বজ্রপাত ও সতর্কতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ৫:২৪:৫৪ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
বর্ষা মৌসুমের শুরু এবং শেষের দিকে বজ্রপাতে বেশি মৃত্যু হয়। এতে কর্মক্ষম পুরুষই বেশি মারা যান। গত কয়েক বছরে এই ধারাবাহিকতার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে শিশু ও নারীর মৃত্যু। গত কয়েক দিন আগে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে বজ্রপাতে ১২-১৩ জন শিশুর প্রাণ গেছে। আহত মানুষের তালিকায়ও শিশুর সংখ্যা নেহাত কম নয়। গত বছর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বজ্রপাতে ৫১ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামও এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
গত ২৩ এপ্রিল ২০২৩ দেশের পূর্বাঞ্চলের ছয় উপজেলায় এক দিনেই বজ্রপাতে ৯ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল ছয় জেলায় মারা যান আটজন। এখন প্রতিদিনই কেউ না কেউ বজ্রপাতের শিকার হচ্ছেন। যারা এসব মৃত্যুর হিসাব রাখেন, তারা বলছেন, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে ১ হাজার ৮৭৮ জন মারা গেছেন। এদের ৭২ শতাংশই কৃষক। এ যাবৎ পরিসংখ্যানে কেবল কর্মক্ষম পুরুষ মানুষের মৃত্যুর খবরই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে বজ্রপাতে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। কেন আগের চেয়ে বেশি শিশু মরছে? এখন পর্যন্ত কেবল ধারণার উপর নির্ভর করে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। ধারাবাহিক গবেষণা ছাড়া সঠিক উত্তর মেলা কঠিন। অনেকে মনে করেন, এখন আর বড় গাছ নেই। ছোট ছোট গাছেই আম ধরে। ফলে গাছের উচ্চতার কারণে আগে শিশুরা বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেত, এখন আর সেটা হচ্ছে না। অনেকেই বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগের চেয়ে এখন বেশি বেশি বজ্রপাত হচ্ছে এবং এতে মানুষ মরছে বেশি। তবে এই ধারণাকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। তাঁদের হিসাব বলছে, বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়েনি। তাঁরা বলছেন, মানুষ বেড়েছে, বৈরী আবহাওয়ায় মানুষের সম্পৃক্তা বেড়েছে। ১৯৭১ সালে যেখানে সাত কোটি মানুষ বসবাস করত এখন সেখানে প্রায় তিন গুণ বেশি মানুষ বসবাস করছে।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ওপর গবেষণা চালিয়েছে। তারা বলছে, এ দেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই এপ্রিল থেকে জুনে হয়। এটা বর্ষা শুরুর মৌসুম। বর্ষা শেষে অর্থাৎ মৌসুমি বায়ু ফেরত যাওয়ার সময় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও বজ্রপাত বাড়ে। তবে তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, বর্ষা শুরুর পর বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা তুলনামূলক বেশি ঘটে। গত বছর বা তার আগের বছরগুলোর হিসাব ঘাটলে মোটামুটি একই ধারাবাহিকতা দেখা যায়। গত বছরের (২০২২ সালের) জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা যান ১৯১ জন (পুরুষ ১৩৩)। আর আগস্ট থেকে নভেম্বর/ডিসেম্বরে মারা যান ১২২ জন (পুরুষ ৯৯)। দুটিই আমাদের ফসল ঘরে তোলার মৌসুম। তাই বৃক্ষহীন ফসলের মাঠে অথবা ফসল নিয়ে ফেরার পথে নৌকায় অথবা ফসল মাড়াইয়ের সময় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি। এসব কাজ প্রধানত কর্মঠ পুরুষের। তাই মৃত্যুর তালিকায় তারাই শীর্ষে। বজ্রপাতে প্রাণহানির হিসাব-নিকাশ নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। কিন্তু অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তেমন একটা আমলে নিই না। শহর এলাকায় বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা নেই ঠিকই। তবে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। যন্ত্রপাতি মেরামতের দোকানের এই মৌসুমে খানিকটা ঈদের আমেজ চলে। ঝড়-বৃষ্টির সময় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি যেমন ফ্রিজ, টিভি, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ইত্যাদির সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখলে বিপত্তি এড়ানো সম্ভব। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিস নষ্ট হলে মেরামত করতে সময় লাগে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সেবা প্রতিষ্ঠান, যেমন হাসপাতাল, টিকা/ওষুধ সংরক্ষণ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে মেরামত করতে অনেক সময় লাগে। এতে সম্পদ, বিশেষ করে প্রতিষেধক ও প্রাণ রক্ষাকারী ওষুধ নষ্ট হয়ে যায়।
