মণিপুরের জাতিগত সংকট
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ আগস্ট ২০২৩, ৫:৩২:০৪ অপরাহ্ন

অ্যাডভোকেট আনসার খান
মিয়ানমার সীমান্তে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের দুটি সম্প্রদায়-মেইতি ও কুকি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত সহিংসতা চুরাচাঁদপুর জেলায় প্রথম শুরু হয়েছে গত মে মাস থেকে। এতে ব্যাপক যৌন হয়রানি ও যৌন সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। এখনও পর্যন্ত তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে এ ধরণের সহিংসতা এই প্রথম নয়।
জাতিগোষ্ঠী মেইতি, কুকিনাগাদের মধ্যেকার জাতিগত সংকট ও সংঘাতের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। অর্থাৎ এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শত্রুতামূলক সম্পর্ক অনেক পুরেনো। জমি, জনসংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতা, জাতিগত দ্বন্দ্ব, উপজাতীয় মর্যাদা, মাদক ব্যবসা এবং অভিবাসন নিয়ে মেইতি ও কুকিদের মধ্যে একটি ভয়ংকর দ্বন্দ্বের কারণে মণিপুরে গত মে মাসে সংঘাতের সূচনা ঘটেছে।
‘সেভেন সিস্টারস’ হিসেবে খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের মধ্যে একটি রাজ্য হলো সংঘাত কবলিত মণিপুর রাজ্য। ২২০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজ্যটিতে ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ২.৮৫ মিলিয়ন।
বহুভাষী, বহু আদিবাসী ও উপজাতি এবং ভিন্ন-ভিন্ন সংস্কৃতির প্রায় ৩৩ টি এথনিক গ্রুপের মানুষের বসতি হলো এই মণিপুর রাজ্য। তবে এই বহু গ্রুপের বাসিন্দাদেরকে মোটাদাগে তিনভাগে বিভাজন করা হয়েছে। যেমন: মেইতি, কুকি এবং নাগা উপজাতি। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হলো হিন্দু ধর্মের অনুসারী মেইতি সম্প্রদায়- রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫১% হলো মেইতিস এবং রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলের উপত্যকায় এদের বসতি। তাদের দখলে আছে রাজ্যের মোট ভূমির ১০ শতাংশ, যা উর্বর ও কৃষি আবাদযোগ্য ভূমি। নাগা, কুকি-চিন গোষ্ঠী প্রধানত খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী এবং রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ হলো এরা। টিলা ও পাহাড়ে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসতি, যা মণিপুরের প্রায় ৯০ শতাংশ অনুর্বর, পাথুরে ও পাহাড়ি ভূমি রয়েছে তাদের দখলে। বলা হয় ভারতের পুরানো অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীগোষ্ঠীর আবাসস্থল হলো এই পাহাড়ি অঞ্চল। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার অবশিষ্ট সাত শতাংশ মুসলমান এবং অন্যান্য ছোট ছোট সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত।
নাগা ও কুকিদের বেশিরভাগই খ্রিস্টান, এরা উপজাতির মর্যাদা ভোগ করে কারণে অ-উপজাতিরা তাদের জমি কিনতে পারে না, এমনকি সেখানে বসতিও স্থাপন করতে পারে না এবং মেইতিরা বেশিরভাগ হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং নাগা ও কুকিদের ন্যায় কোনো সুবিধা পায় না। তাই মেইতি কিছু নেতা উভয় সম্প্রদায়ের চলমান সংঘাতকে ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে পর্যবেক্ষকরা এটিকে ধর্মীয় নয়, জাতিগত কারণে সহিংসতা ঘটেছে বলে বর্ণনা করেছেন। বৃহত্তম সম্প্রদায় হিসেবে এবং হিন্দু ধর্মের অনুসারী হওয়ায় মেইতিরা প্রচুর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করে এবং সেজন্য পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্য পায়, যা অন্যান্যরা পায় না, মূল দ্বন্দ্ব এখানেই।
তবে জাতিগত এই সংঘাতের পেছনে আরও বড় কারণ রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। ১৯৫৬ সালের কাকা কালেকার রিপোর্ট অনুযায়ী, মেইতিরা ইতিমধ্যেই একটি উন্নত সম্প্রদায় এবং রাজ্য বিধান সভার ৬০ সদস্যের ৪০ আসনই উপত্যকার অর্থাৎ মেইতিদের থেকে, বাকী ২০ আসন পাহাড়িদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়। রাজ্য সভায় বেশি সংখ্যায় প্রতিনিধি থাকার কারণে মেইতিরা রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার করে আছে, যা থেকে অন্যান্য সম্প্রদায় নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করে। যেমন, ১৯৯০ দশকের পর থেকে রাজ্যের সব মূখ্যমন্ত্রী মেইতি সম্প্রদায় থেকে এসেছেন এবং কয়েক দশকধরে শুধুমাত্র মেইতি সম্প্রদায় থেকে মূখ্যমন্ত্রী আসার কারণে, রাজ্যের অন্যান্য উপজাতিরা মণিপুর নামক একটি একক সত্তার অন্তর্গত হওয়ার অনুভূতি হারিয়েছে।
মণিপুরের রাজনীতি ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যার খেলায় পরিণত হয়েছে। চিন-কুকি-মিজো উপজাতিরা আপাতদৃষ্টিতে মিয়ানমার থেকে তাদের আত্মীয়স্বজন রাজ্যে নিয়ে এসে বসতি স্থাপন করে তাদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছে বলে মেইতিদের অভিযোগ। মেইতিরা আশঙ্কা করছে যে, এটি রাজ্যের জনসংখ্যার পরিবর্তন করবে এবং এর রাজনৈতিক সমীকরণকে বিপর্যস্ত করবে। বিপুল সংখ্যক অভিবাসীদের দ্বারা বসতি স্থাপনের ফলে মেইতিরা মণিপুরের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম হতে পারে, যা ৫১ শতাংশ শুধুমাত্র অনিশ্চিতভাবে তাদের পক্ষে অবস্থান করছে। মেইতিরা দাবি করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও তারা অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যেমন, জনসংখ্যায় ৫১ শতাংশ হলেও তারা রাজ্যের ১০ শতাংশ ভূমির মালিক। কুকি ও নাগারা উপজাতির মর্যাদা পায়, মেইতিরা পায় না। তাই দীর্ঘদিন ধরেই তারা সিডিউলড ট্রাইভস বা উপজাতি মর্যাদা পাওয়ার দাবি করে আসছে। এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তাদের পক্ষে নির্দেশনা দেওয়ায় কুকিসহ অন্যান্য আদিবাসীরা এর বিরোধিতা করেছে এবং এর পরেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র রাজ্যজুড়ে। কুকি মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটসের সাতখোজাই চোংলোই হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে, কুকিদের প্রাথমিক উদ্বেগ হচ্ছে জমি।
কুকি সম্প্রদায় দীর্ঘ সময়ধরে ভারতীয় সাংবিধানিক আইনের অধীনে একটি তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং এ কারণে উপজাতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য রাজ্য পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি চাকুরী এবং রাজ্যের স্বীকৃত উপজাতীয়দের জমি ক্রয়-বিক্রয় ও মালিকানার একচেটিয়া অধিকারের মতো সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে।
মেইতিরা একটি ক্ষুদ্র তফসিলি সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় তারাও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অনগ্রসর শ্রেণীর বিবেচনায় কুকিদের ন্যায় অনুরূপ সকল সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু মেইতিরা এতে সন্তুষ্ট নয়। মেইতিরা ২০১৩ সাল থেকে সংবিধানে বর্ণিত ‘উপজাতীয় মর্যাদা’ দাবি করে আসছে এই যুক্তিতে যে, এর ফলে সম্প্রদায়টিকে যেমন ‘সংরক্ষণ’ করা যাবে, তেমনি তাদের লোকদের পৈত্রিক সম্পত্তি, ঘরবাড়ি, জমি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ভাষার অধিকার সুরক্ষিত করে রাখা যাবে। তাদের এই দাবি গত কয়েক বছর ধরে জোরালো হয়েছে, গতি পেয়েছে। এমনকি, মণিপুর হাইকোর্ট মেইতিদের দাবির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
