জাতীয় মাছ ইলিশ প্রসঙ্গে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ৫:৪৭:৪৩ অপরাহ্ন

গোলাম সারওয়ার
জাতীয় মাছ ইলিশ আমাদের কয়জনের ভাগ্যে জুটে? অথচ এটা জাতীয় মাছ। সবার ঘরে ঘরে সুলভমূল্যে পৌঁছার কথা। কিন্তুু অতিরিক্ত দামের কারণে জাতীয় মাছ ইলিশ আমাদের ভোজন হয় না।
ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ ধরা পড়ার খবর দেশের সবকয়টা পত্রিকায় সব কয়টা টিভি চ্যানেলের পর্দায় প্রচারিত হচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ ধরা পড়ার জন্য অবশ্যই সরকারের কৃতিত্ব রয়েছে। ইলিশ মাছ নিধনের জন্য সরকারের ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে ইলিশের ফলন ভালো হয়েছে। আকারে বড় হয়েছে, ওজনও বেড়েছে। পোনা নিধন বন্ধ করা সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছিল। পয়লা বৈশাখে ইলিশ সংস্কৃতিও বন্ধ ছিল। শুধু একটা দিনকে কেন্দ্র করে ইলিশের ওপর কী পর্যন্ত চাপ ছিল, কী পর্যন্ত নির্যাতন ছিল তা পয়লা বৈশাখ এলেই বুঝা যেত। অথচ পয়লা বৈশাখে পান্তার সাথে ইলিশের কোনো সম্পর্কই ছিল না। অসাধু ব্যবসায়ী চক্র পয়লা
বৈশাখে ইলিশের সংস্কৃতি চালু করল। আর লুফে নিল অপসংস্কৃতির ধারক বাহক কিছু বাউন্ডেলে।
সরকারের ইতিবাচক ভূমিকায় এই বাউন্ডেলেরা এখন কীভাবে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে? পয়লা বৈশাখের সাথে যে ইলিশের সংশ্রব নেই তাতো এখন দিবালোকের মত পরিষ্কার। পোনা ইলিশ ধরা বন্ধ করায়, ইলিশের বাম্পার ফলন হয়েছে নিঃসন্দেহে। সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে আবারও কৃতজ্ঞতা জানাই।
\কিন্তু মুশকিল হচ্ছে দাম তো আকাশ ছুঁই ছুঁই। আকাশচুম্বী দামের কারণে ইলিশ এখন আমাদের নাগালের বাইরে। ১ কেজি ইলিশ মাছ হাজার হাজার। কয়জনের ভাগ্যে জুটবে এই দামে? জাতীয় মাছ ইলিশ দেড়শ দুইশত টাকার মধ্যে থাকলে হয়তো বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যেত। ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারলেই তো এটা জাতীয় মাছ।
ঘরে ঘরে সুলভ মূল্যে কাঁঠাল পৌঁছে বলেই তো এটা জাতীয় ফল। পুকুরে পুকুরে বিনা চাষে যে ফুলটি দেখতে পাওয়া যেত সেটা হচ্ছে শাপলা। যদিও পুকুর-দীঘির সংখ্যা কমে শাপলার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে তবুও এটি আমাদের জাতীয় ফুলই রয়ে গেছে। দোয়েলের চেয়ে কাকের সংখ্যা বেশি হওয়ার পরেও জাতীয় পাখি কাক হতে পারল না। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সুন্দরবনে নাকি ৫০০ এর মত বাঘ আছে অর্থাৎ ডোরা কাটা রয়েল বেঙ্গল আছে। চিতা বাঘ নাকি এর চেয়ে বেশি। রয়েল বেঙ্গলের চেয়ে দৌড়ায়ও বেশি। এরপরও ডোরা কাটা বাঘই আমাদের জাতীয় পশু। অথচ এই জাতীয় পশুর চেয়ে বরং গরু ছাগলের সংখ্যা বেশি। সংখ্যাধিক্যে এদের প্রভাব থাকলেও এরা জাতীয় পশু হতে পারেনি।
আসলে জাতীয় নামকরণ কীভাবে হয় আমার অবশ্য জানা নেই। তবে যে সংখ্যার আধিক্যে জাতীয় উপাধি অর্জন হয় না, এটা নিশ্চিত। তা না হলে ইলিশের চেয়ে রুই, কাতলা, মৃগেলের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও এদের ভাগ্যেও জাতীয় পর্যায়ের নাম নেই। রুই কাতলা, মৃগেল শুধু হাওর, বিলে উৎপাদন হয় না, যে কোনো জলাশয়ে এদের চাষ করে উৎপাদন করা যায়। সারা বছরই নগরের মাছ বাজারে পাওয়া যায়। গ্রামে-গঞ্জের বাজারে তো এসব মাছই পাওয়া যায়। ইলিশ? না, ইলিশ সর্বত্র পাওয়া যায় না। এরপরও এটি আমাদের জাতীয় মাছ। সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য-পাঠক আপনারাই বলুন।
যেভাবেই হোক জাতীয় মাছের স্বাদ তো আমাদের পেতেই হবে। কিন্তু দাম যদি ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না আসে তাহলে তো এটা দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। সরকারের সদিচ্ছায় যদি আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন না হয়, তা হলে তো মহা বিপর্যয়। সরকারের সদিচ্ছা শুধু ইলিশ ফলনের দিকে নয়। দেশের মানুষ যাতে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সেজন্য সরকার নানান খাতে প্রতি বছর রাজস্ব ছাড় দিয়ে আসছে। অথচ ব্যবসায়ীদের লাভের চাপে চ্যাপ্টা মানুষ। সরকার গত ২ বছরে কৃষিপণ্য ও সেবা খাতের ওপর ২৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ছাড় দিয়েছে। কিন্তু এসব রাজস্ব ছাড়ের সুবিধা ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেল। ১৩ হাজার কোটি টাকার ছাড় রয়েছে ভোজ্য তেল ও চিনিতে। ভোজ্য তেল এবং চিনি সারা বিশ্বে যখন ব্যাপক হারে কমতে শুরু করল আমাদের এখনও নট নড়ন-চড়ন অবস্থা আর কি?
পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতে ছাড় রয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা যাতে মানুষ ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে মাছ-মাংস-ডিম পায়। কিন্তু সরকারের এসব ছাড়কে উপেক্ষা করে অসাধু ব্যবসায়ীরাই লুটে নিচ্ছে সরকারের বিশেষ বিশেষ ছাড়। কিন্তু সরকার যাদের উদ্দেশ্যে এসব ছাড় দিল তারা কি পেল কম দামে ডিম, মাংস বা মাছ কিনতে?
পশু-খাদ্য, কৃষি যন্ত্রপাতি ও কীটনাশকেও ছাড় রয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ পশুখাদ্যের উর্ধ্বমূল্যের দোহাই দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কী-না করে বেড়াচ্ছে? কৃষক ন্যায্যমূল্যে সার, কীটনাশক পাচ্ছে না। অথচ সরকারের রাজস্ব ছাড়ের সবটুকুন অংশই যাচ্ছে অসাধু চক্রের পকেটে।
আমরা সাধারণ জনগণ সবসময়ই বলে আসছি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকার নজর দিতে পারছে না অসাধু চক্রকে থামাতে। অসাধু চক্র দিন দিন আরো অসাধু তৎপরতা বাড়িয়েই চলছে। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হোক আমাদের প্রত্যাশা। তবে আমাদের এই প্রত্যাশা আলোর মুখ দেখবে না যতদিন না রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হয়। শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনীতি হওয়া সুখকর নয়। ক্ষমতায় না থেকেও বেসরকারি দল দেশের প্রতি দেশের ভুখানাঙ্গা মানুষের প্রতি নজরদারি স্থাপন করে দেশ সেবা করতে পারে। ক্ষমতায় যারা আছেন তাদেরকে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সরকার পরিচালনায় সহযোগিতা করা দরকার। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের ব্যত্যয় ঘটলে তখন বেসরকারি দল উগ্রমূর্তি ধারণ করলে অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। রাজনৈতিক কোনো সংগঠনই ক্ষমতার বাইরে থাকতে রাজী নয়। আমরা দেখেছি, সংসদীয় গণতন্ত্রে বেসরকারি দলগুলো সংসদে থাকতেই চান না। সেটা আওয়ামী লীগই হোক বা বিএনপি সংসদে অবস্থান করে জনগণের ন্যায্য দাবী আদায়ে বেসরকারি দলগুলো কেন জানি ওয়াকআউট করেন। অথচ সংসদে ফাইট করলেই জনগণের জন্য একটা কিছু হয়েছে বলে আমরা পুলক অনুভব করতাম। কিন্তু বছরের পর বছর ৫টি বছর চলে যায় বেসরকারি দল সংসদে দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে পারেন না। সত্যি, এ আচরণ জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের।
ফিরে আসি, ইলিশে। আয়োডিনযুক্ত সামুদ্রিক মাছ ইলিশ বছরে একবার হলেও বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছা দরকার। মানবদেহে স্বল্প পরিমাণে হলেও আয়োডিনের দরকার আছে। ইলিশ মাছে শুধু আয়োডিন নয়, প্রচুর পরিমাণে এমাইলো এসিড এবং ওমেগা-ত্রি ফ্যাটি এসিড রয়েছে, যা আমাদের বছরে একবার হলেও স্বাদ নেয়া উচিত।
দলমত নির্বিশেষে, এমনকি সাধু অসাধু ব্যবসায়ী মিলে হলেও এদেশের মানুষকে বছরে অন্তত ১ বার ইলিশ খেতে দিন সুলভ মূল্যে। তা না হলে জাতীয় মাছ বড় বেমানান, বড় উপেক্ষিত হয়ে থাকবে এই জাতির কাঁদে।
লেখক : কলামিস্ট।