সুলতান কাবুসের দেশে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৪৯:৫০ অপরাহ্ন
ফায়যুর রাহমান
সবাই ভ্রমণ করতে পারলেও ভ্রমণকাহিনী লেখা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। ভ্রমণকাহিনী লেখা একটা সাহিত্যিক অভিব্যক্তি। যা ভ্রমণকারীর অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিফলনকে ধারণ করে। ভ্রমণকাহিনীতে একজন লেখক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে শেয়ার করেন পাঠকের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করে। বাংলা সাহিত্যের বিশাল অংশ জুড়ে আছে ভ্রমণসাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ থেকে সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে মঈনুস সুলতান পর্যন্ত হাজারো লেখক ঋদ্ধ করেছেন ভ্রমণসাহিত্যের ভান্ডার। লিখেছেন তাদের ভ্রমণকাহিনী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম ইউরোপ যাত্রার অভিজ্ঞতা বয়ান করেছিলেন ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’ নামে। আর সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’ পড়ে আমরা পরিচিত হয়েছি কাবুলিওয়ালার দেশ আফগানিস্তানের বিচিত্র জনগণ ও তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে। সময়ের পরিক্রমায় সেই আফগান যখন এক বিভীষিকার নাম হয়ে ওঠে, রোজ ভোরে যেখানে পুস্পকলিতে শিশিরের বদলে দেখা যেত ধোঁয়া ওঠা ধ্বংসস্তুপ, সেই সময়ই দেশটিতে অবস্থান করে মঈনুস সুলতান লিখেছেন ‘কাবুলের ক্যারাভান সরাই’।
সৈয়দ মুজতবা আলী ও মঈনুস সুলতানের পথ ধরে প্রবাসী সাংবাদিক ইব্রহিম খলিল লিখেছেন ‘ওমান : এক অদেখা ভুবনে’ গ্রন্থটি।
ওমানের এক শেখের আমন্ত্রণে সুলতান কাবুসের দেশে ভ্রমণে যান ইব্রাহিম খলিল। আরবের এই ছোট দেশটিতে চারদিন ভ্রমণের আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে তার ৪৮ পৃষ্ঠার বইটিতে। ইব্রহিম খলিল সিলেটের এক সময়ের সাড়া জাগানো সাংবাদিক। তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি সিলেট অঞ্চলের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা দৈনিক সিলেটের ডাকে। এরপর পড়াশোনা করতে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে গেলেও সাংবাদিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। লন্ডনের জনপ্রিয় টেলিভিশন ‘চ্যানেল এস’ হয় কর্মস্থল। ওমানের সুলতান কাবুস যেদিন মারা গেলেন, সেদিনই বিবিসিতে প্রচারিত কাবুসের ওপর একটা প্রতিবেদনে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। প্রতিবেদনটি অনুবাদ করে চ্যানেল এস- এর দর্শকদের জন্য রেডি করতে গিয়েই তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ওমান সম্পর্কে। ওমান সম্পর্কে আগে থেকেই ভালো জানাশোনা ছিল তার চাচাশ্বশুর ছানু মিয়ার। ছানু মিয়া নর্থ ইংল্যান্ডের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী। তার ইংলিশ কাস্টমার কেভিন হোয়াইটহেড ওমানে চাকরি করেন। ছুটি নিয়ে ব্রিটেনে এসে তার ওমানি বন্ধু শেখ মুহাম্মদ হামুদ নাসের আল বালুচিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে এলে বালুচি তাকে ওমান সফরের দাওয়াত দিয়ে যান। ইব্রাহিম খলিলের কাছে তাই ওমান ভ্রমণের আগ্রহের কথা জানান ছানু মিয়া। ইব্রাহিম রাজী হয়ে যান। ব্রিটিশ সিটিজেনদের জন্য যেহেতু ওমানের ভিজিট ভিসাপ্রাপ্তি একেবারেই সোজা, ইব্রাহিম খলিল অনলাইনে নির্ধারিত ফি দিয়ে মাত্র দশ মিনিটেই দুজনের আবেদন সম্পন্ন করে ফেলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ম্যানচেস্টার থেকে আবুধাবি হয়ে মাস্কাট রওনা হন তারা। সাত ঘন্টার জার্নিতে তারা আবুধাবি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌছে যাত্রবিরতি নেন। দেড় ঘন্টার যাত্রবিরতির পর মাস্কাটের উদ্দেশ্যে ফ্লাইট ছাড়ে। রাতের অপরূপ মাস্কাট সিটি তাদের স্বাগত জানায়। তাদেরকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টেই হাজির হন কেভিন হোয়াইটহেড। তিনি তাদেরকে রাজধানী মাস্কাটের আযাইবা এলাকার হোটেল কর্নেলিয়ান গ্লোরিতে নিয়ে যান। পরদিন থেকে শুরু হয় তাদের ওমান দেখা।
