শ্রীকৃষ্ণের জন্মরহস্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৫৪:২৪ অপরাহ্ন
সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ দাস
ভগবান যেহেতু অজ অর্থাৎ জন্মরহিত, তাহলে তাঁর আবার জন্ম কিসের? এ রকম প্রশ্ন জাগে ভক্তমনে। এই প্রশ্নের উত্তর ভগবান নিজেই গীতায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন। গীতায় ভগবান বলেছেন, তিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হওয়া স্বত্ত্বেও এই জড় জগতে জন্মগ্রহণ করেন। কেন তিনি জন্মগ্রহণ করেন তার কয়েকটি কারণ তিনি গীতায় ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রথমত তিনি বলেছেন, যখনই ধর্মের অবনতি আর অধর্মের উত্থান হয় তখনই তিনি নিজে স্বয়ং জড়জগতে মনুষ্যরূপে প্রকাশিত হন। প্রকাশিত হয়ে ভগবদ বিদ্বেষীদের দন্ড দান করেন এবং সাধু সজ্জন ব্যক্তিদের পরিত্রাণ বা রক্ষা করেন। দ্বিতীয়ত তিনি তাঁর ভক্তের মনোবাসনা পূরণের নিমিত্তে এই জড় জগতে আর্বিভূত হন। অর্থাৎ তিনি তাঁর ভক্তের আকুল আবেদনে বসুদেব দেবকীর পুত্ররূপে এই পার্থিব জগতে আর্বিভূত হন এবং লীলাকার্য সম্পাদন করেন। পূর্বজীবনে এই বসুদেব এবং দেবকি পৃশ্নি ও সুতপা নামে স্বামী আর স্ত্রী রূপে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাদের কোন সন্তানাদি না হওয়ায় তারা পরমেশ্বর ভগবানের কঠোর তপস্যা শুরু করেন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর্বিভূত হয়ে তাদের অভিপ্রায় জিজ্ঞাসা করেন। প্রতি উত্তরে ভগবানকে তাঁরা বলেন তাঁদের খুব ইচ্ছা ভগবানের মতো একটা সন্তান লাভের। কিন্তু কৃষ্ণতো স্বয়ং ভগবান। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি তো আর দ্বিতীয় হতে পারবেন না। এদিকে তাঁর ভক্তের মনোবাসনা ও পূরণ করতে হবে। তাই তিনি দেবকি ও বসুদেবকে কথা দিলেন তাঁদের পরবর্তী জন্মে তিনি স্বয়ং তাঁদের পুত্ররুপে জন্মগ্রহণ করবেন এবং তাঁদের অভিলাষ পূর্ণ করবেন। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগে দেবকিনন্দন রুপে এই জড় জগতে আর্বিভূত হন।
তাঁর জন্ম সাধারণ শিশুদের মতো হয়নি। কিংবা বসুদেব দেবকির মিলনের ফলেও নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবকি মাতার সন্মুখে প্রথমে চতুর্ভূজ নারায়ণরূপে আর্বিভূত হন। কিন্তু দেবকি বসুদেব ভগবানকে দ্বিভুজ রূপে প্রকাশিত হওয়ার অনুরোধ করেন। তখন ভগবানের বপু হতে একটা দিব্য জ্যোতি দেবকি মাতার গর্ভসিন্ধুতে প্রবেশ করে এবং ভগবান দেবকি মাতার গর্ভসিন্ধু থেকে সন্তান রুপে এই জড়জগতে প্রকাশিত হন। কিন্তু এদিকে কংস যেহেতু দৈববাণী শুনেছিল দেবকির অষ্টম গর্ভের সন্তান তার মৃত্যুর কারণ হবে তাই দেবকি এবং বসুদেবকে কংস তার কারাগারে বন্ধী করে রেখেছিল। তাই সংগত কারণে ভগবানকে কংসের কারাগারেই আর্বিভূত হতে হয়েছিল।
আবার কংসের নির্দেশ ছিল দেবকির অষ্টম গর্ভের সন্তানকে তিনি নিজ হাতে হত্যা করবেন। সেহেতু বসুদেব যোগমায়ার নির্দেশে সদ্যজাত শিশুটিকে রাতের অন্ধকারে নন্দালয়ে নিয়ে যান এবং সেখানে মা যশোদাও একই সময়ে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। বসুদেব তাঁর সদ্যজাত সন্তানকে যশোদা মায়ের কাছে রেখে যশোদা মায়ের কন্যা সন্তান অর্থাৎ যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে আসেন। পরদিন কংস দেবকির অষ্টম গর্ভের সন্তান যোগমায়াকে হত্যা করার জন্য যখন হাতে তুলে নিল তখনই যোগমায়া উধর্বগামী হয়ে যেতে যেতে বললেন তোকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।
এ কথা শুনে সে গোকুলে জন্ম নেওয়া সকল নবজাত শিশুদেরকে হত্যা করতে শুরু করল। অবশেষে তাঁর আসল শত্রু কৃষ্ণের কাছে আসলো। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই একে একে ব্যর্থ হতে লাগল। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল ছলনার আশ্রয় নিবে। অর্থাৎ পুতনাকে দিয়ে বিষপ্রয়োগে কৃষ্ণকে হত্যা করবে। পুতনা রাক্ষসী তার স্তনে বিষ মাখিয়ে কৃষ্ণকে দুগ্ধপান করাতে গেল কিন্তু পুতনা অসহ্য যন্ত্রণায় নিজেই মৃত্যুবরণ করল। অবশেষে কংসও কৃষ্ণের হাতে নিহত হল। তাই দেখা যায় ভগবান বিশেষত দুটি কারণে এই ধরাধামে আর্বিভূত হন। এক দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ দুই ভক্তের মনোবাসনা পূরণেল নিমিত্তে।
তবে দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশের চেয়ে তাঁর কাছে ভক্তের ডাকে সাড়া দেওয়াকে বেশি প্রাধান্য দেন। কারণ দুষ্কৃতিকারীদের দন্ড দিতে সব সময় ভগবানকে এই জড় জগতে আর্বিভূত হতে হয় না।তিনি প্রকৃতিকে আদেশ করেন আর প্রকৃতি তার ভয়ংকর রুপে পাপীদের দন্ড দিয়ে থাকে। দ্বাপর যুগে ভগবানের আর্বিভাবের মূল কারণ ছিল তাঁর ভক্তের অভিলাষ পূর্ণ করা। গৌণ ছিল দুষ্কৃতিকারীদের ধ্বংস করা। যেহেতু এসব দুষ্কৃতকারীরাও তাঁর ভক্তদের নানা ভাবে উৎপীড়ন নিপীড়ন যন্ত্রণা দিয়ে থাকে,তাই ভক্তের ডাকে তিনি সাড়া দেন। ভক্তের সব সমস্যার সমাধান করেন। তাইতো বলা হয় ভক্তের অধীন ভগবান, নিজে ছোট হয়ে বাড়ায় ভক্তের সন্মান। জয় শ্রীকৃষ্ণ।
লেখক : কলামিস্ট।