কুকি সম্প্রদায় মেইতিদের এই দাবির বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে যুক্তি দিয়ে চলেছে যে, মেইতিরা ইতিমধ্যেই বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে। এর মধ্যে আবার যদি সাংবিধানিক ভাবে মেইতি সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়া হয়, তবে সংখ্যালঘুরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এর ফলে সরকারি সংরক্ষিত চাকুরী, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, যা সংখ্যালঘু সকল সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বিশেষ করে, পাহাড়ের জমি ক্রয়-বিক্রয় করার সূযোগ পেয়ে পাহাড়ের জমি অধিগ্রহণ শুরু করবে, এবং এর ফলে কুকি-চিন, নাগা সহ অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়কে স্থানচ্যুত করার আশঙ্কা দেখা দিবে বা জমি বিক্রি করে স্থানচ্যুত হতে বাধ্য হবে সংখ্যালঘুরা।
তফসিলি উপজাতির মর্যাদার দাবিকে ন্যায়্যতা দেওয়ার পক্ষে মেইতিদের দাবি হচ্ছে, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আগত অবৈধ অভিবাসীদের কারণে তাদের অধিকার এবং অবস্থানকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে, যা আরও সমস্যার সৃষ্টি করবে যদি না মেইতিদের উপজাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া না হয়।
আরামবাই টেংগোল ও মেইতেই লিপুনের মতো মৌলবাদী মেইতেই সংগঠনগুলো মণিপুরের পাহাড়ে শরণার্থীদের অবৈধভাবে বসতি স্থাপনের সহায়তা করার জন্য কুকি, যারা চীনের সাথে একটি জাতিগত ঐতিহ্যের অংশীদার, তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যে দশ হাজার চীনা শরণার্থী রয়েছে।
বীরেন সিং নিজে একজন মেইতি এবং বিজেপি থেকে বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য (বর্তমানে রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী), এই অভিযোগগুলোর পাশাপাশি আরও অভিযোগ করেন যে, কুকিরা মিয়ানমার থেকে পরিচালিত ট্রান্সন্যাশনাল নেটওয়ার্কগুলোর সহযোগিতায় পপি চাষসহ অবৈধ মাদকদ্রব্য ব্যবসার সাথে জড়িত। তবে অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, অবৈধ এই ব্যবসার সহিত মেইতি এবং নাগা সম্প্রদায়ের লোকজনও জড়িত রয়েছে। মেইতি সম্প্রদায় আরও অভিযোগ করে যে, কুকিরা মণিপুরের আদিবাসী নয়, যদিও কুকিদের দাবি, উনিশ শতকে মিয়ানমারের নিকটবর্তী পাহাড় থেকে ব্রিটিশরা তাদেরকে মণিপুরে পূনর্বাসিত করেছিলো। পারস্পরিক এই অভিযোগ দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিদ্যমান শত্রুতাকে আরও বেশিমাত্রায় উসকে দিয়েছে, এ যেন আগুনের মধ্যে ঘি ঢেলে দেওয়ার শামিল। বলা হয়, মণিপুর এখন সত্যিকার অর্থে একটি ভাঙা রাজ্য, যেখানে প্রতিনিয়ত মেইতি, কুকি-চিন ও নাগা, এই তিনটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত সহিংসতা ও সংঘাত অব্যাহতভাবে ঘটছে।
ভারত সরকার মণিপুরের সহিংসতাকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তখনকার এমএলএ, মানবাধিকার আইনজীবী আর. কে. আনন্দও ২০০৪ সালে এই সমস্যাকে একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, যার সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে।
সূত্র : ইম্ফল ফ্রি প্রেস, দ্য ওয়্যার ম্যাগাজিন, ওয়ার্ল্ড ক্রাইসিস গ্রুপ, বিবিসি নিউজ, সুবীর ভৌমিকের বিশ্লেষণ : মণিপুরের জাতিগত রক্তরেখা, উইকিপিডিয়া, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।