মাস্কাট থেকেই শুরু হয় ঘোরাঘুরি। মাস্কাট শহরটি ওমানের উত্তরপূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাচীন দুর্গঘেরা শহরটিতে রাজপ্রসাদের প্রাধান্য। ১৯৭০ সালে সুলতান কাবুস সিংহাসনে আরোহনের পর মাস্কাটকে ঢেলে সাজান। সাগর ও পাহাড়ের আটকে থাকা মাস্কাট শহরটিকে প্রচীন ইতিহাস, ইসলামি ঐতিহ্য এবং মসজিদের স্থাপত্যশৈলীতে পুনর্গঠন করেন।
ইব্রাহিম খলিলরা সুলতান কাবুস হাইওয়ে দিয়ে এগোতে এগোতেই সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদের আকাশছোঁয়া মিনার দেখতে পান। চার লাখ ষোল হাজার বর্গমিটার ভূমির ওপর মসজিদটির নির্মাণ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। ইরাকি স্থপতি সালেহ মাকিয়া মসজিদটির নকশা করেন। ২০০১ নালে উদ্বোধন হয় চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যশৈলী সমৃদ্ধ এই মসজিদ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্পেট ও ঝাড়বাতির একসময় গিনেজ বুকে নাম লেখায় মসজিদটি।
সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে রওনা হন সাগরদর্শনে। পাহাড়ের ওপর থেকে সাগরপারের মাস্কাটের একটা প্যানোরামিক ভিউ যেকাউকে মুগ্ধ করবেই। বিশাল দৈত্তের মত পাথরের আমরাত পাহাড়। এই পাহাড় মিশেছে হাজার পর্বতমালার সঙ্গে। এই আমারাত পাহাড়ের পাদদেশেই গড়ে উঠেছে মাস্কাট শহর। পর্যটকদের নির্বিঘেœ পাহাড়ের শীর্ষে ওঠে মাস্কাট শহরের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দিয়েছে দেশটির সরকার।
পাহাড় ও সাগরদর্শনের পর গন্তব্য আল আলম প্যালেসে। ব্রিটেনের রাণীর বাসবভন বাকিংহাম প্যালেসের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে ওমানের সুলতানের সরকারি বাসবভন আল আলম প্যালেস। ওমান বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা একবার ঘুরে যান এই স্থানটি। পরবর্তী গন্তব্য হয় শেখ শেখ মুহাম্মদ হামুদ নাসের আল বালুচির প্রাইভেট ক্লাব। মাস্কাটে বেড়াতে আসা নাগরিকরা এখানে সময় কাটাতে আসেন। শেখ হামুদ তাদেরকে ক্লাব থেকে নিয়ে যান ওমানের ডিপ্লোম্যাটিক এরিয়ায়। এলাকাটি এককথায় নান্দনিক। পরদিন যাত্রা শুরু মরুর বুকে রোমাঞ্চকর রাতের সন্ধ্যানে। বিশাল মরুভূমিতে ক্যাম্পিং করে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা। সূর্যদেবের নিদ্রাগমনের পরে মরুর তপ্ত বালুকারাশির ওপর চাঁদের খেলা। মরুভূমিতে রাতের মায়াবী আকাশ যেন ধরা দেয় তাবুর বাসিন্দাদের চোখে।
এককথায় বিস্তীর্ণ মরুপ্রন্তর, পাহাড়ের কিনারে সাগরের অথৈ জলরাশি, আধুনিক স্থাপত্যে নির্মিত আকাশঁেছায়া অট্টালিকা, দুষণমুক্ত প্রকৃতির ¯িœগ্ধঁেছায়ায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য ওমান এক উপভোগ্য জনপদ। ইব্রাহিম খলিল তার সাংবাদিকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেছেন দেশটির নাগরিক জীবনযাত্রা, আর্থিক সমৃদ্ধি, ভাষা ও সংস্কৃতির গভীরতা। বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন। মূল্য রাখা হয়েছে দুইশত পঞ্চাশ টাকা। পাওয়া যাবে অনলাইন প্লাটফর্ম রকমারি ডটকমে।