বজ্রপাতে কী লাভ আছে? বিজ্ঞান বলছে, মাটিতে নাইট্রোজেন বা পরোক্ষভাবে প্রোটিনের উৎস হলো বজ্রপাত ও বৃষ্টির মাধ্যমে তৈরি নাইট্রিক অ্যাসিড। বজ্রপাতের সময় তড়িতের বিচ্ছুরণ ও উত্তাপের ফলে বায়ু সংযুক্তিতে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। এ সময় নাইট্রোজেন অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি হয় নাইট্রোজেন অক্সাইড। এই অক্সাইড পানির সংস্পর্শে পরিণত হয় অতি লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডে। একেক অঞ্চলে বৃষ্টিতে অ্যাসিডের মাত্রা একেক রকম হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যভাগে প্রতি বছর প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২ দশমিক ৫ টন অতি লঘু নাইট্রিক অ্যাসিড বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে নেমে আসে। আমাদের উপমহাদেশ ও চীনে ৩ দশমিক ৫ টন, ভিয়েতনাম অঞ্চলে ৭ টন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস সম্পদ বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, এ সময় ঘন ঘন বজ্রপাত মাছের প্রজননের সহায়তা করে। বজ্রপাতের কারণে মাছের পিটিউটরি গ্ল্যান্ডে (পিজি) হরমোন নিঃসরণ শুরু হয়। প্রজনন সহায়ক এই নিঃসরণ মাছকে বেপরোয়া করে তোলে, তারা দৃশ্যমান হয়। এ সময় মাছ শিকারিরা একটু লোভ সংবরণ করলে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমার সঙ্গে সঙ্গে মাছের প্রজনন অনেকটা নির্বিঘœ হতো। ফিনল্যা- ভিত্তিক বজ্রপাত বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালের তথ্য অনুযায়ী, মাছ ধরার সময় বজ্রপাতে ১৩ শতাংশের বেশি মানুষ মারা যান। বজ্রপাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর যে ২০টি জরুরি নির্দেশনা দিয়েছে, তার মধ্যে বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখার কথাও বলা হয়েছে। এতে যে শুধু মানুষের জীবন বাঁচবে তা নয়; মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির কাজটি ত্বরান্বিত হবে। জরুরি নির্দেশনার মধ্যে শিশুদের ঝড়ের সময় বাইরে না যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে (প্রথম আলো: ১৩ মে-২০২৩)।
বজ্রপাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ২০টি জরুরি নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-
(১) বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। (২) প্রতিটি ভবনে বজ্রনিরোধক দ- স্থাপন করুন। (৩) খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকার সময় বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যান। (৪) কোনো বাড়িতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা কক্ষে যান। (৫) খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। গাছ থেকে চার মিটার দূরে থাকতে হবে। (৬) ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক তারের নিচ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। (৭) ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্লাগগুলো লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। (৮) বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের বৈদ্যুতিক শকের মতো করেই চিকিৎসা দিতে হবে। (৯) এপ্রিল-জুনে বজ্রপাত বেশি হয়। এ সময় মেঘ দেখা গেলে ঘরে অবস্থান করুন। (১০) যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। (১১) বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় থাকবেন না এবং ঘরের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকুন। (১২) ঘন কালো মেঘ দেখা গেলে অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হতে পারেন। (১৩) উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার, ধাতব খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন। (১৪) বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতল যুক্ত ছাতা ব্যবহার করুন। (১৫) খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে থাকবেন না। (১৬) কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকুন। (১৭) বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন। (১৮) খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়–ন। (১৯) গাড়ির মধ্যে অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না। সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কংক্রিটের কোনো ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। (২০) মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির ভিতরে অবস্থান করুন (প্রাগুক্ত)।
লেখক : কলামিস্ট।