চীন কি একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:১৮:৫৬ অপরাহ্ন
অ্যাডভোকেট আনসার খান
১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও জে দং এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ছিলো অনুন্নত এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি রাষ্ট্র। তবে কালের পরিক্রমায় বর্তমান চীন বিশ্বের উন্নত একটি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ সামরিক শক্তিসম্পন্ন পরাশক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পরাশক্তির দেশে উন্নীত হয়েছে চীন।
চীনের রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রশ্ন প্রায়ই উঠতে দেখা গেছে যে, দেশটি কী গণতান্ত্রিক শাসনে শাসিত, না-কি, কর্তৃত্ববাদী শাসনে শাসিত রাষ্ট্র। এই প্রশ্ন নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মতামত।
চীনা শাসনের বর্তমান নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দাবি করেছেন তার শাসনে শাসিত চীন একটি উত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তবে বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করেন বাস্তবে চীন একটি কর্তৃত্ববাদী একদলীয় স্বৈরাচারী রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রের মানদ- বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে চীনের বর্তমান শাসনব্যবস্হা গণতান্ত্রিক শাসনের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। গণতন্ত্রের ন্যুনতম শর্তও পূরণ করতে পারেনি চীনের শাসনব্যবস্থা। বহুদলীয় ব্যবস্হায় বহুত্ববাদী শাসন, প্রতিযোগিতামূলক একব্যক্তির একভোট, কারচুপিমুক্ত, নিরপেক্ষ, অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও ভয়মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দল ও পছন্দের প্রার্থী বাছাই করার ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসক এবং প্রতিনিধি নির্বাচন করা বা পরিবর্তন করার জন্য মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা ও নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের মৌলিক মানদ-ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও চীনে এসবের অধিকার দেওয়া হয়নি। বরং কর্তৃত্ববাদী শাসনের সব উপাদানই চীনে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ দেশটির শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, এইধরনের শাসন ‘সর্বগ্রাসী’ শাসনের থেকেও আলাদা এইকারণে যে, দেশটিতে জনগণের ভিন্ন মতপ্রকাশের অধিকার নেই। ভিন্ন মতপ্রকাশের চেষ্টা করার জন্য চীনা নাগরিকদের ‘আটক করা’ জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন ও হয়রানি করা’ নিয়মিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘সর্বগ্রাসী আকাক্সক্ষা’ সমস্ত জনগণের দেহ ও মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করাকে বোঝায়। এই অর্থে চীনে এখন ‘সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী শাসন’ জেঁকে বসেছে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না পলিসি প্রোগ্রামের পরিচালক প্রফেসর ডেভিড শ্যামবাঘ মনে করেন, চীনা কমিউনিস্ট শাসন একটি ‘অত্যন্ত অনিরাপদ শাসন, মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টিকারী শাসন, যেখানে একটি নজরদারি রাষ্ট্রের উদ্ভবের দিকে পরিচালিত করে।’ দেশটির অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বিতর্কের সীমাবদ্ধতার কারণে বিকল্প বা ভিন্ন মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়েছে। অর্থাৎ চীনে কার্যকর ভাবে ‘বিকল্প কন্ঠস্বর’কে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
শাসকদের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের নিশ্চয়তা বিধান করা, রাজনৈতিক দল সহ সংগঠন ও সমিতি গঠনের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সহ মুক্ত গণমাধ্যমের নিশ্চয়তা ইত্যাদি হলো জাতিসংঘ কর্তৃক সংজ্ঞায়িত গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রিডম হাউসের বার্ষিক ‘স্বাধীনতা স্কোর’ সহ রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার এবং বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক উপাদানগুলোর আন্তর্জাতিক রেঙ্কিংয়ের তলানিতে রয়েছে চীনের অবস্থান। এটি স্পষ্ট যে দেশটিতে মতপ্রকাশের অধিকার, সংগঠন করার স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ, তার প্রচার ও ব্যক্ত করার কোনো অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
দেশে একটিমাত্র বৈধ রাজনৈতিক সংগঠন- ‘চীনা কমিউনিস্ট পার্টি’ রয়েছে, যা বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক শাসনের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, সেখানে জনগণ তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল ও পছন্দের প্রার্থী বাছাই করার জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগের কোনো সুযোগ পায় না বলে পছন্দের সরকার নির্বাচন বা অপছন্দের সরকার পরিবর্তন করার অধিকার চীনা জনগণের নেই। এখানে স্বীকৃত একমাত্র ক্ষমতাসীন সংগঠন হলো চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, যেটি বিগত সাত দশকেরও অধিক সময়ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে এবং এই পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্ধিতা বা প্রতিযোগিতা করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি বিধায় নির্বাচনে বিভিন্ন প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করার কোনো সূযোগ জনগণের নেই।
চীনা পার্টি দাবি করে যে, চীনের গণতন্ত্র একটি ‘প্রক্রিয়া ভিত্তিক গণতন্ত্র’, যেখানে বহুস্তর বিশিষ্ট আইনসভা বিদ্যমান আছে। তাত্ত্বিকভাবে, গ্রাম এবং কাউন্টি স্তরের আইনসভার প্রতিনিধিরা সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকে। আর সর্বোচ্চ স্তরে অর্থাৎ শীর্ষে রয়েছে, ‘ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস’- মূলত একটি রাবার স্ট্যাম্প আইনসভা বা সংসদীয় সংস্থা, যা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত এবং নীতিগুলো অনুমোদনের জন্য বার্ষিক অধিবেশনে মিলিত হয়ে থাকে।
বাস্তবে ‘তৃণমূল নির্বাচন’ দলিল দস্তাবেজে লিপিবদ্ধ, কেননা কেউ চাইলেই নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। যেমন, গেল বছর অক্টোবরে ১৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বেইজিংয়ের স্থানীয় পিপলস কংগ্রেসের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সূযোগ পাওয়া তো দূরের কথা, উনারা শেষপর্যন্ত হয়রানির শিকার হয়েছিলেন, তাদেরকে গৃহবন্দী করা হয় এবং তাদেরকে শহর থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। অর্থাৎ ওদের কেউই প্রার্থী হতে পারেননি। এপ্রসঙ্গে হংকং ব্যাপ্টিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা রাজনীতির বিশেষজ্ঞ জিন পিয়েরে ক্যাবেস্তান বলেছেন, এটিকে সহজভাবে বলতে গেলে, ‘চীনা গণতন্ত্র কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কত্বের অধীনে।’ সুতরাং আপনি যদি পার্টির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, পার্টির একনায়কত্ব মেনে নেন তবে আপনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন, নতুবা আপনি বাদ যাবেন।
চীনা নেতৃত্বের সর্বোচ্চ অঙ্গগুলোয় ‘নির্বাচনে বিভিন্ন প্রতিযোগীদের মধ্যে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচন’ করা যায় না। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একদলীয় কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্হার অধীনে চীনে নির্বাচন হয়। দেশটিতে সরাসরি নির্বাচন শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ের জনগণের কংগ্রেস এবং গ্রাম কমিটিতে হয়ে থাকে, যেখানে সমস্ত প্রার্থী মনোনয়ন সিসিপি দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় সিসিপির একচেটিয়া আধিপত্য, বাক- স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা এবং নির্বাচনের উপর দলীয় নিয়ন্ত্রণের কারণে নির্বাচনের প্রকৃতি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ।
দেশে সিসিপি ব্যতীত অন্য কোনো দলের হয়ে নির্বাচন করার সূযোগ নেই। দেশে বিরোধী দল গঠনের অধিকার না থাকায় নির্বাচন বহুত্ববাদী প্রকৃতির নয়। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা রাজনীতির বিশেষজ্ঞ ররি টরুয়েক্স বলেছেন যে সিসিপি পিপলস কংগ্রেস সিস্টেমের প্রতিটি স্তরে মনোনয়ন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং উচ্চ পর্যায়ের ডেপুটিরা চীনা নাগরিকদের নিকট নির্বাচনী জবাবদিহিতার মুখোমুখি হন না।
স্হানীয় জনগণের কংগ্রেস সরাসরি সিসিপির নিয়ন্ত্রণে নির্বাচিত হয় ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস বা এনপিসি,জাতীয় আইনসভা পর্যন্ত সমস্ত উচ্চ স্তরের গণকংগ্রেস পরোক্ষভাবে নীচের স্তরের জনগণের কংগ্রেস দ্বারা নির্বাচিত হয়। সকল স্তরে প্রার্থীর মনোনয়ন সিসিপি দ্বারা অনুমোদিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সিসিপির সর্বোচ্চ অবস্থান সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত।
চীনের সংবিধান দ্বারা জনগণকে কেবল একদম নিম্ন স্তরের প্রতিষ্ঠানের অর্থাৎ, গ্রাম কমিটির সদস্য ও চেয়ারম্যান, কাউন্টি, শহরের জেলাগুলো, শহরগুলো, টাউনশীপ, এবং জাতিগত জনপদ সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকে। সর্বোচ্চ আইনসভা ‘ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ অঙ্গ।’ এই সংস্থার সিদ্ধান্তের উপর চীনা নাগরিকদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চীনের একক দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্হা হলো একটি অন্যতম উপাদান, যা একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের প্রমাণ বহন করে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা কর্তৃত্ববাদকে সংঙায়িত করেছে,- কর্তৃত্বের কাছে অন্ধ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের নীতি, চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার অধিকার অস্বীকার করে এবং সরকারে কর্তৃত্ববাদ বলতে এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যা কোনো নেতা বা একটি ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে, যা সাংবিধানিক ভাবে জনগণের ব্যক্তি নিরাপত্তার প্রতি দায়বদ্ধ নয়।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা দ্বারা প্রদত্ত কর্তৃত্ববাদীর সঙ্গানুসারে চীন একটি কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্র, যার সরকার এমনকি মানুষের চিন্তার বা কর্মের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় না এবং সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা একটি ছোট্ট অভিজাত শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত, এই শাসকরা চীনা নাগরিকদের নিকট দায়বদ্ধ নয় এবং জবাবদিহিও করে না। বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠন এবং দলগুলোকে ক্ষমতার জন্য নির্বাচনে প্রতিযোগিতার অনুমতি দেয় না।
সারসংক্ষেপ হলো, চীন একটি কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্র, যা রাজনৈতিক মতাদর্শ, সমাবেশের অধিকার, মতপ্রকাশ এবং আন্দোলন করার স্বাধীনতার উপর বিধি-নিষেধ, গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, জনগণের উপর অবিরাম ভয় তৈরির জন্য রাষ্ট্রীয় নজরদারি, নানাবিধ দমন-পীড়ন কৌশল ও নিরাপত্তা যন্ত্রপাতির ব্যবহার সহ অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করে চীনা জনগণের মধ্যে এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি দ্বারা জনগণের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। তাই বলা যায়, চীনকে কোনো অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না, বরং চীন একটি আগ্রাসী চরম কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্র।
সূত্র : সিএনএন, জেনিফার গান্ধীর,-কর্তৃত্ববাদের অধীনে নির্বাচন। অস্হিরতার শক্তি- আমেরিকান জার্নাল অব সোসিওলজি।বারবারা গেডেস,-কিভাবে একনায়কত্ব কাজ করে, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। আমাদের একটি জাল নির্বাচন, জেভিয়ার হারনান্দেজ, নিউইয়র্ক টাইমস। গণতন্ত্র, ডিকোডিং চায়না হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়। চীনের সংবিধান। মডার্ণ ডেমোক্র্যাসি। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ। এনসাক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, এবং ই-ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস- বাই পেট্রিক আরভিনস-এর প্রবন্ধ।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।