সিলেটে হাতের কাছে পাওয়া ওষুধ কীটনাশক খেয়ে বিপদে পড়ছে শিশুরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ৬:৪৭:৫৬ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম.
চোখে কান্না। চার বছরের শিশু পুত্র নোমানকে নিয়ে দিশেহারা মাসহ পরিবারের অনেকে এসেছেন ওসমানী হাসপাতালের চতুর্থতলার (তিন নম্বর ওয়ার্ডে) শিশু বিভাগে। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাৎক্ষণিক সেবা দেয়ার পর কপালের ঘাম মুছেন মা শিউলি বেগম। ভর্তির কয়েক দিন পর শিশুটির মুখে হাসি ফুটে, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। পরিবারটি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার আলাপুর গ্রামের বাসিন্দা।
হাসপাতালে শিশুটির মায়ের সাথে কথা হলে তিনি জানান, নোমান স্প্রাইট মনে করে পানি মিশ্রিত অ্যাসিড খেয়ে ফেলেছে। চমকে ওঠার মতো ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, নোমানের চাচা ব্যাটারিচালিত টমটম গাড়ির চালক। ঘটনার দিন তিনি নিজের ভাতিজাকে দোকান থেকে কিনে স্পাইট খাইয়েছিলেন। খাওয়া শেষে গাড়ির ব্যাটারির ব্যবহৃত এসিড ওই স্প্রাইটের বোতলে রেখে অন্য কাজ করছিলেন। সবার অগোচরে স্প্রাইট
ভেবে ওই বোতলের কিছু এসিড খেয়ে ফেলে নোমান। একপর্যায়ে সে কান্নাকাটি শুরু করলে পরিবারের সবাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
নোমানের মতো এরকম বহু শিশু ঘরে থাকা কীটনাশক কিংবা বড়দের ওষুধ খেয়ে আক্রান্ত হয়ে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন, প্রতিসপ্তাহে এরকম রোগীর দেখা মিলছে-এমনটা বলছেন হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসরা। তারা বলছেন, বেশীরভাগ ঘটনাই ঘটছে পরিবারের অসাবধানতার কারণে।
গত ৯ আগস্ট নোমান এসিড খেয়ে হাসপাতালে আসে। এর দুদিন পর সিলেট বিমানবন্দর এলাকার বড়শালা এলাকার এক প্রবাসীর মেয়ে শিশুকে একই ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। শিশুটির বাবা জানান, বাসায় তেলাপোকার উৎপাত বেড়ে গেছে। এজন্য ঘটনার আগের রাতে তিনি তেলাপোকা মারার জন্য একধরণের চক ব্যবহার করেন। নির্দিষ্টস্থানে ব্যবহারের পর চকের প্যাকেটটি ভুল করে তিনি বিছানার পাশে রেখে দেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠে তার তিন বছরের সন্তান ছামিয়া (ছদ্ম নাম) সবার অগোচরে ওই চক খাওয়া শুরু করে। এসময় তারা দেখে ফেলায় সাথে সাথে বমি করানোর চেষ্টা করেন। মুখদিয়ে ফেনা সহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়ার পর তড়িৎ নিয়ে আসেন হাসপাতালে।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘এক থেকে চার কিংবা পাঁচ বছর বয়সের শিশুরা এই ঝুঁকিতে বেশী পড়ে। এসময় অনেকে হাসপাতালে না গিয়ে রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেন। এতে শিশুর বিপদ হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছাকাছি হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রোগীকে পৌছানো।’
এ প্রসঙ্গে কথা হলে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আখলাক আহমেদ জানান, ‘ওসমানী হাসপাতালে এমন রোগী আমরা পাই। এরকম বিষক্রিয়ায় শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। এক্ষত্রে আমরা সবসময় অভিভাবকদের সতর্ক করি। আমরা বলি, তারা যেন নিজেদের ব্যবহৃত ওষুধ কিংবা বিষাক্ত কীটনাশক শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন। একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনো ধরণের কীটনাশকই ঘরে রাখা উচিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘ওসমানী হাসপাতালে কেরোসিন, কীটনাশক খেয়ে প্রায় প্রতিদিন রোগী আসে। অনেক সময় অভিভাবকরা কোকাকোলা কিংবা স্প্রাইট বোতলের মধ্যে কীটনাশক রেখে দেন। শিশুরা খাবার ভেবে সেগুলো খেয়ে ফেলে। তাই বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত রাখতে হলে ওষুধ থেকে শুরু করে ক্ষতিকর কীটনাশক থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। তারপরও শিশুরা বিষাক্ত কিছু খেলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে কিংবা নিকটস্থ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যেতে হবে। এসময় কি খেয়েছে সে বিষয়ে অভিভাবকদের নিশ্চিত হওয়াটাও জরুরী।’
শিশুদের মতো কিশোররাও অনেক সময় বড়দের ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, চিকিৎসা নিচ্ছে। তেমনি এক ঘটনা ঘটেছে শ্রীমঙ্গলের বরুণা গ্রামের রাসেলের জীবনে। মাসখানেক পূর্বে এ ঘটনা ঘটে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ঘরে একসাথে থাকা সবার অনেকগুলো ওষুধের মধ্যে নিজের ওষুধের বদলে ভুল করে মায়ের জটিল রোগের ওষুধটি খেয়ে ফেলে অষ্টম শ্রেণি পড়–য়া রাসেল। ওষুধটি খাবারের পর তার মধ্যে অচেতনতা দেখা দেয় এবং অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বিষয়টি বুঝতে পেরে দেরি না করে হাসপাতাল নিয়ে আসে পরিবার।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মীনাক্ষী চৌধুরী অভিভাবকদের বেশী সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এধরণের কিছু খেয়ে ফেললে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক অভিভাবক বমি করানোর চেষ্টা করেন, সেটি মোটেও উচিৎ নয়।’
সতর্কতা স্বরূপ প্রতিটি ওষুধের গায়ে লেখা থাকে ‘বাচ্চাদের হাতের নাগালের বাইরে রাখুন’। ছোট্ট এই সতর্কতাকে গুরুত্ব দিলে একটি শিশুর জীবন যেমন সুরক্ষিত থাকে তেমনি গুরুত্ব না দিলে জীবন বিনাশেরও কারণ হতে পারে-এমনটা মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।