চিরঞ্জীব মুহম্মদ নূরুল হক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৪:১৬:০৫ অপরাহ্ন
ড. সাহেদা আখতার
আমাদের জাতীয় জীবনে আজ যেসব স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বিস্মৃতির অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে নিজ কীর্তির মহিমায় দ্যুতিভাস্বর, তাদেরই একজন মুহম্মদ নূরুল হক। সিলেট থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রাচীনতম মাসিক পত্রিকা ‘আল-ইসলাহ’ (১৯৩২) ও ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট’ (১৯৩৬) এর আজীবন সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হক ছিলেন নীরব কর্মী ও সাধক। বিশ শতকের (১৯০৭) প্রথম পাদে জন্মগ্রহণ করে গৌরবী শেষ ভাগ পর্যন্ত মুহম্মদ নূরুল হক আপন অস্তিত্বে দেদীপ্যমান।
পত্রিকা সম্পাদনায়, সাহিত্যসাধনায়, সাহিত্যচর্চার পৃষ্ঠপোষকতায়, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায়, ভাষা আন্দোলন ও সমাজকর্মে এই বহুমুখী প্রতিভায় তাঁর অনন্যতার প্রমাণ রেখেছিলেন। যা ছিল বিস্ময়কর। বাহুল্যবর্জিত দেহ আর কুসংস্কারমুক্ত মন নিয়ে তিনি পশ্চাদপদ সমাজের দায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে আস্থার সাথে সে দায় বহন করেছেন। অর্থ, বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তির মোহহীন কর্মশক্তি ও মেধার সমন্বয়ে যুগসৃষ্টিতে ব্রতী হয়েছেন। দায়ভার পৌঁছে দিয়েছেন প্রজন্মান্তরে।
মুহম্মদ নূরুল হক তাঁর স্বপ্নময় কৈশোর, কর্মচঞ্চল সৃষ্টিমুখর যৌবন আর পরিণত বয়সের প্রজ্ঞা, মেধা ও মননশীলতাকে স্বসমাজের জাগরণে উৎসর্গ করেছেন। বিনিময়ে প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছিল না, কিছুই পাননি। আলোর দিশারী এ ব্যক্তিত্বের কাছে আমাদের ঋণ অপরিমেয়, অপরিশোধ্য।
বিশ শতকের শুরুতে অনুকুল পারিবারিক পরিবেশে মুহম্মদ নূরুল হকের জীবন শুরু। সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিলো প্রতিকূলে। আরবি ফারসি ভাষায় পারদর্শী আলেম পিতার সন্তান হিসাবে ধর্মভীরুতার উত্তরাধিকার ছিল। পাশাপাশি সংস্কৃতিবান, স্বভাষাপ্রেমী পিতার আনুকুল্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিও হয়ে ওঠেন সমান অনুরাগী। সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে কূপমন্ডুকতা তাঁকে আশ্রয় করতে পারেনি। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার ধারক একজন উদারপ্রাণ মুসলমান।
শিক্ষাজীবনের শেষ স্তরে সিলেট আলিয়া মাদরাসায় পড়ার সময়েই মুহম্মদ নূরুল হকের কর্মজীবন শুরু হয়। এ মাদরাসায় দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় তিনি হাতে লিখে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ‘অভিযান’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের করেন। ‘অভিযান’ পরবর্তীকালে ১৯৩২ সালে ‘আল-ইসলাহ’য় রূপ নেয়। ‘আল-ইসলাহ’কে কেন্দ্র করে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সংসদ।’ আল-ইসলাহ আর মুসলিম সাহিত্য সংসদকে কেন্দ্র করে মুহম্মদ নূরুল হকের সারা জীবনের সাধনা আবর্তিত হয়েছে। এর ভেতর দিয়ে তিনি চেয়েছেন প্রতিভার বিকাশ এবং দেশবাসীর জাগরণ।
সিলেটের সৃষ্টিশীল সাহিত্যমোদীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর আন্তরিক সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠিত হলেও এ প্রতিষ্ঠানটি মহীরুহে পরিণত হয়েছে একক প্রচেষ্টায়। প্রথম উদ্যোক্তা ও সফল কান্ডারি মুহম্মদ নূরুল হক। উনিশটি গ্রন্থ দিয়ে শুরু করা সাহিত্য সংসদ গ্রন্থাগারকে অবিভক্ত বাংলার বহু পত্রপত্রিকা এবং দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থসহ চল্লিশ হাজার গ্রন্থের (১৯৮৭ পর্যন্ত) এক সমৃদ্ধ সংগ্রহশালায় উন্নীত করে গেছেন। সে সময় সংসদের বিশাল গ্রন্থাগার আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাজানো ছিল না। ছিল না কোন ক্যাটালগ পদ্ধতি। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, তিনি নিজেই ছিলেন গ্রন্থাগারের জীবন্ত ক্যাটালগ। বিশাল গ্রন্থাগারের কোথায় কোন বই আছে তা তৎক্ষণাৎ বলে দিতে পারতেন। পাঠকের রুচিভেদে বই নির্বাচনের দায়িত্বও তিনি পালন করতেন। আর তাই তিনি ছিলেন সকল বয়সী পাঠকের প্রিয়ভাজন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ (কেমুসাস) এর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে আলোচনার জন্য সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হক এক সভা আহবান করেন। এটি ছিল সংসদের ১১তম বর্ষের ২য় সাহিত্য সভা। এই সভায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি উত্থাপিত এবং বিস্তৃত আলোচিত হয়। প্রখ্যাত রম্যসাহিত্যিক মতিনউদ্দিন আহমদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন সিলেটের বিশিষ্ট লেখক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। এই প্রবন্ধে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ঐতিহাসিক এ প্রবন্ধটি সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হক ‘আল ইসলাহ’র ১৩৫৪ বাংলা কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের ভেতরে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এটি ছিল সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত প্রথম লেখা। (তাজুল মোহাম্মদ, ‘সিলেটে প্রতিরোধ ও গণআন্দোলন ’ (প্রবন্ধ), বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস (১ম খন্ড)।
পত্রিকা প্রকাশনা, সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় বৃত্তাবদ্ধ ছিলেন না মুহম্মদ নূরুল হক। নিজেও সাহিত্যচর্চা করেছেন। তবে নিছক শিল্পসৃষ্টির প্রেরণায় নয়, স্বসমাজের জাগরণের তাগিদে তিনি সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত হন। পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সুকুমারবৃত্তি জাগরণের মাধ্যমে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চাকে উদ্দেশ্যসিদ্ধির বাহন হিসাবে বেছে নিয়েছেন।
মুহম্মদ নূরুল হকের প্রকাশিত গ্রন্থ ছয়টি। নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ, কর্মবীর মুহম্মদ নূরুল হক আত্মত্যাগের স্বীকৃতি পেয়েছেন। সরকার কর্তৃক ‘তমঘা-ই-খিদমত’ উপাধি লাভ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একাত্মতা ঘোষণা করে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা হিসাবে এ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদক প্রদানের মাধ্যমে তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছে, বাংলা একাডেমি তাঁকে ফেলোশিপ প্রদান করেছে। আল ইসলাহ আর কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ তাঁর জ্বেলে যাওয়া মশাল বহন করে আজও নিজস্ব আলোয় আলোকিত। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর, আজকের দিনে মুহম্মদ নূরুল হক ইন্তেকাল করেন। তাঁর বিদেহ আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। মুহম্মদ নূরুল হক তাঁর কীর্তিতে চিরঞ্জীব জনমানসে।
লেখক : অধ্যাপক, মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট।