার হাতে মার খাওয়ার ঘটনাটি বললো। আমি
সমবেদনা জানিয়ে বললাম, ‘তুই সন্ধ্যাবেলায়ই ওভাবে প্রকাশ্য লোকালয়ে বের হলি কেন?’
‘আমি আসলে অতো কিছু ভাবিনি স্যার। অত্যধিক গরমে আমার ডেরায় টিকতে পারছিলাম না, তাই ভাবলাম খোলামেলা স্থানে গিয়ে কিছু ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে আসি। সে উদ্দেশ্যে জঙ্গলের পাশেই যে চিপা রাস্তা আছে, তার পাশে একটি ডালে বাঁদরঝোঁলা হয়ে দোল খাচ্ছিলাম। সন্ধ্যার পরে সাধারণত সেখানে লোকজন কেউ আসে না। মানুষকে ভয় দেখানোর ইচ্ছাও আমার ছিল না। তখন আর সন্ধ্যার লালিমা আভা তেমন নেই। ঝিঁ ঝিঁ পোকারা আলো জ্বেলে তাদের সমবেত সঙ্গীত গাইছিল। এমন সময় দু’জন লোক সেই রাস্তা দিয়ে আসছিল। একজন মধ্য বয়স্ক, অন্যজন আট নয় বছরের ছেলে। তাদের হাতে ছিল হ্যারিকেন। সম্ভবত বাপপোলা। তারা হাঁটছিল আর খোশগল্পে মশগুল ছিল। আমি কিম্ভুতকিমাকার ভূতুড়ে চেহারা নিয়ে ডালে ঝুঁলছি। মিহি কন্ঠে ভূতসঙ্গীত গাইছি। আমি ডালে আর তারা ঠিক আমার নিচেই। হঠাৎ করে ছেলেটার নজর পড়ল আমার দিকে। বিদ্যুতের শক খাওয়ার মত সে চমকে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। এত বড় হা করে সে আমাকে দেখছে যে, আমার মনে হল মাঝারি আকারের একটি পাখি অনায়াসে তার মুখে ঢুকে যেতে পারে। আমি দাঁত কেলানো হাসি দিলাম। ভূতদের দাঁত কেলানো হাসি মানে বুঝতেই তো পারছেন স্যার, পাবলিকের জান যায় যায় করে। কালো কুঁতকুঁতে চেহারায় মুলার মত সাদা দাঁতের হাসি দেখে সে অজ্ঞান হতে চাচ্ছিল। কিন্তু সে সোজা পথে গেল না। বাঁকা পথে পা বাড়াল। বালকটি আকাশফাটা চিৎকারের পথ বেছে নিল। ছেলের এহেন চিৎকারে বাবা কি আর চুপ করে থাকতে পারে? ছেলের সাথে তাল মিলিয়ে বাবাও দিল চিৎকার। বাবা ডানেবামে উপরে নীচে তাকিয়ে দেখল না কী কারণে ছেলে চিৎকার করছে। বাপপোলার গগনবিদারী চিৎকারে আমি থ হয়ে গেলাম। আমার ভূতবুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল। আমি তন্ত্রমন্ত্র সব ভুলে গেলাম। আশপাশের লোকজন এসে জড়ো হতে লাগলো। তারাও এসে চিৎকার শুরু করে দিল। তাদের সম্মিলিত চিৎকারে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম।
মানুষ যেমন আমাদের ভয় পায়, আমরাও তেমন মানুষের গণজমায়েত ভয় পাই। তবে এখানে আমি ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে গেলাম। এতকাল শুনেছি বাঙালি হুজুগে মারপিট ও দাঙ্গায় ওস্তাদ, এখন দেখি
হুজুগে চিল্লাচিল্লিতেও ওস্তাদ। চিল্লাতে চিল্লাতে ওদের একজন আমাকে দেখে ফেলল। ওরা সংখ্যায় অনেক, আর আমি একা। কাজেই আমার ভূতুড়ে চেহারায় জনতা ভয় পেল না। উল্টো আমিই ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে আমি থরথর করে কাঁপছি। আমার ভূতুড়ে চেহারা অদৃশ্য করে ওখান থেকে পালিয়ে যাবার মন্ত্রটাও ভুলে গেছি। কিছুতেই রূপ পরিবর্তন করতে পারছি না। আমার এই অসহায় অবস্থার সুযোগে জনতা আমার দিকে ধেয়ে এলো। নির্মমভাবে গণধোলাই দিল। কথায় আছে না, পাবলিকের মাইর, দুনিয়ার বাইর। কোনমতে পালিয়ে এসেছি। তারপর তো দেখতেই পারছেন অবস্থা!
‘এ ঘটনা থেকে তুই কী শিক্ষা নিলি?’ বললাম আমি।
বলল, ‘স্যার, জনতার রোষানলে পড়ার মত কোনো কাজ করা যাবে না। এমনটা করলে জনতা