আশীর্বাদ অভিশাপ নিয়ে যত কথা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ আগস্ট ২০২৩, ১১:৫০:০৬ অপরাহ্ন

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
ছোটবেলা দেখেছি স্কুল-কলেজে নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো। নিজেও কখনো কখনো অংশগ্রহণ করেছি। সেসব যেন আজ পুরানো দিনের কথা, হারানো দিনের কথা। যেমন প্রায়ই পুরানো দিনের গানকে বলা হয় হারানো দিনের গান। কিন্তু না, সেগুলো কখনো হারিয়ে যাবার গান নয়। সেগুলো হৃদয়ের গান, প্রাণের গান। সে গান হারিয়ে যাবার নয়। যুগ যুগ ধরে জাগ্রত থাকে সঙ্গীত প্রেমিক অন্তরে অন্তরে। তেমনি স্কুল-কলেজের বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু- ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ’ এর উৎকর্ষতা কখনো হারাবার নয়। তখন বিজ্ঞানের আশীর্বাদের হাজারো ফিরিস্তি তুলে ধরতো আশীর্বাদের পক্ষের প্রতিযোগী। ‘অভিশাপের পক্ষের প্রতিযোগী তার ধারালো যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে তুলে ধরতো বিজ্ঞানের আবিষ্কার সেসব মারণাস্ত্র, যুদ্ধের হাতিয়ারের কথা। টেংক, যুদ্ধ বিমান, আনবিক বোমা ইত্যাদির মানব বিধ্বংসী যুদ্ধের তা-বলীলার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের নাগাসিকা হিরোসীমার ঘুমন্ত নিরাপরাধ লাখো মানুষের ওপর এটম বোমা নিক্ষেপের করুন কাহিনীর কথা মানবসভ্যতার ক্ষতের কথা জাপান তথা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বিশ্ববাসী আজো কি ভুলতে পেরেছেন। সেসব কথা চিন্তা করেই ১৯৪৫ এর বিজ্ঞানের অভিশাপ আনবিক বোমা নিক্ষেপকারী আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে ২০২৩শে এসে নতুন করে ভাবতে হয়। খুঁজতে হয় ‘বিজ্ঞান’ শব্দের অর্থ বিভিন্ন অভিধানে।
রতন সিদ্দিকীর ‘প্রমিত বাংলা বানান অভিধান লিখে বিজ্ঞান অর্থ- তত্ত্বজ্ঞান। আর একটু পরিষ্কার করে জানার জন্য কলিকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান এর চতুর্থ সংস্করণের সাহায্য নিতে হলো। সেখানে ‘বিজ্ঞান’ শব্দের অর্থ হলো- ঈশ্বরানুভব, অপরোক্ষ জ্ঞান, যে জ্ঞান তত্ত্বজ্ঞান (জ্ঞান-বিজ্ঞান), নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোন বিষয়ে ক্রম অনুসারে লব্ধ জ্ঞান ঝপরবহপব (পদার্থ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান; শিল্পাদির শাস্ত্র (সঙ্গীত বিজ্ঞান)। অবশ্য বিজ্ঞানকে কেউ কেউ বিশেষ জ্ঞান বলেও থাকেন। তবে বিজ্ঞান যদি ঈশ্বরানুভব জ্ঞান হয়ে থাকে তাহলে বিজ্ঞান তো মানবকল্যাণ তথা মানবসভ্যতার উৎকর্ষসাধনেই সদা নিয়োজিত থাকার কথা। মানবসভ্যতার বিলুপ্তি- ধ্বংস বিজ্ঞানের কাছে কখনো কাম্য নয়। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ক্ষুরধার যুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানকে হয়তো কেউ কেউ অভিশাপ বলে প্রমাণ করে ফেলতে পারেন কিন্তু সেটা যথার্থ নয়। বিজ্ঞান যেহেতু ঈশ্বরের দান, বলে মানব সমাজ বিশ্বাস করে সেটা আশীর্বাদই। অভিশাপ বলে কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মেনে নিতে পারেন না। এবং কোন ব্যক্তিগত বা জাতীয় হীন-ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক স্বার্থে আশীর্বাদকে অভিশাপের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কখনো মানবাধিকারের বিষয় বলে প্রচার করা যায় না। হোক সেটা তথাকথিত গণতন্ত্র বা যে কোন তন্ত্র মন্ত্রই। মঙ্গলের গায়ে অমঙ্গলের কালিমা লেপন শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ হতে পারে না।
কিন্তু আমরা বাস্তবে কি দেখছি? আমরা তথা বিশ্ববাসী দেখছেন মানুষ মারার অস্ত্র বোমাই শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ বলে মনে করছে বিশ্বশ্রেষ্ঠ বলে খ্যাত আমেরিকা। বিশ্ব মড়ল আমেরিকার বাইডেন সাহেব আজ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা না করে ইউক্রেনকে গুচ্ছ বোমা দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। গুচ্ছ বোমা এমন মারাত্মক ধরনের একটি বোমা যা থেকে একসঙ্গে অনেক ছোট ছোট বোমা ছোড়া হয় বলে এতে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে নির্বিচারে মানুষ নিহত হয়। এ ধরনের বোমার আরো ভয়ঙ্কর দিকটি হলো এগুলো বিস্ফোরিত অবস্থাতেও মাটিতে বছরের পর বছর পড়ে থাকতে পারে, যা মানুষের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পুঁজিবাদের ধারক, বাহক ব্রিটেন এবং আমেরিকা সব সময়ই একই পথে হাঁটলেও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ইউক্রেনে গুচ্ছ বোমা দেওয়ার ঘোষণা নিয়ে বাইডেনের সাথে যেন একমত হতে পারছেন না। এ ব্যাপারে সরাসরি বাইডেনের সমালোচনা না করলেও তিনি বলেছেন, কনভেনশন অন ক্লাস্টার মিউনিশনস