অর্থনীতির হালহকিকত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১:৩২:০৬ অপরাহ্ন
রতীশচন্দ্র দাস তালুকদার
বর্তমান বিশ্বের কোন দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এ পৃথিবী একটি এষড়নধষ ারষষধমব। এ বৈশ্বিক গ্রামের প্রত্যেকটি সদস্য রাষ্ট্র একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। কোন দেশ যত সম্পদশালীই হউক না কেন চাহিদার সব পণ্য নিজ দেশে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। সুতরাং চাহিদা মেটাতে অন্যান্য দেশের উপর নির্ভর করতে হয়। কোন দেশ তার উদ্ধৃত দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানির জন্য বহির্বিশ্বে যেমন বাজার সন্ধান করে সেই সাথে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য অন্য দেশ থেকে চাহিদামাফিক পণ্য আমদানি করে থাকে। এভাবে বিশ্বের দেশে দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। সময় পরিক্রমায় পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, মানুষের আয় রোজগার বাড়ছে, দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে ধীরে ধীরে মানুষ বেরিয়ে আসছে এবং সেই সাথে মানুষের রুচি ও চাহিদারও পরিবর্তন ঘটছে। ফলে নতুন নতুন পণ্যসামগ্রী জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠছে। এসব পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের জন্য দেশে দেশে নানা কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে।
শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় যে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপন্ন হয়, এর কাচামাল ও কারখানার ক্যাপিটাল ম্যাশিনারী হয়ত ভিন্ন কোন দেশ থেকে আমদানি করা হয় আবার উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। এভাবে আন্তঃবাণিজ্যের মধ্যদিয়ে পৃথিবীর সবদেশই একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। এক কথায় বলা যায় সব দেশের অর্থনীতিই বহির্বিশ্বের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত। প্যান্ডেমিকের অব্যবহিত পরে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করায় দু’দেশের মধ্যে যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে এর প্রভাবে সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে গভীর কালোছায়া। প্রায় দু’বৎসরকাল অতিক্রান্ত হলেও, বিশ্বের কোন দেশের অর্থনীতিই এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসতে পারেনি। কারণ বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় কোন দেশই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত তার দেশের অর্থনীতিকে আগলিয়ে রাখতে পারে না।
বাংলাদেশ সদ্য অভিষিক্ত মধ্যম আয়ের একটি দেশ। দেশটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতির করাল থাবায় দেশটির অর্থনীতি মহাসংকটময় অবস্থায় পতিত হয়েছে। রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রবল ধস নেমেছে। ডলারের মূল্য প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের আমদানিপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া সাধারণ মানুষের জীবনে ঘোর অমানিশার ছায়া ফেলেছে। বাংলাদেশ মূলত একটি আমদানি নির্ভর দেশ। সার জ্বালানি থেকে শুরু করে অধিকাংশ খাদ্যপণ্যই আমাদের আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু দীর্ঘদিন ডলারের মূল্য কৃত্রিমভাবে ৮৫-৮৬ টাকায় ধরে রাখায় এবং হঠাৎ করে সে মূল্য ১০০ টাকার উপরে উঠে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির খড়গ অত্যন্ত তীব্রভাবে মানুষকে আঘাত করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মাসওয়ারি মূল্যস্ফীতির যে চিত্র প্রকাশ করে, সেখানে যদিও এ সংখ্যা ৯% ও ১০% এর মাঝামাঝি দেখানো হচ্ছে, কিন্তু বাজার বাস্তবতায় এ সংখ্যাটি দুই অংকের ঘরে বলেই অনুমতি হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ডলারের মূল্য ১১০ টাকার কাছাকাছি হলেও কার্ব মার্কেটে এর দাম ১১৫/১১৬ টাকা। ২০২০ সালের আগস্টে দেশে রিজার্ভ ছিল ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ, কিন্তু ২০২৩ এর আগস্টে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। আমাদের আর্থিক হিসাবের ঘাটতি প্রকট হচ্ছে। যা সামস্টিক অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে, আমদানি দায় মেটাতে এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধে তার চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করে আমদানি ব্যয় হ্রাস করা গেলেও ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল করা যাচ্ছে না। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উপায় হলো- রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (ঋউও)। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত, তবে দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত হতো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মানব সম্পদ উন্নয়নে আমাদের বিনিয়োগ অপ্রতুল। দেশের প্রায় দেড়কোটি লোক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের খোঁজে গমন করেছে। কর্মজীবী যারা বিদেশে আছেন তাদের প্রায় ৮০ শতাংশেরই প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রশিক্ষণ নেই, তারা স্বল্প শিক্ষিত। তারা বিদেশে শ্রম দিয়ে যে অল্প আয় করেন তা থেকে কিছু সঞ্চয় করে দেশে প্রেরণ করেন। এটাই আমাদের প্রবাসী আয়। ফিলিপাইন সহ আরও অনেক দেশ প্রশিক্ষিত অথচ আমাদের চেয়ে অনেক কম শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়ে আমাদের তুলনায় অনেক বেশি রেমিট্যান্স পেয়ে থাকে। আমাদের এই রেমিট্যান্সযোদ্ধারা যদি হুন্ডিতে ২/৩ টাকা বেশি পায় তবে তারা হুন্ডিতেই তাদের স্বল্প সঞ্চয় দেশে পাঠাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই দেখা যাচ্ছে, ডলার প্রতি আড়াই টাকা প্রণোদনা দেওয়া সত্ত্বেও আমাদের প্রবাসী আয় ২ বিলিয়নের আশে পাশেই থাকছে। যারা শিক্ষিত, যারা বিভিন্ন প্রকৌশল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে বিদেশে গিয়েছেন, তারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে সেসব দেশেই উচ্চ বেতনে চাকরি করছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এসব বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়াদের পিছনে সরকার অনেক বিনিয়োগ করলেও বিদেশে গিয়ে তারা স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেন এবং দেশে খুব একটা রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন বলে মনে হয় না, আর পাঠালেও তা খুব উল্লেখযোগ্য নয়। বর্তমানে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে অনেক কারিগরি স্কুল, কলেজ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সুতরাং বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তি বিদেশে পাঠালে এবং সেই সাথে মুদ্রা বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করলে হুন্ডিতে প্রবাসী আয় পাঠানো অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে, গতিশীলতা আসবে। সেই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, প্রবাসী আয়ে সুবাতাস না বইলে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমিয়ে আনাযাবে না।
অন্যদিকে রপ্তানি আয় হলো, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু আমাদের রপ্তানি দীর্ঘদিন যাবৎ প্রায় একটি পণ্যভিত্তিক। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। গার্মেন্টসপণ্য রপ্তানিতে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক ধারা বজায় থাকলেও ডলার সংকটে তুলা ও সুতা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে, ফলে ভবিষ্যতে গার্মেন্টস সামগ্রী রপ্তানিও সংকটের মুখে পড়তে পারে। আর একটি হতাশাজনক বিষয় হলো, প্রতি বছরই রপ্তানি আয়ের একটি অংশ বিদেশে থেকে যায় এবং দেখা যাচ্ছে, বিদেশে থেকে যাওয়া রপ্তানি আয় ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। যেমন গত অর্থ বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আসেনি, এর আগের অর্থ বছরে দেশে আসেনি প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। এই না আসার কোন সন্তোষজনক কারণও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেননি। ২০২১-২৩ অর্থ বছরে ঊীঢ়ড়ৎঃ চৎড়সড়ঃরড়হ ইঁৎবধঁ এর হিসেবে প্রায় ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছে কমবেশি ৪৩ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতি ১২ বিলিয়ন ডলারই এখন প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। আবার গত অর্থ বছরে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০% বৃদ্ধি পেলেও এর পরিমাণ খুব বেশি নয়। গত অর্থবছরে ৩.৮৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। আসলে আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে গিয়ে বিদেশীরা যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহ অন্যান্য সমস্যার সম্মুখীন হন, তা নিরসন করতে না পারলে ঋউও আশানুরূপ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ প্রতি বছরই ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করে থাকে। কারণ আমাদের যে রাজস্ব আয় হয় তা দিয়ে বাজেটের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। আমাদের ‘কর-জিডিপি’র অনুপাত তুলনামূলকভাবে অনেক কম। গত বছর ‘কর-জিডিপি’র অনুপাত ছিল প্রায় ৮% অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের সে অনুপাত ১৯%। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের এই দেখে ট্যাক্স সনাক্তকরণ নাম্বার (ঞওঘ) আছে প্রায় ৮৫ লাখ লোকের এবং এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ লোক আয়কর দিয়ে থাকেন। কয়েক বছর পূর্বে (২০১৮ সালে) ‘ওয়েলথ এক্স’ নামক একটি আমেরিকান সংস্থার জরিপে দেখিয়েছিল, বাংলাদেশ অতি ধনী বৃদ্ধি ক্ষেত্রে বিশ্বের মধ্যে প্রথম। এমনকি গত বছরে পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ৮ হাজার বেড়েছে এবং মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ১ হাজার ৯৭৬ জনে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। যা খুবই উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয়। এই রাজস্ব আদায়ে ভ্যাটের ভাগ ধরা হয়েছে ৩৮.১% অন্যদিকে আয়করের ভাগ ৩৫.৬%। এত বিপুল জনসংখ্যার একটি দেশে, যে দেশ অতি ধনী বৃদ্ধিতে বিশ্বের মধ্যে অগ্রবর্তী অবস্থানে আছে, সেই দেশে প্রত্যক্ষ করের হিস্যা এত কম হবে কেন? এটা নিঃসন্দেহে আমাদের কর প্রশাসনের অদক্ষতার পরিচয় প্রকাশ করে। কর জাল বিস্তৃত করে আয়কর আদায়ে গতিশীলতা আনতে না পারলে ‘কর জিডিপি’ অনুপাত প্রত্যাশিত মাত্রায় আনা কিছুতেই সম্ভব হবে না। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে বাংলাদেশকে ঋণ নিয়েছে, তাতে সংস্থাটি ‘কর-জিডিপি’র অনুপাত বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে।
সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে এবং আয় দেখিয়েছে ৫,০০,০০০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে বাজেট ঘাটতি হলো ২,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। বিদেশি উৎস তথা বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে কাক্সিক্ষত ঋণ ও অনুদান পাওয়ার আশা খুবই ক্ষীণ। সুতরাং বাজেট ঘাটতি মেটানোর প্রধান ভরসার জায়গা হলো আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎসব। সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ প্রত্যাশা করে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। অনেকেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করছেন, সুতরাং এখানেও আশা মরিচীকায় রূপ নিতে পারে। শেষ ভরসা হলো আমাদের ব্যাংকিং খাত। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খুব সুস্থ বা সবল নয়। কোন কোন ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে বলে জানা যায়। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যদি সরকার বেশি ঋণ সংগ্রহ করে, তবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ব্যাহত হবে যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। গত অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে মোট ২ লক্ষ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছিল ৯৮ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম মাসেই সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়ে থাকে। এতে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায় যার অভিঘাতে মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী হয়। সরকারের প্রত্যাশা বর্তমান অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬% এ নেমে আসবে, কিন্তু অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাই এ মুল্যস্ফীতি ছিল ৯.৬৭%। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, ব্যাংক ঋণের সুদ হারও বাড়িয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুবাতাস বইছে বলে প্রতীয়মান নয়। বিশ্বের অনেক দেশ সঠিক মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে বাগে আনতে সক্ষম হয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ৬.৪% থেকে ৩% এ, ভারতে ৬.৫% থেকে ৪.৮১% এ, চরম সংকটাপন্ন শ্রীলঙ্কায় ৫১.৭% থেকে ১২% এ মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে। আসলে আমাদের দেশে বাজার ব্যবস্থাপনাতেও অনেক দুর্বলতা আছে। কোন জিনিসের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখাই হলো সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলে। এছাড়া টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করলেও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায় এবং পরিণামে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে পড়ে। এই বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক-এ উভয় ব্যবস্থা থেকে সরকারের গৃহীত ঋণ যাতে মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং সেই সাথে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ যেন বিঘিœত না হয় সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক