বিজ্ঞানী, গবেষক বনাম প্রশাসক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১:২৭:০৩ অপরাহ্ন
শেখর ভট্টাচার্য
বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন ২০২২ সালে, প্রস্তাবটি ছিলো বাংলাদেশে একটি বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা। সরকারি চাকরি বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিসের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরা শিক্ষার্থীদের করুণ অবস্থা দেখে তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০২২ সালে তাঁর বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ‘কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকেই তাকাবেন, শুধুই প্রশাসক’। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের অনুজ সৈয়দ কামরুল ইসলাম আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই শৈশব-কৈশোর থেকে তার মেধা এবং নীতিনিষ্ঠার গল্প শুনে শুনে বড় হয়ছি। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শ্রদ্ধেয় অগ্রজকে তার দেয়া নামটির সামান্য সংশোধনের অনুরোধ করছি, এই অনুরোধটি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বাংলাদেশ বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় নামটি পরিবর্তন করে, ‘বাংলাদেশ প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়’ করে দিলে আমার মনে হয় চাকরি এবং অন্তরের ভিতরে শাসন করার যে অভিপ্রায় দুটোই মিটে যাবে। সকল ক্যাডারই যেখানে প্রায় প্রশাশনিক কর্মে নিয়োজিত (বিসিএস শিক্ষার মতো কয়েকটি ছাড়া) এ কারণে সংশোধিত নামটি গৃহীত হলে সকল পক্ষের মনেই আনন্দের নহর বয়ে যাবে।
বিসিএস প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করেন তারা যেকোন পদকে শোভিত করতে পারেন, ক্ষমতাসীন সরকার যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তারাও তাই মনে করেন। এই মনে করার জন্য শুধুই তাদের দোষ দেয়া যায়না। মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে শিল্প গবেষণা, শিল্প, ঋণ, ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে সাধারণ বীমা, সব পদকে তারা আলোকিত করতে পারেন। প্রশাসন থেকে পররাষ্ট্র, পররাষ্ট্র থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী, কোন পদেই তারা বেমানান নন।যে কোন ক্যাডারের মাথার উপর মুকুটের মতো শোভা হয়ে তারা থাকতে পারেন। কেনো এমন হলো? মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন! দেশে যৎ সামান্য কৃষি গবেষণা ছাড়া, আর কোন গবেষণা পাওয়া যায়না, যা সকলের চোখে পড়ে। গবেষণা বিষয়টি দেশে অনাকর্ষণীয় করে রাখা হয়েছে। অন্য কোন চাকরির মতো গ্ল্যামারাস নয়। যারা গবেষণা করেন তাদের যে খুব সম্মান ও সম্মানী আছে, তা’ বলা যাবেনা। এ কারণে সবাই ছুটছে জনসেবক হতে! দরিদ্র কৃষক, শ্রমিকের সন্তানও যদি তৈলাক্ত বাঁশ দিয়ে উপরে একবার উঠে যেতে পারে তাহলে সব ভুলে যায়। প্রচলিত ব্যবস্থা তাকে বলে “ওহে বালক তুমি এখন নীল রক্তধারী। ভুলে যাও, জমি বন্ধক দিয়ে লেখা পড়ার কথা। ভুলে যাও শ্রমিক বাবার শ্রম, ঘামের কথা। গল্পকার হয়ে যাও। বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়িতে জানিয়ে দাও, খান বাহাদুর, রায়বাহাদুর ছিলো তোমাদের পূর্বপুরুষ। সাধারণ মানুষ, সাধারণ আত্মীয় বড়ই সাধারণ! দূরে থাকো, অনেক দূরে।
প্রশ্ন হলো কেন এমন হচ্ছে? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রশাসকদের জয়জয়কার। এই রাষ্ট্রে বিজ্ঞানী, গবেষক ও দার্শনিকদের কোনো মূল্যায়ন হয় না। তারা থাকে অবহেলিত, ক্ষমতাহীন। ফলে নতুন প্রজন্মের কেউ বিজ্ঞানী, গবেষক হতে চায় না। কী ছাত্র, কী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সবাই প্রশাসক হয়ে চায়। ভাবা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত নিয়োগের পরদিন থেকে একাডেমিক কাজ কর্মের চেয়ে প্রশাসনিক পদ-পদবী পেতে দৌড় ঝাঁপ শুরু করেন। প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন সহকারী প্রক্টর, প্রক্টর, হাউজ টিউটর, প্রভোস্ট, ডিন, শিক্ষক সমিতির নেতা, বিভিন্ন ইন্সটিটিউট বা রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক, উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য বা কিংবা কোষাধ্যক্ষ হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি শুরু করে দেন। প্রতি বছরই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। এতে করে ৪০-৫০ বছরের শিক্ষকদেরও দেখি উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য হয়ে যেতে। অথচ এই বয়সটাই হলো শিক্ষার্থীদের দেওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়েই একজন শিক্ষক পিএইচডি শেষে মাত্র অধ্যাপক হয়েছেন। তখন শিক্ষক তার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও গবেষণার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পড়াতে পারেন এবং একই সাথে গবেষণা করাতে পারেন। কিন্তু সেইদিকে তারা হাঁটছেন না। তারা হাঁটছেন প্রশাসনিক পদ-পদবীর দিকে।
নাগরিক হিসেবে আমাদের এতে সমস্যা কোথায়? আমাদের সমস্যা হলো, স্বাধীনতার বয়স। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বায়ান্ন থেকে তিপ্পান্নতে পা রাখলো। আমরা আমাদের শিক্ষার, শিক্ষিত জনসম্পদের গন্তব্য ঠিক করতে পারলামনা অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ব্যয় করে। আমরা মজে আছি নারীদের পোশাক, যাতায়াত, পারিবারিক, সামাজিক ভূমিকা কী হবে তা নিস্পত্তি করার জন্য। দুর্নীতির দিক থেকে যদিও আমরা বিশ্বের উপরের সারির দেশ, ধর্মালোচনাতেও কোন র্যাঙ্কিং করলে আমরা পিছিয়ে থাকবোনা। আমাদের প্রান্তিক মানুষেরা ধর্মভীরু। কিন্তু মধ্যবিত্তের মতো ধর্মান্ধ নন। তারা যদি মধ্যবিত্তের মতো শুধু সামাজিক মাধ্যমে ধর্মচর্চা করতেন তাহলে আমরা, কৃষি, শিল্প উৎপাদনে যতো টুকু এগিয়েছি ততটুকু মোটেই এগোতে পারতামনা। এতো বড় করোনা মহামারি অতিক্রম করলাম আমরা, আমাদের কৃষকদের কারণে বাজারে কোন খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি হয়নি। স্বাধীনতার পর পর আমরা কুদরতে খুদার বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা শুনে আসছি। কিন্তু আমরা ক্রমাগত অন্ধকারমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। এর ফলে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়া পর্যবেক্ষণ করছি।
আমাদের মধ্যম মানের শিক্ষার্থীরা গৎবাঁধা পথে পরিশ্রম করে পৃথিবীর স্বর্গ লাভ করছে বিসিএস পাশ করে। আর যারা প্রকৃত মেধাবী তারা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য এবং শিক্ষা শেষে থেকে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বে। চূড়ান্তভাবে কী হচ্ছে? আমাদের প্রকৌশল শিক্ষার্থীসহ সকল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেধাবী শিক্ষার্থীদের আমরা হারাচ্ছি, শিক্ষা, গবেষণা শেষে তারা দেশের জনগণকে কোন সেবা দিতে পারছেনা। আমাদের বাম্পার ফলন হচ্ছে প্রশাসকের। এতো প্রশাসক দিয়ে রাষ্ট্রের কী হবে? ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন, শোষন ছাড়া আর কিছু হবে বলে মনে হয়না।
পড়শীর বাড়িতে মুখরোচক রান্নার গন্ধ পাওয়া গেলে নিজের বাড়ির উপাদেয় রান্নার উপাদান কী আছে মানুষ খুঁজে বেড়ায়। মহাকাশে দীর্ঘ এক মাস নয় দিনের যাত্রা শেষে ভারতের মহাকাশযান চন্দ্রযান-থ্রি চাঁদের বুকে অবতরণ বা ‘সফট ল্যান্ডিং’ করতে সমর্থ হয়। ভারতীয় মাকাশ যান ২৩ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করে ভারতকে এলিট ‘স্পেস ক্লাবের সম্মানিত সদস্যের মর্যাদা দিতে সক্ষম হয়। ২৩ আগস্ট ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে এই ঐতিহাসিক সাফল্যের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত এই গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের দিক থেকে তারা প্রথম হওয়ার গৌরব লাভ করে। ভারতের মহাকাশযানের চাঁদে পৌছুনোর সংবাদ পেয়ে বাংলাদেশের মানুষ কৌতূহলী হয়ে নিজেদের গবেষণাগার, মহাকাশ গবেষণা বিভাগের কার্যক্রম জানতে উৎসুক হয়ে ওঠে।
যদি মহাকাশ গবেষণার কার্যক্রম জোরালো থাকতো তাহলে মানুষের এ বিষয়টি অনুসন্ধানের প্রয়োজন হতো না। অধিকাংশ মানুষ বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা সম্পর্কে কিছুই জানেনা। পরিশেষে জানা গেলো আমাদেরও একটি প্রতিষ্ঠান আছে যার বাংলা নাম “বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান’। কার নেতৃত্বে এখানে কাজ হচ্ছে? সেখানেও প্রশাসক। সারা দেশবাসীর আক্কেল গুড়ুম! ভারতীয় চন্দ্রাভিযানের সফলতার সংবাদ পাওয়া না গেলে স্পারসো বা মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠাণের প্রধান কে, এ নিয়ে মানুষের তেমন কৌতূহল থাকতো না? আমাদের স্পার্সোর প্রধানের নাম মোঃ আব্দুস সামাদ। তিনি বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব। ২৬ জুলাই ২০২২ তারিখে তিনি বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। মোঃ আব্দুস সামাদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিষয়ে স্নাতক এবং চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যেখানে ম্যাকানিকেল ইঞ্জিনিয়ার, মহাকাশ বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে মেধাবী মানুষেরা এরকম সংস্থার হাল ধরেন সেখানে আমরা কৃষি বিষয়ক স্নাতককে এপদ অলংকৃত করার সুযোগ দিয়েছি। দোষটি ব্যক্তির নয়, কোন দোষ থেকে থাকলে তা হলো ব্যবস্থার; আর একটু খোলাসা করে বললে দোষ হলো আমাদের বহু দিনের চর্চিত অপরাজনীতির।
বিনয়ের সাথে সেই পুরোনো রেকর্ড থেকে বহুল উচ্চারিত সেই পুরোনো কথা বলছি আবারো। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে যদি আমরা অন্ধকারমুখী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করি, তাহলে দেশে ভুরি ভুরি প্রশাসক, কেরানী পাওয়া যাবে; বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্মার্ট বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ পাওয়া যাবেনা। এখনও সময় আছে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিকে প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমুখী করে তোলার। এ কাজে ব্যর্থ হলে আমাদের গন্তব্য হবে গভীর অন্ধকারে, যে অন্ধকার ভেদ করে জাতি হিসেবে আমাদের আর আলোতে ফেরত আসা সম্ভব না’ও হতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।