চুক্তিতে ১২৩টি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাক্ষরকারী দেশ। আন্তর্জাতিক এ চুক্তির আওতায় গুচ্ছ বোমার উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু বাইডেন সাহেব এ চুক্তির শর্ত না মেনে ইউক্রেনকে গুচ্ছ বোমা দেওয়ার ক্ষেত্রে অটল। গুচ্ছ বোমা দেবেনই। তবে বাইডেনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও স্পেন জানিয়েছে তারা গুচ্ছ বোমা ব্যবহারের পক্ষে নয়। কার কথা কে শুনে। আমেরিকাতো কারো মতামতকে পাত্তাই দেয় না। সবার মতামতকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইউক্রেন এ অস্ত্রগুলো রাশিয়ায় কিংবা জনবসতির এলাকায় ব্যবহার করবে না বলে নাকি লিখিত নিশ্চয়তা দিয়েছে ইউক্রেন। ক্ষমতার দম্ভে অন্যকে বোকা ভাবা সমীচীন নয়।
মনে রাখতে হবে ব্রিটিশের রাজ্যেও একদিন সূর্যাস্ত হতো না। ইউক্রেন কোটি কোটি ডলারের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই গুচ্ছ বোমাগুলো কি প্রদর্শনীর জন্য সাজিয়ে রাখবে? না নাকি তাদের যাদুঘরে রাখার জন্য এ গুচ্ছ বোমা ক্রয়? ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যবস্থা করলে যেখানে শত শত মানুষের প্রাণহানি রোধ হবে সেখানে গুচ্ছ বোমা তো প্রাণহানির সংখ্যা বাড়িয়েই তুলবে। এখন প্রশ্ন হলো, সবার মতামত উপেক্ষা করে ইউক্রেনে গুচ্ছ বোমা দেওয়ার পেছনে কি শুধুই ইউক্রেনের লাভ? আমেরিকার কি কোনই লাভ নেই? সেই লাভ লোকসানের হিসেবের খাতা যদি কেউ খুঁজে বের করতে পারতেন তবেই আমেরিকার আসল চেহারা বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়তো।
বলছিলাম বিজ্ঞানের কথা। বিজ্ঞানকে ঘিরে ‘আশীর্বাদ-অভিশাপ’ এর বিতর্কের কথা। এখানে এখন আমরা তর্কের খাতিরে যে যা-ই বলি না কেন, মানব জাতির বিকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আশীর্বাদের পাল্লাই কিন্তু ভারী। কিছু কিছু বিবেক বিবর্জিত মানুষের কারণে পৃথিবী জুড়ে বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নত দেশ সমূহে বিজ্ঞানের আশীর্বাদগুলো বিজ্ঞানের অভিশাপের কাছে হেরে যেতে বসেছে।
ঐ মানুষগুলোর বুদ্ধি প্রখর কিন্তু ঐ বুদ্ধি শুভ চিন্তা ধারন করে না। যা আছে তা হলো দুষ্টু বুদ্ধি। বলা যেতে পারে ওরা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ নয়। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আমরা আজ করোনা থেকে মুক্তি পাচ্ছি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে সারা বিশ্বকে মানুষ হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। একে অন্যের কাছে আসতে পেরেছে। জানতে পারছে একে অন্যকে। চিন্তা-চেতনার বিনিময় হচ্ছে। মানব জাতির কল্যাণ সাধনে সারা বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিজ্ঞান প্রেমীগণ মিলেমিশে একত্রে কাজ করতে পারছেন। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে মানবজাতির সুন্দর জীবনে। সুন্দরতর হয়ে উঠছে জীবনচক্র। এরই মাঝে এসে হানা দেয় কখনো কখনো দানব-চেতনা। অসুন্দর সুন্দরের টুটি চেপে ধরতে চায়। গুচ্ছ বোমার মানববিধ্বংসী উত্তপ্ত বাতাস নিভিয়ে দিতে চায় বিশ্বের যত মঙ্গলপ্রদীপ।
তবে স্বপ্নদ্রষ্টা কবিদের মুখে এমন কথাও তো শুনা যায়- ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়’।
এমনও কথা আছে- ‘তোমাকে বধিবে যে গকুলে বাড়িছে সে’। এমন খবর তো মাঝে মাঝে খবরের কাগজের পাতায় পাতায় ওঠে আসে। তেমনি একটি খবরের সচিত্র শিরোনাম দেখি ১৬ জুলাই ২০২৩ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠের ৭ এর পাতায় এবং তা হলো- ‘যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় মৃত্যুর নতুন রেকর্ড’, ছবির নীচে লিখা আছে- যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি সংবাদ মাধ্যম ইউএসএ টুডে এবং নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত একটি ডাটা বেজের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মোট ৩৭৭টি বন্দুক হামলা ঘটেছে এবং সেসব ঘটনায় নারী ও শিশুসহ নিহত হয়েছেন মোট ১৪০ জন। ২০২২ সালের তুলনায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণেরও বেশি। এ খবরটিতো বাইডেন সাহেব তথা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোন আশীর্বাদ নয়। বরং অভিশাপ বললে কি খুব একটা বেশি বলা হবে। বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদ-অভিশাপ নিয়ে গভীর ভাবনার এখনই সময়। অন্তত মানবসভ্যতার অস্তিত্বের কথা চিন্তা করে। আর সব কথার শেষ কথা হলো- একদিন ঐ বন্দুক হামলাকারীদের হাতে যে গুচ্ছ বোমা দেখা যাবে না এমন নিশ্চয়তা কী কেউ দিতে পারবেন? পারবেন না। তখন কি হবে বাচাধন!
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা