নারী নির্যাতন মামলায় ওসমানী হাসপাতালের নার্স মহেশ ও তার স্ত্রী বরখাস্ত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০২৩, ১২:২৯:৫৮ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটে স্ত্রীর দায়েরকৃত মামলায় চাকরি হারালেন স্বামী নার্স মহেশ বিশ্বাস ও মহেশের বর্তমান স্ত্রী প্রিয়লক্ষী রায় শুক্লা। তারা দু’জনেই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। নার্সিং মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর চাকরি থেকে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে গত ১৩ আগস্ট। অধিদপ্তর থেকে বরখাস্তের আদেশ পাওয়ার পর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে এই আদেশ কার্যকর করেছেন। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, আইনি লড়াইয়ে থাকা মহেশ বিশ্বাসের স্ত্রী নমিতা রানী বিশ্বাস জানিয়েছেন, প্রায় দুই বছর আগে তিনি এ নারী নির্যাতন মামলা দায়ের করেছিলেন। এরপর থেকে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। মামলার তদন্তে অভিযুক্ত হওয়ায় তার স্বামী নার্স মহেশ বিশ্বাস ও মহেশের বর্তমান স্ত্রী প্রিয়লক্ষী রায় শুক্লার বিরুদ্ধে নার্সিং মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর এ পদক্ষেপ নেয় বলেও জানান তিনি।
২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর গোপালগঞ্জের নমিতা রানী বিশ্বাস বাদী হয়ে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় এ মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার আসামী মহেশ বিশ্বাস জকিগঞ্জ উপজেলার বিরশ্রী পিবক গ্রামের মুক্তেশ্বর বিশ্বাসের ছেলে এবং অপর আসামী প্রিয়লক্ষী রায় শুক্লা বাগবাড়ি প্রমুক্ত আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। তারা দু’জন এখন স্বামী-স্ত্রী। ২০১০ সালে লিবিয়ার বেনগাজীতে থাকা অবস্থায় কুমারী নমিতার জীবনে মহেশ আসে। সিলেটের এই যুবকের সঙ্গে বেনগাজীতেই তারা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। এরপর থেকে এক সঙ্গেই বসবাস শুরু করেন। এরমধ্যে ২০১৩ সালে দেশে এসে ঢাকায় বাংলাদেশের আইন সম্মতভাবে বিয়ে করেন দু’জন। ২০১৫ সালের দিকে লিবিয়ার পাঠ শেষ করে মহেশ চলে আসেন দেশে। কিন্তু নমিতা থেকে যান চাকরিতে। নমিতা দেশে পাঠানো তার আয়ের একাংশ মহেশকে দিতেন। এরই মধ্যে মহেশ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্সের চাকরি নেন এবং জড়িয়ে পড়েন অপর নারীর সঙ্গে সম্পর্কে। প্রিয়লক্ষী নামের ওই নারীও একজন নার্স। নমিতা প্রবাসে থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালের শেষদিকে প্রিয়লক্ষীর সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন মহেশ। বিষয়টি জানার পর বেনগাজী থেকে ২০১৭ সালের প্রথমে দেশে আসেন নমিতা। সিলেটে এসে প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি। এরপর নিজ এলাকা কোটালীপাড়ায় ফিরে গিয়ে গোপালগঞ্জ আদালতে নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেন। এ মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যুর পর গ্রেফতার হন মহেশ। কারাভোগও করেন। এরপর নমিতার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেই জেল থেকে ছাড়া পান। স্ত্রী হিসেবে ঘরে তুলে সংসার করবেন এমন আশ্বাসে বিশ্বাস নিয়ে নমিতা মামলা প্রত্যাহার করেন। দুই পরিবারের মধ্যস্থতায় সব ভুলে নমিতা নতুন করে সংসার শুরু করেন।
কিন্তু ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ায় কয়েক মাস থাকার পর নমিতা চলে যান বেনগাজীতে। সেখানে গিয়ে কয়েক মাস অবস্থান করেন। এরপর স্বামীর টানে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি চলে আসেন সিলেটে। নমিতা ও মহেশ মিলে নগরের পাঠানটুলা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
নমিতা জানান, ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক সঙ্গেই তিনি ছিলেন মহেশের সঙ্গে। বার বার তিনি অন্ত:সত্বা হয়েছেন। কিন্তু সন্তান নিতে পারেননি। কখনো ভাতের সঙ্গে ওষুধ খাইয়ে, আবার কখনো তলপেটে লাথিসহ নির্যাতন চালিয়ে তার গর্ভের সন্তান নষ্ট করা হয়। বার বারই ডাক্তারের কাছে গিয়ে তাকে গর্ভপাত করাতে হয়েছে। এতে করে নমিতা মর্মাহত হন। স্বামীর এই আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ থাকলেও সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিবাদ করেননি। ২০২১ সালে অন্ত:সত্ত্বা হলে তিনি প্রতিবাদ শুরু করেন। আর তখন থেকেই তার ওপর চলে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার। মহেশের সঙ্গে একাই বাসায় থাকতেন নমিতা। এই সময়ে মহেশ তাকে নানা ভাবে নির্যাতন করতো। কখনো কখনো তিনতলা থেকে লাথি দিতে দিতে নিচে নামিয়ে আনতো। আবার ঘরের মধ্যে মুখে গামছা বেঁধে নির্যাতন করতো। নগরের সুবহানীঘাটের একটি ক্লিনিকে নার্সের দায়িত্বে থাকা নমিতা চাকরি ছেড়ে আইনি লড়াই শুরু করেন।
নমিতা রানী বিশ্বাসের দায়ের করা নারী নির্যাতন মামলার তদন্তে অভিযুক্ত হয়েছেন তার স্বামী নার্স মহেশ বিশ্বাস ও মহেশের বর্তমান স্ত্রী প্রিয়লক্ষী রায় শুক্লা। আদালত এ মামলার চার্জগঠন করে বিচার শুরু করেছেন। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নার্সিং মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর থেকে মহেশ ও তার বর্তমান স্ত্রী শুক্লাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে।
নমিতার মামলার আইনজীবী এডভোকেট সাইফুর রহমান খন্দকার রানা জানিয়েছেন, নারী নির্যাতনে দায়ের করা এই মামলাটি আদালতে বিচার শুরু হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে গত বছরের ৩০ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই নীহারিকা সরকার তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করলে আদালত তা গ্রহণ করেছেন।