৫ বছরও ছাত্রদলের রাজু হত্যার বিচার শেষ হয়নি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ আগস্ট ২০২৩, ৫:০১:২২ অপরাহ্ন
এ পর্য ন্ত ১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ
কাউসার চৌধুরী:
নগরের কুমারপাড়ায় প্রকাশ্যে খুন হওয়া,সিলেট ল’ কলেজের মেধাবী ছাত্র ফয়জুল হক রাজু হত্যা মামলায় ২৮ মাসে মাত্র ১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। বাদীপক্ষের অভিযোগ, বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করতে আসামিপক্ষ শুরু থেকেই নানা টালবাহানা করছে। এরই মধ্যে তিন আসামি আদালত চত্বরে বাদী দবির আলীকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকিও দিয়েছে। চাঞ্চল্যকর রাজু হত্যাকান্ডের ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শুক্রবার। বর্তমানে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আলোচিত এই মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে।
মামলার বাদী, নিহতের চাচা ও সিলেট জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. দবির আলী বলেন, মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুতগতিতেই চলছে। বিচার শুরুর পর আসামিপক্ষ নানা অজুহাতে প্রায় একটি বছর পার করেছে। বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আশা করি, কম সময়ের মধ্যে ন্যায় বিচার পাব। তিনি ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান।
সূত্রমতে, সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. শাহাদাত হোসেন প্রামাণিকের আদালতে গেল ১২ জুন শেখ মঈন উদ্দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এর আগে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি শেখ মো. আলী হোসেন সাক্ষ্য দেন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আর গত বছর বাকি ৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে গেল বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি মামলার বাদী মো. দবির আলীর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এর পর পর্যায়ক্রমে জাকির হোসেন উজ্জল,নজরুল ইসলাম,মো. ময়নুল করিম,আলমগীর হোসেন, গোলাম কিবরিয়া রাহুল, গোলজার হোসেন খোকন ও মজনুর রহমানের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।
২০২১ সালের ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার ২৬ আসামীর মধ্যে ২১ আসামীর উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। অভিযোগ গঠনের পর ওই বছরের ২২ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আসামিপক্ষ মোট ৭ বার সময় চেয়ে আবেদন করায় দফায় দফায় সাক্ষ্যগ্রহণ বিলম্বিত হয়। আসামিপক্ষের দফায় দফায় আবেদনের ফলে বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করা হয় বলে বাদীপক্ষ অভিযোগ করেন।
অভিযোগ গঠনের আগেও ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ৮ মার্চ ও ২৫ মার্চ সময় চেয়ে আদালতে আবেদন করে আসামিপক্ষ। এভাবে বার বার সময় চেয়ে আবেদন করা হলেও শেষ পর্যন্ত আদালত ওই আবেদন আমলে না নিয়ে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষীর প্রতি সমন ইস্যুর আদেশ দেন।
#বাদীকে হত্যার হুমকি………….
গত ১২ জুন সর্বশেষ শেখ মঈন উদ্দিন নামের এক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ওই দিন মামলার বাদি মো. দবির আলীও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। শেখ মঈন উদ্দিনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর আদালতের ২য় তলার বারান্দার সামনে এনামুল হক (৩১), একরামুল হক (২২) এবং শেখ মো. নয়ন মিয়া (৩০) নামের তিন আসামি বাদি দবির আলীকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে এবং আদালত থেকে বের হওয়ার সময় উপরোক্ত তিন আসামি বাদিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি আদালতকে অবহিত করেন বাদী দবির আলী। এঘটনায় ওই দিনই কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি জিডি করা হয়। জিডি নম্বর-১৩৫০।
