সিলেটে পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরি বৃদ্ধি ॥ দুর্ভোগে গ্রাহকরা চোর ধরা পড়লেও চক্র অধরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০২৩, ৫:৩৮:১৯ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী
সিলেটে ট্রান্সফরমার-তারসহ বৈদ্যুতিক মালামাল চুরির ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় আকস্মিক দুর্ভোগে পড়েছেন বিদ্যুৎ গ্রাহকরা। এর মধ্যে শুধুমাত্র সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা থেকেই গত মাসে ১২টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। চোর চক্র সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায়শ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বৈদ্যুতিক মালামাল। আর এজন্যে নির্দিষ্ট পরিবহন ব্যবহারের খোঁজও মিলেছে। মাঝে মধ্যে মালামালসহ পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান চালককে আটক করা হলেও মূল হোতারা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি একাধিক চুরির ঘটনায় ১০ জনকে আটক করে আইনশৃংখলা বাহিনী। উদ্ধার করা হয়েছে বেশ কিছু বৈদ্যুতিক মালামাল। তবুও ট্রান্সফরমারসহ বৈদ্যুতিক মালামাল চুরি ঠেকানো যাচ্ছে না। সিলেটের ডাক’র অনুসন্ধানে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার চুরির বিষয়টি খোদ সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর প্রধান নির্বাহী মো. আক্তারুজ্জামান লস্কর সিলেটের ডাক-এর কাছে স্বীকার করেন। গতকাল রোববার দুপুরে তিনি বলেন, ট্রান্সফরমারসহ বৈদ্যুতিক মালামাল চুরি ঠেকাতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিন আগেও ওসমানীনগরে দুই চোরকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ আছে। অনেক এলাকায় জনমানবহীন জায়গায় ট্রান্সফরমার থাকায় এটি চোরেরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। চুরি রোধ করতে এসব ট্রান্সফরমার লোকালয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। বর্তমানে ট্রান্সফরমার লোকালয়ে নিয়ে আসার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে সুযোগ বুঝে পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারসহ মালামাল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে চোর চক্র। এ চক্রের সাথে বিভিন্ন ভাঙারি দোকানের যোগসাজস রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চোর চক্র ট্রান্সফরমার চুরি করে স্থানীয় চোরাকারবারিদের নিকট পৌঁছে দেয়। এরপর ওই চোরাকারবারি তাদের নির্দিষ্ট কাভার্ড ভ্যানে করে চোরাই মালামাল সিলেট থেকে রাজধানী ঢাকায় কিংবা অন্য কোন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কখনো কোনো কাভার্ড ভ্যান আটক হলেও এর সাথে জড়িত মূল হোতাদের বের করতে আইনশৃংখলা বাহিনীকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। চলতি বছর দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় বৈদ্যুতিক মালামালসহ পিকআপ আটক করা হয়। ওসমানীনগরে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে বৈদ্যুতিক মালামালসহ হাতে নাতে একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করা হলেও এর নেপথ্য নায়কদের আর খুঁজে বের করেনি পুলিশ।
অথচ পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, চোরাইকৃত ট্রান্সফরমার, বৈদ্যুতিক তারসহ মালামাল মূলত কাভার্ড ভ্যানে করেই চোরা কারবারিরা সিলেট থেকে পাচার করে। পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ও বিভিন্ন মালামাল চুরির ফলে ওই এলাকাটি বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। এতে জনসাধারণের ভোগান্তির পাশাপাশি প্রভাব পড়ে ফসল উৎপাদনেও।
সূত্র জানায়, গত ৩১ জুলাই রাতে সিলেটের বিশ্বনাথ পৌরসভার আলাপুর গ্রাম থেকে সাড়ে ৩ কেভি ভোল্টের একটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। শুধুমাত্র গত মাসেই বিশ্বনাথের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১২টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বিশ্বনাথ পৌরসভার আলাপুরে ১টি, কামালপুর টাওয়ারের ৩টি, পূর্ব রোকনপুর ১টি, কোনারাই টাওয়ারের ৩টি, পূর্ব কালিজুরি ১টি, টেংরা গ্রামে ২টি ও খাজাখালু খালপাড় ১টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। এর আগে ২৫ মে রাতে বিশ্বনাথ ইউনিয়নের আতাপুর গ্রাম থেকে একটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। ওই ঘটনার পরদিন ২৬ মে শুক্রবার পশ্চিম চান্দশিরকাপন গ্রামস্থ আব্দুল মুমিনের ভাঙ্গারি দোকান ও কালীগঞ্জ বাজারস্থ সোহেল মিয়ার ভাঙ্গারির দোকান থেকে চোরাই হওয়া ট্রান্সফরমারের তামার তারসহ ৩ জনকে আটক করে। ট্রান্সফরমার চুরির সাথে অভিযুক্ত আব্দুল মুমিন ও জুয়েল মিয়াসহ আরোও ৭/৮ জন চুরির সাথে জড়িত বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে। ওই ঘটনায় সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১’র বিশ্বনাথ জোনাল অফিসের ডিজিএম ছাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে ২৭ মে মামলা দায়ের করেন (বিশ্বনাথ থানার মামলা নং ১১)। কেবল এই ঘটনার তথ্য উদঘাটন করা গেলেও অন্যগুলোর কোনো রহস্য আজও উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
গ্রেফতার হলেও থেমে নেই চুরি
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের গৌরীপুর এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরির সময় জুয়েল মিয়া (৩২) ও সুহেল আহমদ (৩৫) নামের দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার দুর্গানগর এলাকা থেকে গত ১৩ এপ্রিল ছন্দু মিয়া ও হাবিবুর রহমান নামের দুই চোরকে গ্রেফতার করা হয়। হাবিবুর রহমানের ট্রান্সফরমার কাটার বিভিন্ন যন্ত্রপাতিও উদ্ধার করা হয়। গত ১৯ মার্চ ওসমানীনগরে চেক পোস্ট বসিয়ে কাভার্ড ভ্যান চালক (গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৪৬৫৮) কাউছার আহমদ ও সহকারী সোহেল আহমদকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় জব্দ করা স্বপন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির কাভার্ড ভ্যান থেকে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন ধরণের মালামাল। এ ঘটনায় ওসমানীনগর থানার উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ খবির বাদী হয়ে ওসমানীনগর থানায় দন্ডবিধির ৪১৩/৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় গ্রেফতার দুইজন ছাড়াও লিটন, তোতা মিয়া, শাহ জালাল, আবুল হোসেন ও স্বপন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির স্বত্বাধিকারী স্বপনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৩/৪ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজার এলাকার প্রগতি পাম্পের সামনে ৯ মার্চ রাতে পুলিশ ধাওয়া করে নজরুল ইসলাম নামের এক চালককে আটক করে। এ সময় ট্রান্সফরমারের যন্ত্রপাতিসহ জব্দ করা হয় তার ব্যবহৃত কাভার্ড ভ্যান (সিলেট মেট্রো-ন-১১-১২৮৫)।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার বালিশিরা পুঞ্জিতে (জেরিন) ট্রান্সফরমার চুরির সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে প্রথমে সিপন মিয়া (৩০) এবং পরে লাভলু মিয়া নামের আরেক জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী হবিগঞ্জের বাহুবল থেকে উদ্ধার করা হয় চুরি যাওয়া কিছু সরঞ্জাম। এর বাইরেও চুরির অনেক ঘটছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।