কিনব্রিজ সংস্কার প্রসঙ্গ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ আগস্ট ২০২৩, ১২:২২:৩২ অপরাহ্ন
গোলাম সারওয়ার
ইংরেজ শাসনামলে সিলেটের কিনব্রিজ নির্মিত হয়। তৎকালীন প্রশাসক, স্যার মাইকেল কিন-এর সময়ে নির্মিত হয় বলে এই সেতুটির নামকরণ হয় কিন ব্রিজ। ১৯৩৩ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু। ১৯৩৬ সালে জনসাধারণের চলাচলের জন্য কিন ব্রিজ চালু হয়। তৎকালীন সময়ে এর নির্মাণ ব্যয় হয় ৫৬ লক্ষ টাকা। নদী গর্ভের দুই প্রান্তে দুটি লোহার পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে লোহায় নির্মিত এই সেতু। লম্বায় ১১৫০ ফুট এবং প্রস্থে মাঝ বরাবর মূল স্প্যান ১৮ ফুট এবং দুই প্রান্তে ১৬ ফুট করে প্রশস্ত আছে।
সেতুটি খুলে দেওয়ার ৩৩ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে আমি প্রথম আরোহন করি। আমাদের তখন ‘উইললিস’ জীপ ছিল। জীপে চড়ে বাবার সাথে কিন ব্রিজ পাড়ি দেই। ৭ বছরের শিশু আমি পুলে উঠে ‘ফুল’ খুজতে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ পুলকে সুরমা নদীর ফুল বলা হয়েছিল, সেজন্য। লেখাটি লিখতে গিয়ে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় আমায় ক্ষমা করবেন, হে প্রিয় পাঠক। অনেক যন্ত্রণায় অতীষ্ট হৃদয় কিন ব্রিজটি নিয়ে লিখতে হলো। জানি না, যন্ত্রণার উপশম হবে কি-না।
কিন ব্রিজটি আজ ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। যান চলাচলের অনুপযোগী হয়েছে অনেক আগে থেকেই। পায়ে হেঁটে বা রিকশায় চড়ে পার হওয়াটাও এখন অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনীরা সেতুটির উত্তরাংশে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর লোহার স্প্যানে-কাঠের শক্ত পাটাতন বসিয়ে বেশ কিছুদিন চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। কয়েক বছর এভাবে চলাচলের পর কাঠের পাটাতনের বদলে আবার বালু-পাথরের ঢালাই দেয়া হলো। এরপর থেকে এভাবেই আছে। মাঝে মধ্যে পিচ ঢেলে এর সুরক্ষা করা হতো।
কিন্তু বিগত ৫ বছর ধরে কিন ব্রিজের কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এর জন্য কারো দায় নেই। অথচ হাজার হাজার নয়, প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ রিকশায়, পায়ে হেঁটে, মোটর সাইকেলে, সিএনজিতে পার হয়। সুরমা নদীর ওপর কিন ব্রিজ সহ এখন ৫টি সেতু। কিন্তু এই সেতু দিয়েই মানুষের সবচেয়ে চলাচল বেশি। মূলত এই সেতুটিই নগরের সেতুবন্ধন রচনা করেছে ১৯৩৬ সাল থেকে। এপার-ওপার মিলিয়েই আমাদের সিলেট নগর। নগরবাসীদের কথা বিবেচনা করে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত দ্রুত সংস্কারের জন্য। কিন্তু প্রশাসন বা যাদের ওপর এই সেতু সংস্কারের দায়ভার নিহিত আছে, তারা কেন জানি নির্বিকার। অথচ সংস্কারের জন্য কম টাকা বরাদ্দ হয়নি। ২ কোটি টাকার ওপরে বাজেট রাখা আছে বাঁকা রেলিং সোজা করার জন্য বা কংক্রিটের ঢালাই দেয়ার জন্য। তাও আবার সব জায়গায় কংক্রিটের ঢালাই দিতে হবে না। অনেক টাকা লাভের সম্ভাবনা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ গড়িমসি করছেন। কিসের আশায়? আরো বেশি বরাদ্দ পাবার জন্য?
মূলত সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে এই সেতু। সিটি কর্পোরেশন শুধু দেখভাল করে। এরপরও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে সংস্কারের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গত মাসের ২৫ জুলাই থেকে কাজ শুরু করতে চেয়ে ২ মাসের জন্য সেতু বন্ধের চিঠি দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগকে। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগ সেতু চলাচল বন্ধ রাখেনি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে হয়তো বা কোনো ভাগ বাটোয়ারা আসেনি। বিষয়টি যাই হোক, আমরা কিন ব্রিজের সংস্কার চাই। মানুষের চলাচলে যেন বিঘœ না ঘটে সেদিকে নজর দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ আমরা করতেই পারি। নয় কি?
সিলেট-১ আসনের হাইপ্রোফাইল মন্ত্রী আমাদের। আমরা আশা করব, তিনি যেন দ্রুত সমন্বয় করে যদি কোনো সমন্বয়হীনতা থেকে থাকে। কারণ, কিন ব্রিজের গুরুত্ব অনেক বেশি সুরমা নদীর ওপর নির্মিত অন্যান্য সেতুর চেয়ে। শহরের প্রাণকেন্দ্রের সাথে এটি যুক্ত। প্রশাসনেরও খুব কাছে এই সেতু। বাস লাইন, ট্রেন লাইন এই সেতুর খুব নিকটে। বুঝতাম যদি এই সেতুর কোনো গুরুত্বপর্ণ আবেদন নেই, তাহলে দ্রুত সংস্কারের দাবি করতাম না। এই যেমন, মধুবনের সামনে যে ফুট ওভারব্রিজ রয়েছে এটি যদি পড়েও যায়, ভেঙ্গে যায় তবু আমরা সংস্কারের দাবি করব না। কারণ, এটির কোনোই প্রয়োজন নেই আমাদের। বরং যানজট সৃষ্টির জন্য এটি একটি বড় কারণ। রাত গভীর হলে অপকর্মের ভয়াবহ রূপ যে এখানে অনুপস্থিত থাকে, নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই ফুট ওভার ব্রিজটি বরং খুলে নিলেই ভালো হয়।
কিন ব্রিজটি আমাদের অনেকের সাথে স্মৃতি বিজড়িত। ব্যবসা-বাণিজ্য ও উন্নতির সাথেও যুক্ত। প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার জন্যেও এর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই আমরা মনে করি, কিন ব্রিজটি ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই।
জালালী কবুতরেরও বাস এই সেতুতে। যখন কবুতরগুলো উড়াউড়ি করে বিক্ষিপ্ত মন তখন প্রশান্তি পায়। পর্যটকেরাও মুগ্ধ হয়ে কিন ব্রিজের আকর্ষণীয় ডিজাইনে কবুতরদের আবাসস্থল দেখে।
হে সংস্কারবিদগণ আপনারা দীর্ঘসূত্রিতা অবলম্বন করবেন না। কারণ, কিন ব্রিজ আমাদের ঐতিহ্য। কিন ব্রিজের সাথে আমাদের অনেক চাওয়া-পাওয়া জড়িত, অনেক লেনদেন জড়িত। আপনাদের না পোষালে যথাযথ স্থানে আত্মসমর্পণ করুন। সারেন্ডার করুন, তবুও কিন ব্রিজের সংস্কার কাজ যেন আর বিলম্ব না হয়।
আমাদের দুর্ভাগ্য, সরকারি দল এবং বেসরকারি দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেখে। উভয় দলই ক্ষমতায় থাকতে চায়। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির জন্য প্রশাসনিক কর্মকান্ডগুলো উদাসীন। যার যার ক্ষমতা পালন করতেই চায় না। বেসরকারি দলগুলোর উচিত সরকারি দলগুলোকে দেশ পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া। তাহলেই সরকার নির্বিঘেœ প্রশাসনিক জটিলতা নিরসনের জন্য উদ্যোগী হতে পারত। যদি উদ্যোগী না হয় তখন বেসরকারি দলগুলো সোচ্চার হলে সরকারের কি উপায় থাকত দায়িত্ব অবহেলা করার? কিন্তু না, আমাদের বেসরকারি দলগুলো বেসরকারি থাকতে চায় না কখনও। এই বিষয়টার জন্যেই জাতীয় জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। চরম হতাশা। চরম নৈরাজ্য। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকানো যাচ্ছে না, খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করা যাচ্ছে না, ওজনে কম দেয়া রদ করা যাচ্ছে না, প্রশাসনে ঘুষ-দুর্নীতি হ্রাস করা যাচ্ছে না, শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির জন্যই।
দুই পাড়ের সেতুবন্ধনের ঐতিহাসিক সাক্ষী এই কিন ব্রিজও ওই একই কারণে আজ ৫ বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ, অনিরাপদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে- কিন্তু কেউ দেখার নেই। আমাদের নেতা-নেত্রীরও অভাব নেই এই সিলেট নগরীতে। ওনারাও কিন ব্রিজ পাড়ি দেন। কিন্তু রাজনৈতিক ভ্রান্তির কারণে নজরে আনার কোনো সুযোগ পান না। এই যে ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে না এই নগরে, এই শহরে- কোনো নেতা বা কোনো নেত্রী কি কথা বলেন? সরকারি দলের নেতারা কথা বলেন না, কারণ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই ব্যস্ত। আর ওনাদের চেষ্টা বা প্রচেষ্টা কেমন করে যে ক্ষমতায় যাওয়া যায়।
আর আমরা সাধারণ পাবলিক। আমাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। মরার ওপর খাড়ার ঘা আর কি। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন সুরমা ব্রিজ বা কিন ব্রিজের গোড়ায় সিএনজিগুলো এলোপাথাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। আপনি পথচারি যে সহজেই এদের এড়িয়ে চলে যাবেন তা হবে না। আপনাকে সিএনজিতে নেয়ার জন্য কিন ব্রিজের গোড়া দখল করে রাখে। কী অপচেষ্টা। অথচ ট্রাফিক পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে। কারণ এরা তো পয়সা পায়। ওই দৃশ্য কি আমাদের নেতা-নেত্রীদের চোখে পড়ে না? প্রশাসনের তো নজরে আসবে না। কারণ, এরা পয়সা খেয়ে একেবারে অন্ধ।
ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমরা সাধারণ পাবলিকও অন্ধ। আমাদের এই অন্ধকার পরিবেশ কবে দূর হবে, নাকি হবেই না এই দোলাচলে পার হচ্ছে আমাদের জীবন।
লেখক : কলামিস্ট।