# বিচারের মুখোমুখি যারা……………
মেধাবী ছাত্র ফয়জুল হক রাজু হত্যাকান্ডের অভিযোগে মোট ২৬ আসামির বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন আদালত। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়ার আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীর পুত্র আব্দুর রকিব চৌধুরী (৩৭), নগরের তেররতনের বজলুল হোসেন প্রকাশ বজলু মিয়ার পুত্র দেলোয়ার হোসেন দিনার (২৯), ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের বেতকুড়ির আব্দুল বারি প্রকাশ আব্দুল বারিকের পুত্র এনামুল হক (৩১), একই উপজেলার বাঘাইতলা গ্রামের আব্দুল বারি প্রকাশ আব্দুল বারিকের পুত্র একরামুল হক (২২), দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দির মৃত সুলেমান আলীর পুত্র মো. মোস্তাফিজুর রহমান (৩১), হবিগঞ্জ সদরের পইল মোল্লা বাড়ির মৃত শেখ সাজিদ মিয়ার পুত্র শেখ মো. নয়ন মিয়া (৩০), শাহজালাল উপশহরের সৈয়দ রেজাউল হকের পুত্র সৈয়দ আমিরুল হক সলিড (৩৭), তেররতনের মৃত বাবুল মিয়ার পুত্র ফরহাদ আহমদ (২৮), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের শ্রীঘর গ্রামের আব্দুল শুকুরের পুত্র সাদ্দাম হোসেন (৩১), সোনারপাড়ার মৃত মতিউর রহমান খানের পুত্র মুহিবুর রহমান খান রাসেল (১৮), তেররতনের দুলাল মিয়ার পুত্র রাসেল আহমদ ওরফে রাসেল ওরফে কালা রাসেল ওরফে কানা রাসেল (১৮), কানাইঘাটের ছোটদেশের (সত্তিপুর) মৃত কুদরত উল্লাহর পুত্র আরাফাত এলাহী প্রকাশ বাবু (৩৩), আলফু মিয়া, বিয়ানীবাজারের বালিঙ্গার মোফাক্কর আলী চৌধুরীর পুত্র মোফাজ্জল চৌধুরী মুর্শেদ (২৬), ছাতকের তাঁতীকোনার মৌলভী আব্দুল হক ওরফে আব্দুল হক (২য়) বাবুল মিয়া এর পুত্র শহিদুল হক সুফিয়ান (৩০), দক্ষিণ সুরমার গোয়ালগাঁওয়ের মৃত ইসলাম মিয়ার পুত্র নজরুল ওরফে জুনিয়র নজরুল (২৫), রায়নগরের (মিতালী ২৫), সিরাজুল ইসলামের পুত্র ফাহিম আহমদ তোহা (২৮), বিয়ানীবাজারের জন্দরপুরের মৃত আতিকুল হক চৌধুরীর পুত্র আফজাল প্রকাশ আবজল আহমদ চৌধুরী (৩০), দক্ষিণ সুরমার সিলামের (আখিলপুর) মৃত আব্দুল মালিক প্রকাশ মানিক চৌধুরীর পুত্র সাহেদ আহমদ চৌধুরী (২৫), তাহিরপুরের গোবিন্দশ্রী গ্রামের মৃত আব্দুল গফফারের পুত্র রুবেল মিয়া (২৪), দিরাইয়ের ভাটিপাড়ার আতাউল করিমের পুত্র মামুন আহমদ (২৫), জকিগঞ্জের নিলাম্বরপুরের মৃত ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীর পুত্র জুমেল আহমদ চৌধুরী (২৯), সিলেট শহরতলীর মীরেরচকের মৃত ইরশাদের পুত্র মুহিত ওরফে মুহিব (৩০), দক্ষিণ সুরমার চান্দাই পশ্চিমপাড়ার সৈয়দ শফিকুল কাদি বাচ্চু মিয়ার পুত্র মুর্শেদ আলম প্রকাশ রাহেল আহমদ (৩০), নগরীর ঝর্ণারপাড়ের টেনাই মিয়ার পুত্র জাবেদ আহমদ প্রকাশ জাবেদ (৩০) এবং লাখাই উপজেলার মোড়াকুড়ি গ্রামের শফিকুল ইসলামের পুত্র জামাল মিয়া প্রকাশ জালালের (২৩) বিরুদ্ধে দ-বিধি আইনের ১৪৩/৩৪১/১১৪/৩০৭/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০২/৩৭৯/৪২৭/৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
# ৮ আসামি পলাতক ……………..
হত্যাকান্ডের পরই প্রধান অভিযুক্ত সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আব্দুর রকিব চৌধুরী গোপনে লন্ডনে পালিয়ে যান। এছাড়াও শহিদুল হক সুফিয়ান, সাহেদ আহমদ চৌধুরী, মুর্শেদ আলম প্রকাশ রাহেল আহমদ, জাবেদ আহমদ ঘটনার পর থেকেই পলাতক। আদালতের জামিনে থাকা আলফু মিয়া, ফাহিম আহমদ ওরফে তোহা ও জুমেল আহমদ চৌধুরীও পালিয়ে যান। বর্তমানে তাদের কোনো খোঁজ নেই। মামলার ২৬ আসামির মধ্যে বর্তমানে ৮ আসামি পলাতক রয়েছে। বাকি ১৮ আসামি জামিনে মুক্ত রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
# এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা
২০১৮ সালের ১১ আগস্ট রাতে নগরীর কুমারপাড়া পয়েন্টে সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক ফয়জুল হক রাজুকে ছাত্রদলেরই আরেক গ্রুপের ক্যাডাররা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। তার শরীরে ৪০টিরও বেশি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, ছাত্রদলের ক্যাডার আব্দুর রকিব চৌধুরীর নেতৃত্বেই রাজুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রাজুর সাথে থাকা জাকির হোসেন উজ্জ্বল প্রাণে রক্ষা পেলেও সে আজও পঙ্গু। রোমহষর্ক ওই হত্যাকান্ডের তদন্ত শেষে গত ২০১৯ সালের ১২ মে কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক অনুপ কুমার চৌধুরী ২৬ জনকে আসামি করে বিচারিক আদালতে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্র নম্বর ১৭৫। সিলেট মহানগর দায়রা জজ মো. আব্দুর রহিমের আদালতে মামলার কার্যক্রম চলাকালে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে দ্রুত বিচার ও নিষ্পত্তির জন্যে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার পর বিজয় মিছিল থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় রাজুকে। রাজু ছাত্রদলে সম্পৃক্ত থাকলেও তার পুরো পরিবার ও স্বজনেরা বংশ পরম্পরায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত।