বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ৫:৫৪:৪৮ অপরাহ্ন
শেখর ভট্টাচার্য
জাতিসত্তার বিকাশ শুধু মাত্র রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনা। রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যদি সাংস্কৃতিক উপাদান যুক্ত না হয়, তাহলে জাতিসত্তার যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত হতে পারেনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন মূলত ছিলো রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন, এ আন্দোলনের সাথে যখন ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন একীভূত হলো তখন বাঙালির রাজনৈতিক লক্ষ্য স্থির হয়ে গেলো। প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য ছিলো ভাষার অধিকার, পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকার আদায়। কিন্তু দূরবর্তী লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো বাঙালির স্বাধীন একটি ভূখন্ড। বাঙালির নিজস্ব ভূখন্ড অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের সকল আন্দোলনের মিছিলে আমরা যেমন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব পেয়েছি একইভাবে কবি গুরুর প্রেরণা দায়ক উপস্থিতি পেয়েছি। প্রতিটি মিছিলে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সহযাত্রী ছিলেন। দেয়ালের লিখনে যখন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি উঠে এলো তখন বাঙালির দেশ প্রেমের মাত্রা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেলো। নিরস্ত্র বাঙালি যে বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে আধুনিক ট্যাঙ্ককে প্রতিহত করতে গেলো সে ছিলো অপার দেশ প্রেমের বহিঃপ্রকাশ।
৭ মে ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্ম গ্রহণ করেন এবং তিনি পরলোক গমন করেন ৭ আগস্ট ১৯৪১ সালে। বঙ্গবন্ধু জন্মগহণ করেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আর তাকে নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর জন্মের ৫৯ বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জন্মগ্রহণ করেন এবং এর পরে তিনি যখন তার সৃষ্টি সম্ভার বাঙালি জাতিকে উপহার দেন তখন বাঙালির স্বাধীন ভূখন্ডের বিষয়ে কেউ লক্ষ্য স্থির করা তো দূরের কথা, স্বপ্ন দেখাও বাস্তবতার নিরিখে অসম্ভব ছিলো।
রবীন্দ্রনাথ বাংলার স্বকীয়তা, বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ঠ, গ্রাম বাংলার অপরূপ বর্ণনা তুলে ধরেছেন তাঁর সাহিত্য কর্মে। রবীন্দ্রনাথ তার প্রতিটি সাহিত্য কর্মে বাঙালির জন্য ভবিষ্যত দর্শন রেখে গেছেন। বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সকল আন্দোলনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি চেতনায় অবস্থান করে জাতিসত্তার বিকাশে সাহস জুগিয়েছেন। সেই সাহস, সেই চেতনাকে ধারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব। বঙ্গবন্ধু যখনই কারাগারে যেতেন তাঁর সাথে অনিবার্য ভাবে থাকতো রবিন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। সে সঞ্চয়িতার কারাগারের সেন্সরের অগণন সিল পড়েছিলো। স্বাধীন বাংলার মাটিতে রবি ঠাকুরের প্রথম জন্মোৎসবকালে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এ কথা জানিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৮ মে’ প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা ‘তথ্য জানতে পাই।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের অগণন পদক্ষেপ থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনন্য এক আদর্শ ছিলেন। সংগ্রামী জীবনের দীর্ঘ যাত্রাপথের প্রতিপদে যখন ছিল পাকিস্তানি শাসকদের হিংস্র অত্যাচার, যখন দুঃশাসনে কারাগারের লৌহ প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর হাতছানি তার জীবনকে যন্ত্রণায় বেঁধে ফেলতো, তখন বেদনার মুহূর্তগুলোতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর বাণী বঙ্গবন্ধুকে সান্ত¡না দিতো বলে উল্লেখ করেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধুর ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কবিগুরুর আসন বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্তঃস্থলে। রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতন ও দুঃখদৈন্য সব মুহূর্তে তাকে দেখতাম, বিশ্ব বাণী আবৃত্তি করতেন- বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে যেন না করি আমি ভয়। কিংবা যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। প্রভৃতি অসংখ্য গানের টুকরো তিনি আবৃত্তি করে যেতেন- দুঃখ, দৈন্য আর হতাশায় ভরা অতীতের সেই দিনগুলোতে।’
বেগম মুজিবের স্মৃতিচারণের বরাতে দৈনিক বাংলা পত্রিকা লিখে- ‘সময় সময় আমার মনে হতো তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে আবেগময় আবৃত্তি, যেন তার জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে এক হয়ে মিশে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় আছে কবিগুরুর প্রভাব। পাকিস্তানের কবলে নিক্ষেপিত বাঙালি অন্তরকে বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের সঞ্জীবনী সুধায় উজ্জীবিত করেছেন।’ ‘কবি গুরুর প্রার্থনা ছিল- ‘বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পূণ্য হউক পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান।’ বিশ্বকবির প্রার্থনাকে বাস্তব রূপ দিতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।’
পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির ২৩ বছরের লড়াইয়ে অন্যতম প্রেরণাদাতা ছিলেন রবি ঠাকুর। তাঁর সাহিত্যের নানা শাখা এবং সঙ্গীতের বাণী ও সুর-মূর্ছনা মানুষের হৃদয় তন্ত্রীতে যে অনুরণন ঘটাত তা ভালবাসা ও বিপ্লবী চেতনায় মানুষকে উজ্জীবিত করত। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে তাঁর বিখ্যাত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গ্রহণ করার পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ন্যায় এ সঙ্গীতের প্রতিটি শব্দ এবং অন্তরা দেশপ্রেম এবং ভালবাসার চাদরে আচ্ছাদিত। আর সে কারণে বঙ্গবন্ধু যেখানেই কোন বড় আয়োজন থাকত- শিল্পীরা থাকতেন, তিনি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গাইতে অনুরোধ করতেন। শিল্পী জাহিদুর রহীম ও অজিত রায় বহু জনসভায় বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে এ গানটি পরিবেশন করেন। অসহযোগ আন্দোলেনের সময় এ গানটি অলিখিতভাবে বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।
কবি গুরু স্বাধীন বাংলাদশের বাস্তব রূপ দেখে যেতে পারেননি, স্বাধীন ভূখন্ডের আন্দোলনেও তিনি শামিল হতে পারেননি। তিনি অন্তরে যে অনিন্দ্য সুন্দর বাংলার স্বপ্ন দেখতেন সে স্বপ্নকে তার কবিতা, ছোটগল্পসহ অন্যান্য সৃষ্টি সম্ভারে এঁকে গেছেন। কবি গুরুর অঙ্কিত ছবিকে বঙ্গবন্ধু নানা আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যম বাস্তবে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘কবিগুরুর সোনার বাংলাকে পবিত্রতায়, স্নিগ্ধতায় অপরূপ করে তোলা বঙ্গবন্ধুর জীবনের পরম প্রার্থনা। আর এই জন্যই তিনি নেমেছিলেন সংগ্রামে। আর তাকে প্রেরণা যুগিয়েছিল কবিগুরুর বাণী। সে সময় বঙ্গবন্ধু সঞ্চয়িতা হাতে তুলে নিতেন। কারাগারে নিঃসঙ্গতায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল সঞ্চয়িতা। অনেক যতেœ রাখা সত্ত্বেও সঞ্চয়িতার কবিতা বহু ব্যবহারে পুরাতন হয়ে গিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চাকে গতিময় করবার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে যখন ভাষণ দান করেন তখন তাঁর সমগ্র সত্তায় অভূতপূর্ব আলোড়ন তরঙ্গিত হয়। তিনি আনন্দ-বেদনামিশ্রিত যে শব্দমালা উচ্চারণ করেন তা রবীন্দ্রানুগ। বাংলার মানুষ, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়ার সান্নিধ্য তাঁকে বিহ্বল করে তোলে। তিনি ক্রন্দিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় বড় ভালোবাসি’। রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার শেষে লিখেছেন, ‘সাতকোটি সন্তানের, হে মুগ্ধজননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি’। বিশ্বকবির এ ক্ষোভের কারণ নস্যাৎ করে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ করেন, কবিগুরুর এ কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। কারণ ‘আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে।’ বাস্তুভূমি থেকে বিতাড়িত উপেনের বেদনা বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়; রবীন্দ্রনাথ মাতৃভূমিকে প্রণতি জানাবার জন্য যে অকৃত্রিম শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন তা বঙ্গবন্ধুর আপ্লুত কণ্ঠে ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু নিবেদিত চিত্তে উচ্চারণ করেন, ‘নম, নম, নম সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি,/গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি’। রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কারণেই বারবার রবীন্দ্রবাণী উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে, তাঁর চেতনার গভীরতম প্রদেশে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অধিষ্ঠিত।
অভ্যন্তরীণ কুশীলবদের অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পর পাকিস্তানপন্থী হত্যাকারীরা ইতিহাসের চাকাকে পেছন দিকে ঘুরাতে চেয়েছিলো। ঘাতক এবং তাদের প্রভুরা ‘পাক-বাংলার’ স্বপ্নে বিভোর ছিলো এ’কারণে হত্যাকে যুক্তিসম্মত, আইন সম্মত করতে ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন ও অনুমোদন করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করে এক অদ্ভুত অবৈজ্ঞানিক, জোড়াতালি দেয়া হাস্যকর জাতীয়তাবাদকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। একুশ বছর বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ সহ স্বাধীনতার মৌলবাণী উচ্চারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা অলিখিতভাবে অনুৎসাহিত করা হয়। চন্ডীদাস, আবদুল হাকিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ধারণ করা জাতীয়তাবাদ যাকে অন্তরে ধারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং বাংলার মানুষ, সেই জাতীয়তাবাদকে বাংলার আকাশ বাতাস থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং সে চেষ্টা এখনও চলমান আছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তার পার্থিব অবস্থানকে অদৃশ্য করা সম্ভব হয়েছিলো; যে বাঙালি সংস্কৃতিকে তিনি ধারণ করতেন, সঞ্চয়িতা থেকে উত্থিত যে দর্শনকে তিনি বিশ্বাস করতেন সে দর্শনকে বাংলার মাটি থেকে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। বাংলার আল হাওয়ায়, সুবর্ণ মাটিতে এ’সংস্কৃতি এ’দর্শন মিশে আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধু এই দর্শন, এই পরম্পরার ধারক ও বাহক। এই ব দ্বীপ যতোদিন টিকে থাকবে বাংলার প্রকৃতি, বাংলার মানুষ চাপিয়ে দেয়া অদ্ভুতুড়ে কোন জাতীয়তাবাদী দর্শন গ্রহণ করবেনা এ’কথাটি নিঃসন্দেহে বলতে কোন দ্বিধা নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক।