পাকিস্তানি নৃশংসতার দলিল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ৬:১৫:৪৬ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পার হলেও সব বধভূমি ও বধ্যভূমি যথাযথ সংরক্ষণ ও সংস্কার হয়নি। এর মধ্যে অনেকগুলো চিহ্নিত হলেও আরও অনেকগুলো চিহ্নিত না হওয়ায় অরক্ষিত ও হারিয়ে যেতে বসেছে। এর মধ্যে রয়েছে কুমিল্লার ১৫ বধ্যভূমি ও বরগুনার ৫টি গণহত্যা, ৪টি বধ্যভূমি।
কুমিল্লার ১৫ বধ্যভূমি
কুমিল্লার সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও স্থানীয় জনগণের। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার সাক্ষী অর্ধশত বধ্যভূমির মধ্যে ১৫টি চিহ্নিত করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্যগুলোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে ওইসব বধ্যভূমির বেদনাদায়ক স্মৃতিচিহ্ন।
ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট বধ্যভূমি
এই বধ্যভূমিতে বাঙালি সেনা অফিসার, সৈনিক, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গৃহবধূ, মসজিদের ইমামদের ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছে। ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অমানুষিক নির্যাতনের পর এখানেই হত্যা করা হয়। এখানে মোট ১২টি গণসমাধি রয়েছে। গণসমাধি খনন করে সাত হাজার নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে।
লাকসাম বধ্যভূমি
লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে কেবিন বরাবর পূর্বদিকে এ বধ্যভূমির অবস্থান। কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশ, বৃহত্তর নোয়াখালী, এবং চাঁদপুর থেকে যুবক-যুবতীদের ধরে আনা হতো এখানে। তাদের হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো। জীবিত মানুষদের হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করতো এবং লাথি মেরে লাশ গর্তে ফেলা হতো। এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে ধরে এনে ১০ হাজার বাঙালিকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছিল হানাদার বাহিনী।
মুদাফফরগঞ্জ বধ্যভূমি
স্থানীয় রাজাকার ও পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী এখানে ৩৭ জন বাঙালিকে হত্যা করে। পাশের একটি বাড়ি থেকে চার কিশোরীকে ধরে এনে দলঁেবধে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। তিন চার দিন পর পাশের একটি খালে তাদের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়।
হাড়ং গণকবর
চান্দিনার হাড়ং গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ির পাশে তর্ঁার একখন্ড জমিকে গণকবর হিসেবে ব্যবহার করতো। কত মানুষকে হত্যার পর এখানে মাটিচাপা দিত।
আমড়াতলি গণকবর
মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে নির্যাতন ও হত্যার পর ৩৬ জনকে গণকবর দেওয়া হয়।
বেতিয়ারা গণকবর
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে চৌদ্দগ্রামে বেতিয়ারা গণকবর অবস্থিত। ১৯৭১ সালে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি জঙ্গি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। এই ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে কবর দেওয়া হয়। বেতিয়ারার শহীদদের কবরস্থানটি এখন আগের জায়গায় নেই। মহাসড়কটি চার লেন করায় শহীদদের সমাধি স্থানটি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দেবিদ্বার বধ্যভূমি
একাত্তরের ২৪ জুলাই হানাদার বাহিনী দেবিদ্বারের বাখরাবাদ গ্রামে ১৪২ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। অন্য ২৩ বাঙালিকে দেবিদ্বার সদরের ডাক বাংলার সামনে ফাঁকা জায়গায় এনে চোখ বেঁধে হত্যা করে। এখান থেকে কৌশলে তিন জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি
মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। পরে নাঙ্গলকোটের পরিকোট বধ্যভূমির তিনটি কবরে তাদের সমাহিত করা হয়।
রসুলপুর বধ্যভূমি
পাক সেনারা রসুলপুর রেলস্টেশনে ক্যাম্প করেছিল। তারা ৫০০ নিরীহ নারী-পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। পরে স্টেশনের অদূরে একটি টিলাতে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। ২০০৫ সালে বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
বরগুনার বধভূমি
বরগুনার বধভূমি বা বধ্যভূমি চেনার উপায় নেই। বরগুনার শহীদদের গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো অযতœ, অবহেলা আর দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়ে গেছে। সে সময় বরগুনা ছিল একটি মহকুমা। জেলা ছিল পটুয়াখালী। একাত্তরের ৯ মাসে হানাদাররা জেলায় ৫টি স্থানে গণহত্যা চালায়। এর মধ্যে বরগুনায় একটি, আর পাথরঘাটায় চারটি বধ্যভূমি রয়েছে। তখন বরগুনা মহকুমা ছিল পটুয়াখালী জেলার অধীনে এ অঞ্চলে পাকিস্তানি আর্মির হেডকোয়ার্টার ছিল পটুয়াখালীতে। তাদের সাব সেন্টার ছিল বরগুনা মহকুমার সিএ্যান্ডবি কার্যালয়ের ডাক বাংলোতে। পাক আর্মিরা বরগুনা জেলখানায় ২৯ মে (৭১ সাল) দিনের বেলায় গণহত্যা শুরু করে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সুন্দরী মেয়েদের ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে ধরে এনে এখানে নির্যাতন করে হত্যা করতো। প্রথম দিনেই হত্যা করে ৩১ জনকে। এখানে ফারুক ভেন্ডার নামে একজনকে হত্যার জন্য বার বার গুলি করে। কিন্তু তিনি অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান। বরগুনা জেলখানায় ওই ফারুক ভেন্ডারের দুই ভাই মোশারফ হোসেন শানু ও নাসির উদ্দিনকে হত্যা করে। এই দুইজন সহ ৫৬ জনকে তারা হত্যা করে জেলখানায়।
বরগুনার পাথরঘাটায় চারটি বধ্যভূমি রয়েছে। এর দুটিতে সীমানা প্রাচীর থাকলেও অন্য দুটির সীমানা প্রাচীর নেই। পাথরঘাটা উপজেলার পৌর শহরের তাসলিমা মেমোরিয়াল স্কুল রোডের বধ্যভূমিতে পিতা-পুত্র দুইজনের স্মৃতিফলক আছে। পিতা শহীদ মালেক মাস্টার বাধ্য হয়ে পিস (শান্তি) কমিটিতে ছিলেন। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন। এই অপরাধে মালেক মাস্টার ও তার ছেলে শাহজাহান মোল্লাকে একই স্থানে গুলি করে হত্যা করা হয়। সাবেক পাথরঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রিপন মোল্লা তার দাদা মালেক মাস্টার ও বাবা শাহজাহান মোল্লার নামে বধ্যভূমিকে চিহ্নিত করে নাম ফলক লাগিয়েছেন।
ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন নামক একটি বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পাথরঘাটা উপজেলার সিংড়াবুনিয়া গ্রামে সাত স্তম্ভের একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে সাতজন বীর শহীদ শায়িত আছেন। তারা হলেন (১) চন্দ্রকান্ত হাজরা (২) অশ্বিনী কুমার বালা (৩) লক্ষ্মী কান্ত গয়ালি (৪) ক্ষিরোধ বেপারী (৫) মনোরঞ্জন বেপারী (৬) নিত্যানন্দ বেপারী এবং (৭) অনন্ত হাওলাদার। এদের একমাত্র অপরাধ তারা হিন্দু ছিল। তারা দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছিল। জল্লাদ পাক সেনারা এলাকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে না পেয়ে ১০ মে, ’৭১ সালে ওই গ্রামের ৭ জন মানুষকে ধরে নিয়ে খালের চরে গুলি করে হত্যা করে।
এছাড়া একাত্তরের ১৫ আগস্ট সকাল ৮ টার দিকে পাথরঘাটার তালুক চরদুয়ানী খেয়াঘাটে বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান, মনোহর মিস্ত্রী, কর্ণধর মিস্ত্রী ও মথুরানাথ মিস্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। এদের মধ্যে একমাত্র মনোহর মিস্ত্রীকে নিজ বাড়ির আঙিনায় দাফন করেন স্থানীয় লোকজন। অন্য ৩ জনের মৃতদেহ পানিতে ভেসে যায়। এখানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন বা মিনার নির্মিত হয়নি। কালের বিবর্তনে খেয়াঘাটের স্থানে কংক্রিটের ব্রিজ নির্মাণ হয়েছে। পাথরঘাটার অন্য দু’টি বধ্যভূমি অযতœ অবহেলায় পড়ে আছে। এর একটি পাথরঘাটা পৌরসভার বিষখালি নদী সংলগ্ন ডকইয়ার্ড এলাকায়, অন্যটি কাঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদোয়ানী খেয়াঘাটে।
লেখক : সিনিয়র কলামিস্ট।