আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলনের শহীদ আসাদ সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র ছিলেন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ আগস্ট ২০২৩, ৫:২৫:১৭ অপরাহ্ন
তথ্য নেই কলেজের কাছে, জানে না শিক্ষার্থীরা
আহমাদ সেলিম
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুব খান সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি। এরপর থেকে দিনটি শহীদ আসাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সেই বিপ্লবী আসাদ এক সময় সিলেটের এমসি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু সেই ইতিহাস ৫৩ বছর ধরে তুলে না ধরায় কলেজের একটি আলোকিত অধ্যায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, বঞ্চিত হচ্ছেন সিলেটের মানুষ। কলেজের কাছেও শহীদ আসাদ সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে আসাদের সোনালী স্মৃতি, বিস্মৃতির অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। জন্ম এবং মৃত্যু দিবসটিও কোনোদিন পালন করা হয়নি, কলেজের পক্ষ থেকে।
শহীদ আসাদ যে সময়ে এমসি কলেজে পড়েছেন একই সময়ে ওই কলেজের সহপাঠী ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, সিলেটের কৃতিসন্তান, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ নুরুল ইসলাম নাহিদ। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আসাদ সম্পর্কে নুরুল ইসলাম নাহিদ বেশ কিছু সময় স্মৃতিরোমন্থন করেন।
১৯৪২ সালে আসাদের জন্ম। আসাদের পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। এই নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ। সেই আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) ঢাকা হল শাখার সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুব খান সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি। এরপর থেকে দিনটি শহীদ আসাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে। মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ সেই সময়ের এমসি কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, শহীদ আসাদের বাবা এমএ তাহের ছিলেন শিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আর মা মতিজাহান খাদিজা খাতুন ছিলেন নারায়ণগঞ্জ শহরের খ্যাতনামা আইটি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। তারা ছিলেন ছয় ভাই ও দুই বোন। শহীদ আসাদ এবং তার অপর ভাই (ইতিহাস বিভাগ) ও দুই বোন (প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। আরো দুই ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন।
সবার বড় ভাই কেএম খুরশীদুজ্জামান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও তৃতীয় ভাই এফএম রশীদুজ্জামান বাংলাদেশ কারিগরি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও এর নকশা তৈরিতে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের সহযোগী হিসাবে দেশীয় প্রকৌশলী রশীদুজ্জামানও ছিলেন।
আসাদ তাঁর বাবার শিবপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬৩ সালে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে (ছাত্ররাজনীতিতে অধিক মনোযোগী হয়ে এক বছর পিছিয়ে) আইএ পাস করেন। সে সময় মেধাবী ছাত্র হিসেবে শহীদ আসাদের সুনাম ছিলো শিক্ষকদের কাছে। সিলেটের বাসিন্দা, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও একই সময় এমসি কলেজে পড়েছেন। ছাত্ররাজনীতিতে একই আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় এমসি কলেজে নুরুল ইসলাম নাহিদ ও আসাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আলাপকালে শহীদ আসাদ সম্পর্কে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, ‘আসাদ এবং আমি এমসি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম। খুব মেধাবী ছিলো। সে এইচএসসি পর্যন্ত এমসি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। আসাদের বড় ভাই প্রকৌশলী ছিলেন। নাম রশীদুজ্জামান। থাকতেন সিলেটে। যতদূর মনে পড়ে সিলেট শহরের শিবগঞ্জের ফরহাদ খা পুল অথবা আশপাশ এলাকায় একটি সরকারি কোয়ার্টারে তিনি থাকতেন। আসাদের সাথে সখ্যতা থাকায় প্রায় সময় তাদের বাসায় যাওয়া হতো। তার ভাই আমাকেও ¯েœহ করতেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘তার নামে অনেক কিছুই হয়েছে। এমসি কলেজেও তার স্মৃতি তুলে ধরে রাখলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে উদ্দীপনা জাগাবে।’
সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পাশ করার পর শহীদ আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। আসাদ ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে অনার্স পাস করেন। ১৯৬৭ সালে এমএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি না পাওয়ায় ফলাফল বাতিল করে ১৯৬৮ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। একই সঙ্গে এবং একই বিষয়ে (ইতিহাস) সেবার এমএ পরীক্ষা দেন অনুজ এইচএম মনিরুজ্জামানও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসাদ সিলেটে থেকেছেন, সিলেটের এমসি কলেজে পড়েছেন। অথচ সেই ইতিহাস বর্তমান শিক্ষার্থীরা জানে না। আসাদ সংক্রান্ত কোনো তথ্য কলেজের কাছেও নেই। তাই বাধ্য হয়ে যোগাযোগ করতে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের তরুণ চিকিৎসক সিলেটের বাসিন্দা ডা. তায়েফ আহমদ চৌধুরীর মাধ্যমে শহীদ আসাদের ভাই ড. রশীদুজ্জামান এর সন্ধান পাই। কিন্তু যোগাযোগ করে জানা গেলো তিনিও বেঁচে নেই। কিছুদিন আগে মারা গেছেন। তায়েফ আহমদ চৌধুরী বলেন, যাদের কারণে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ, আসাদ তাদের একজন। শহীদ আসাদ বিপ্লবী নেতা ছিলেন। এমসি কলেজের পক্ষ থেকে তাকে যেভাবে তুল ধরা দরকার ছিল, তা হয়নি। ফলে আসাদ সম্পর্কে সিলেটের মানুষ জানে না, শিক্ষার্থীরা জানে না।
শহীদ আসাদ সম্পর্কে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভাসির্টির মানবিক অনুষদের ডীন বিশিষ্ট গবেষক ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বলেন, শহীদ আসাদ এমসি কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়েছে আসাদের সহপাঠী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেটের সাবেক পরিচালক, বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা আসাদ উদ্দিন এর কাছ থেকে। তবে এমসি কলেজের জন্য গর্ব করার মতো একটি বিষয়কে কেন যে কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিচ্ছে না, জানিনা। তিনি বলেন, আসাদকে নিয়ে সারা দেশের মানুষ গর্ব করে, অহংকার করে। অন্তত জন্ম এবং মৃত্যুদিন পালন করা হলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। এতে কলেজের ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ হবে।
কলেজে শহীদ আসাদ স্মরণে ক্যাম্পাসে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট’র এমসি কলেজ শাখা। সংগঠনের সংগঠক পিনাক বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে শহীদ আসাদের নামে কিছু একটা করার দাবি জানিয়ে আসছি কিন্তু হচ্ছে না। তবে আমাদের দাবি সব সময় সোচ্চার থাকবে।
আলাপকালে এম.সি কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল এনাম মোহাম্মদ রিয়াজ জানান, ‘আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। কলেজের দায়িত্ব নেয়ার আগে একবার আমি আসাদকে নিয়ে ফেইসবুকেও লিখেছি। তবে এখন থেকে প্রতিবছর আমরা শহীদ আসাদের জন্ম এবং মৃত্যুদিনে কর্মসূচি পালন করবো। সেই সাথে স্থায়ীভাবে কিছু করারও চিন্তা রয়েছে।’
বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান লিখলেন: ‘আসাদের শার্ট’-আহা, সে কী কথামালা!’ আসাদের নামে ঢাকার আসাদ গেইটের নামকরণ হলো। এছাড়াও নরসিংদীর শিবপুরে সরকারি শহীদ আসাদ কলেজ, শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস হাইস্কুল, শহীদ আসাদ স্মরণিসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান-স্থাপনা আসাদের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। সরকার ২০১৮ সালে আসাদকে স্বাধীনতা পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করেছে। অথচ এমসি কলেজে কিছুই নেই-এটা অনেকের কাছে আক্ষেপের।