মুক্তিযুদ্ধ এবং ওসমানী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২:৫২:৩০ অপরাহ্ন
মো. মোস্তফা মিয়া
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হঠাৎ আক্রমণ ও স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেফতার করা হলে পুরো জাতি যখন নেতৃত্বহীন ও দিশেহারা, ঠিক সে সময়ে দুঃসাহসী এক সেনানায়কের আবির্ভাব ঘটে, পাল্টা আক্রমণে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। তিনি হলেন স্বাধীনতা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী যিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে কিংবদন্তির মহানায়ক।
সে মহানায়কেরই আবির্ভাব ঘটল ২ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ার চা-বাগানে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানী। ইতোমধ্যে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী, জেনারেল ইসফাকুল মাজিদকে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করেছে। ওসমানী কালবিলম্ব না করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহকে সমর্থন এবং ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল বৃহত্তর সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কগণকে নিয়ে তার সভাপতিত্বে ঐতিহাসিক বৈঠক করেন। লে. কর্নেল মো: আব্দুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কাজী মো. সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, কর্নেল সালেহ উদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নূরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন শমসের মবিন চৌধুরী, বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরো অনেক অফিসার, ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজি ও ব্রিগেডিয়ার পান্ডেসহ অনেক সামরিক ব্যক্তিত্ব এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সকল অফিসার জেনারেল ওসমানীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। তিনি তার দিকনির্দেশনা ও যুদ্ধপরিকল্পনা অবহিত করেন এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেন। এই বৈঠকেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা সর্বসম্মতিতে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মনোনীত করেন এবং দেশের সে ক্রান্তিলগ্নে রাজনীতিবিদগণকে একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের পরামর্শ দেয়ার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ মিটিংয়ের সিদ্ধান্তই বদলে দেয় দেশের ভাগ্য। ওসমানীর নেতৃত্বে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা তার মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে ১২ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এক ঘোষণায় কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনী গঠন এবং পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করে কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করে এবং তার শপথ গ্রহণ করানো হয়।
ইতিহাসে সমৃদ্ধ ও অত্যধিক সম্মানজনক এ অবস্থানের অধিকারী হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী, যিনি ছিলেন একাধারে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ও সেনাবাহিনীর প্রথম প্রধান এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম জেনারেল পদবির অফিসার, যিনি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ‘বঙ্গবীর’ হিসেবে চিরপরিচিত। এ বীর সিপাহসালার শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয়, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের দুইটি যুদ্ধেও বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে চারটি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এমন সামরিক অফিসারের সংখ্যা খুবই কম। তিনিই একমাত্র অফিসার যিনি একযোগে তিনটি দেশের সশস্ত্র বাহিনী অর্থাৎ ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনী, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অতি ঘনিষ্ঠভাবে চাকরি করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজ হতে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন ওসমানী। ১৯৪৯ সালে তিনি চিফ অব জেনারেল স্টাফের ডেপুটি নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালে তিনি যশোর সেনানিবাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও এর পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ববাংলার আরো কয়েকটি আঞ্চলিক স্টেশনের দায়িত্বও তিনি সফলতার সাথে পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ১৪তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের নবম ব্যাটেলিয়নের রাইফেলস কোম্পানির পরিচালক এবং ইপিআরের অতিরিক্ত কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব¡ পালন করেন। ১৯৫৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেনাসদরে মিলিটারি অপারেশন ডাইরেক্টরেট জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-১ হিসেবে নিযুক্তি পান এবং ১৯৫৬ সালের ১৬ মে কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে মিলিটারি অপারেশন ডাইরেক্টরেট ডেপুটি ডাইরেক্টরের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা সিয়াটো ও সেন্টোতে পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালে ওসমানী একজন স্পষ্টভাষী, স্বাধীনচেতা, নির্ভীক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বাঙালি সেনাদের অধিকার রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটিকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ বা রণসঙ্গীত হিসেবে মনোনীত করে সরকারের অনুমোদন লাভে সক্ষম হন।
সেনাবাহিনীতে তিনি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং তাকে ‘পাপা টাইগার’, ‘টাইগার ওসমানী’, ‘বঙ্গশার্দূল’ ইত্যাদি নামে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। ইতিহাস সৃষ্টিকারী ওসমানী ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন। ওসমানীর গভীর দেশপ্রেম ও বাঙালিদের অধিকার আদায়ে আপসহীন মনোভাব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন। জাতীয় স্বার্থে বঙ্গবন্ধু তাকে রাজনীতিতে যোগদান করার জন্য আহ্বান জানান। রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভিন্ন বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং সাধারণ নির্বাচনে বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিশ্বনাথসহ সিলেটের চার এলাকায় প্রতিদ্বিন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সামরিক পোশাক ছাড়ার প্রায় চার বছর পর জেনারেল ওসমানী মাতৃভূমির এ চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে পুনরায় তা পরিধান করে মুক্তিবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন যা বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ। সে সময়ে ওসমানীর মতো কালজয়ী তীক্ষ্ম মেধাবী, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, দক্ষ, বিচক্ষণ, তিনটি যুদ্ধের বিরল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, চতুর্মুখী গুণাবলির অধিকারী সর্বজনগ্রাহ্য সিনিয়র সামরিক নেতা যদি দৃশ্যপটে না আসতেন তাহলে বঙ্গবন্ধুবিহীন এ যুদ্ধের কী শোচনীয় অবস্থাই না হতো! মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে মুক্তিবাহিনীকে সুসংগঠিত করে দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দান করে গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণও করতেন। জেনারেল ওসমানী তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও সুদক্ষ পরিচালনায় লাখো মানুষের শাহাদতের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশকে শত্রুমুক্ত করে জাতিকে উপহার দিয়েছেন বহুপ্রত্যাশিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকার মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল পদে উন্নীত এবং অসাধারণ বীরত্বের জন্য ‘বঙ্গবীর’ উপাধিতে ভূষিত করেন ।
চিরকুমার জেনারেল ওসমানী সারাটা জীবন কাটিয়েছেন এদেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির, উন্নতির ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। উৎসর্গ করেছেন তার জীবনযৌবন, সহায়সম্পত্তি ও সবকিছু। অবহেলিত বাঙালি মুসলমানদের ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবেশের জন্য তিনি সব প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং এর সফলতাও অর্জন করেছেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার পথকে উন্মুক্ত করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর এ রেজিমেন্ট সমৃদ্ধ হতে থাকে, যা স্বাধীনতাযুদ্ধে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ওসমানী কখনো পিছু হটেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, অস্ত্রমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যতদিন টিকে থাকবে বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী বেঁচে থাকবেন স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে এদেশের মাটি ও মানুষের মনের মণিকোঠায় মুক্তির সুউজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে।
লেখক : কলামিস্ট।