অসুন্দর মুখ কাম্য নয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৫৫:৪৭ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
৯ ভাদ্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ (২৪ আগস্ট ২০২৩) তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার ৭ এর পৃষ্ঠায় একটি খবরের শিরোনাম আমাকে খুবই আকৃষ্ট করলো। অর্থাৎ জনকন্ঠের মাধ্যমে ‘রয়টার্স’ এর খবরটিই মূলত পেলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম না ‘রয়টার্স’ সংবাদ মাধ্যমটি আসলে কোন দেশের। এ জাতীয় সমস্যা পড়লে সব সময়ই আমার পরম শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেশী মহোদয়কে স্মরণ করি। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি এক মিনিটের মধ্যেই জানিয়ে দিলেন- ‘রয়টার্স’ সংবাদ মাধ্যমটির সদর দপ্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। মনে মনে অন্তরের অন্তস্থল থেকে দেশী মহোদয়ের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানালাম।
রয়টার্স এর সংবাদটি কানাডা সম্পর্কিত। শিরোনামটি হলো- ‘কানাডার অর্থমন্ত্রীকে জরিমানা’। বলে কি! মন্ত্রীরও জরিমানা হয়? কিন্তু হয়েছে তো। দেশের আইনের শাসন কতোটুকু শক্তিশালী হলেই তা এমনটি হয়। আমার সম্মানিত পাঠকগণের সুবিধার্থে শিরোনামের ভেতরের বিস্তারিত খবরটি তুলে ধরলাম। আর সেটি হলো- ‘অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর দায়ে শাস্তির মুখে পড়েছেন কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ঘন্টায় ১৩২ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়েছেন, যা সর্বোচ্চ গতিসীমার বেশি এবং এই অভিযোগে জরিমানার মুখে পড়েছেন তিনি। আর ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এই শাস্তির মুখে পড়েছেন তার নিজের প্রদেশেই। যদিও কানাডার এই অর্থমন্ত্রীর নিজের কোন গাড়ি নেই। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর দায়ে কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডকে প্রদেশ আল বার্টাতে ২৭৩ কানাডিয়ান ডলার (২০০ মার্কিন ডলার) জরিমানা করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার তার একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন। রয়টার্স।
রয়টার্স এর এই খবরটি বাংলাদেশের পত্রিকায় এতো গুরুত্ব সহকারে কেন প্রকাশ করা হলো সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে খবরটি পৌঁছতে হবে বাংলাদেশের মন্ত্রী পাড়ায়। বাংলাদেশের মন্ত্রী মহোদয়গণ কানাডার অর্থমন্ত্রীকে কেন জরিমানা দিতে হলো সেটা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে রয়টার্স পরিবেশিত এই খবরটি থেকে শিক্ষণীয় কিছু রয়েছে কিনা সংশ্লিষ্টজনই তা ভেবে দেখবেন। কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডকে শাস্তি হিসেবে যে জরিমানা করা হয় তা যদি আদায় করা হয় তাহলে বুঝতে হবে যে সেদেশে আইনের শাসন চালু রয়েছে এবং দেশের সর্বোচ্চ মহলও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইন বিষয়ে একটি কথা আছে যে,-‘ঙহষু ঃযব ৎরপয পধহ মবঃ লঁংঃরপব, ড়হষু ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ পধহ হড়ঃ বংপধঢ়ব রঃ’. যার বাংলা হলো- বিচার পায় কেবল ধনীরাই, দরিদ্রদের নিস্তার নেই বিচার থেকে। কিন্তু কানাডার অর্থমন্ত্রীর জরিমানা থেকে স্পষ্ট বুঝা গেল যে, শুধু দরিদ্রদেরই নিস্তার নেই বিচার থেকে, ধনীরাও নিস্তার পায় না বিচার থেকে। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ তো হলো- কানাডার উল্লেখিত অর্থমন্ত্রী। তাঁর নিজের কোন গাড়ি না থাকলেও কিন্তু তিনি গরীব নন। ধনী। তিনি বিচার থেকে রেহাই পাননি। অর্থাৎ কানাডায় আইনের শাসন আছে। এ বিষয়ে কানাডিয়ানরা গর্ব করতে পারেন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কথা জানি না; বাংলাদেশের কোন মন্ত্রী মহোদয় এমন অপরাধ করলে অর্থাৎ কোন মন্ত্রী মহোদয়কে বহনকারী গাড়ির গতি যদি সর্বোচ্চ গতিসীমার বেশি যদি কখনো হয় তাহলে তিনি শাস্তির মুখে পড়েছেন এমন নজির আমার জানা নাই। এ ধরনের অপরাধ বা কাজের জন্য কেউ কখনো জরিমানা দিয়েছেন বলেও জানি না। এ বিষয় বিবেচনা করলে বাংলাদেশের তুলনায় কানাডার অবস্থান পূর্ণচন্দ্রের মতো।
তবে এটাওতো ঠিক যে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। তেমনি এক কলঙ্ক কালিমা লেপন করেছে কানাডার বুকে। এ প্রসঙ্গে মাইকেল রিড নামক একজন মনীষীর একটি উক্তির কথা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। তিনি বলেছেন- ‘যে সমাজ অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাবে সে সমাজ মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী।’ এখানে ‘সমাজ’ এর কথা বলা হয়েছে। কোন দেশ যদি অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় সেক্ষেত্রে সেই দেশের অবস্থান কেমন হবে তা তো সহজেই অনুমেয়। তবে কানাডা কিন্তু বিশ্বের অন্যতম বসবাস উপযোগী একটি দেশ। তার গায়ে কি আর কলঙ্ক লেপন করা যায়? যায় না জানি। কিন্তু বাস্তব সত্যকে তো আর অস্বীকার করা যায় না।
প্রশ্ন আসে কি সে বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এর ঘটনাবলি।
কি সে মর্মান্তিক ঘটনা? বাংলাদেশের মানুষসহ বিশ্বের এমন কোন দেশ বা দেশের মানুষ নাই যারা এ ঘটনার কথা জানেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের সকল সদস্যসহ হত্যা করা হলো। নারী শিশু সহ কেউ রেহাই পায়নি। বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গেলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা। এ ইতিহাস কে না জানে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন জঘণ্য নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকা- আর কোথাও ঘটেনি। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ভারতের জাতির পিতা মহাত্মাগান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে। এমন তালিকায় রয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে সহ আরো অনেকেই। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কারো পরিবারের অন্য কোন সদস্যকেই খুনী চক্র হত্যা করেনি। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র ব্যতিক্রম। অপরাধ? তাঁর অপরাধ (?) তিনি দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাড়ে সাতকোটি নির্যাতিত মানুষের জন্য একটি দেশ সৃষ্টি করেছেন। এক মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী দানব চক্রকে পরাজিত করে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক লাল সবুজের দেশ সৃষ্টি করেছেন। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর সাড়ে সাত কোটি মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন নতুন পতাকা। আর পরাজিত শত্রুরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও আজ সেই পতাকাকে সেলুট করতে বাধ্য হচ্ছে। এ পরাজয়ের গ্লানি তারা আজও ভুলতে পারছে না। ঐ কাপুরুষেরা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এর প্রতিশোধ নিয়েছে।
একদল দেশীয় মোহাম্মদী বেগদের মাধ্যমে বাংলার প্রাণভ্রমরাকে সবংশে নিধন করিয়েছে। ঐ মোহাম্মদী বেগদের অর্থাৎ আত্মস্বীকৃত খুনীদেরকে তাদের প্রভুরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর সেই দেশগুলো সাদরে খুনীদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। বড় কষ্ট লাগে, দুঃখ লাগে যখন কেউ কেউ বলে বেড়ান ওটা নাকি পলিটিকেল মার্ডার। রাজনৈতিক খুন। বলি, খুন তো খুনই। খুনী তো খুনীই। এটাকে রাজনৈতিক খুন আর রাজনৈতিক খুনী বলে প্রচার করা মানে তো প্রকারান্তরে খুন আর খুনীদেরকেই প্রশ্রয় দেয়া। কোন আইনেই তাকে আইনি সিদ্ধান্ত বলে চালিয়ে দেয়া যায় না। খুন খুনই। সেটা বাংলাদেশ বা কানাডা-আমেরিকা সব দেশেই আইনের দৃষ্টিতে খুন।
এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে বাংলাদেশ সরকার জানতে পেরেছে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার আত্মস্বীকৃত খুনী অর্থাৎ অমার্জনীয় অপরাধে অপরাধী এক বর্বর ঘাতক কানাডায় বসবাস করছে। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কানাডা সরকারের কাছে বাংলাদেশ সরকার অনুরোধ করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কানাডা সরকার বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ঐ খুনীকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ফিরিয়ে দিতে রাজি হচ্ছে না। যে দেশে সর্বোচ্চ গতিসীমার বেশি গাড়ি চালানোর অপরাধে সে দেশের অর্থমন্ত্রীকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়, ২৭৩ কানাডিয়ান ডলার জরিমানা দিতে হয় সে দেশ অন্যদেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যাকারী-খুনী-অপরাধীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে সেটাতো কখনো কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশের বহু মানুষ আজ কানাডায় বসবাস করছেন। সবার মুখেই কানাডার পঞ্চমূলে প্রশংসা। চাঁদের মতো সুন্দর সে দেশ। চাঁদের কলঙ্ক থাকলেও কানাডার ক্ষেত্রে সে কলঙ্ক থাকুক আমরা চাই না, বিশ্ববাসী চায় না কানাডার ক্ষেত্রে মাইকেল রিডের সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘যে সমাজ অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকে সে সমাজ মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী’ কোন অবস্থাতেই প্রযোজ্য হোক। চাঁদের মতো সুন্দর দেশ সমূহের কর্তাব্যক্তিগণকে বুঝতে হবে যে, মানুষ আজ সেই সুন্দর মনোরম চাঁদের কলঙ্কও কিন্তু খুঁজে বের করতে সক্ষম হচ্ছে। পৃথিবীর ‘চাঁদ’গুলোতে আরো কাছে। কলঙ্কিত অসুন্দর মুখ তো কারো কাছেই কাম্য হতে পারে না। নয় কি?
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।