জৈন্তাপুরে পাহাড়-টিলায় গর্ত খুঁড়ে অবাধে পাথর উত্তোলন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:৫৭:১০ অপরাহ্ন
বেপরোয়া পাথরখেকো চক্র ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ
কাউসার চৌধুরী
সিলেটের জৈন্তাপুরে পাহাড়-টিলায় গর্ত খুঁড়ে পাথর তোলার মহোৎসব চলছে। নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করেই প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে চলছে পাথর উত্তোলন। এর ফলে এলাকার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশও ধ্বংস হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়েও পাথরখেকো চক্রকে থামাতে পারছে না। দিন দিন পাথরখেকো চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আবার বন্ধ থাকা শ্রীপুর পাথর কোয়ারি থেকেও প্রায়শই পাথর তোলা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। সরেজমিন ও পাথর খেকোদের পাহাড়-টিলায় গর্ত খুঁড়ে পাথর তোলার চিত্র পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন জৈন্তাপুরে পাহাড়-টিলায় গর্ত খুঁড়ে পাথর তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেটের ডাককে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর গত সপ্তাহেও অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছে। তবে, পাথর তোলার বিষয়টি দেখার বিষয়তো খনিজ সম্পদ বিভাগের। জেলা প্রশাসনও বিষয়টি দেখতে পারে।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, গত সপ্তাহে অভিযান পরিচালনা করে জেল জরিমানা করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরকে সাথে নিয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ যদি তার বাড়ি-ঘরের সামনে পেছনে গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করে তাহলে আর করার কি আছে। পাথর উত্তোলন বন্ধ করে পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা’র সিলেট বিভাগের সমন্বয়ক এডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে পাহাড় টিলা খুঁড়ে পাথর তোলা হচ্ছে। টিলা কাটা বন্ধে সাইনবোর্ড টাঙানোর কথাও উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছিল; তাও বাস্তবায়ন হয়নি। পাথর উত্তোলনের ফলে ভূমির প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, এতে ভূমি ধসের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া এভাবে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকলে গর্তে পাথর চাপা পড়ে প্রাণহানি ঘটতে পারে। তাই দ্রুত টিলা কাটা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, জৈন্তাপুর উপজেলায় বর্তমানে কি পরিমাণ টিলা রয়েছে বা কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার তথ্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে চেয়েছিলাম। কিন্তু উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে কোন তথ্য সরবরাহ করা হয়নি।
সরেজমিন জৈন্তাপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাথর তোলার চিত্র দেখা গেছে। উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের গোয়াবাড়ি এলাকায় দেখা যায়, সেখানে বসবাসরত বাসিন্দারা টিলা কেটে পাথর তুলছেন। বেশিরভাগ বাড়ির আশপাশে পাথর তুলে গর্ত করে রাখা হয়েছে। টিলায় গর্ত করে নারী-পুরুষ সমানে পাথর উত্তোলন করছেন। অবশ্য, পাথর উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, দৈনিক মজুরি হিসেবে তারা এই কাজ করছেন। মূলত জায়গার মালিক পাথর নিচ্ছেন। আর যারা পাথর তোলাচ্ছেন তাদের দাবি, গোয়াবাড়ির ওই জায়গা তাদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। ওই জায়গা থেকে তারা পাথর তুলে বিক্রি করছেন। তবে উপজেলা প্রশাসন জানায়, গোয়াবাড়ি এলাকার পুরো টিলাটি সরকারি জায়গা। সরকারি জায়গা হিসেবেই এখানে ‘মুজিবপল্লী’ নির্মাণ করা হয়েছে।
গোয়াবাড়ির আব্দুল মতিনের বাড়ির উঠানে বড়-বড় গর্ত দেখা গেছে।
আব্দুল মতিন জানিয়েছেন, বাড়ির উঠানে পাথরের জন্য হাঁটাচলা মুশকিল। বাড়ির লোকজন হাঁটতে গিয়ে পড়ে যান। তাই পাথর তুলে সামান করা হচ্ছে।
মারুফ আহমদ নামের এক যুবক জানান, টিলাতে ঘর তৈরি করার জন্য ১৬ শতাংশ জায়গা কিনেন। একমাস ধরে এ জায়গা থেকে টিলা কেটে পাথর বিক্রি করছেন। তিনদিনে একটি ডিআই ট্রাক পাথর তুলতে পারেন। প্রতি ট্রাক পাথর ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। তবে তিনি কার কাছ থেকে ওই জায়গা কিনেছেন তা আর জানাতে পারেননি। মারুফের বাড়ির অদূরে পাওয়া যায় প্রায় আধা কিলোমিটার লম্বা একটি গর্ত। এই গর্ত থেকে নারী-পুরুষ মিলে মাটি খুঁড়ে পাথর তুলছেন। এই জায়গার মালিকানা দাবি করে হুজুর মিয়া নামের এক ব্যক্তি জানান, এটি তাদের নিজস্ব জায়গা। আর এই অংশটি তার বোনের। এখানে নিচে পাথর থাকার কারণে কোনো কাজে আসছে না। তাই পাথর তুলে গাছ লাগানোর জন্যে পাথর তোলা হচ্ছে।
সুলতান আহমদ নামে এক যুবক ঘরের পাশে টিলার জায়গা কেটে পাথর উত্তোলন করছেন। তার দাবি, ঘর ঠিক করার জন্য টিলার মাটি কেটে সমান করা হচ্ছে। নজরুল নামে এক ব্যক্তি তার বাড়ির সামনে গর্ত করে পাথর তুলছেন।
নজরুলের দাবি, পাথর থাকার কারণে ছোট ছেলেমেয়েরা উঠানে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়ে যায়। তাই পাথরগুলো তুলে জমা করছেন। এগুলো তো হলো গোয়াবাড়ি এলাকার পাথর উত্তোলনের চিত্র। কেবল গোয়াবাড়ি এলাকা নয় এর পার্শ্ববর্তী করিমের বাগান এলাকায়ও পাহাড়-টিলা কেটে পাথর তুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। আর এভাবেই প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে পাথর উত্তোলন করে পরিবেশ ধ্বংস করছে পাথরখেকো চক্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি সিলেটের ডাককে জানান, জৈন্তাপুরে দীর্ঘদিন ধরে চলছে বিভিন্ন টিলা কেটে পাথর উত্তোলন। অভিযানের ভয়ে চক্রটি মাঝে-মধ্যে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখে। এরপর আবার শুরু করে পাথর উত্তোলন। আর পাথর উত্তোলনের মধ্য দিয়ে অবাধে কেটে নেওয়া হচ্ছে সরকারি জায়গা। এছাড়াও বন্ধ থাকা শ্রীপুর পাথর কোয়ারি থেকেও কৌশলে পাথর লুট করা হয়।
বেলার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৬ সালের মাঠ জরিপে সিলেটের ছয় উপজেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলার অস্তিত্ব ছিল। এর বাইরে আরও তিনটি উপজেলায় বেশ কিছু টিলা ছিল। এর মধ্যে জৈন্তাপুরে ৯৮টি টিলা ছিল। ২০০৯ সালে উপজেলা প্রশাসন উপজেলায় ৯৮টি টিলার কথা উল্লেখ করে। তবে বেলা বলছে, জৈন্তাপুরে বর্তমানে সাবাড় হওয়া টিলার সংখ্যা অনেক হবে। বেলার পরিদর্শন টিম চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি ও ১০ মে জৈন্তাপুর ইউনিয়নের শ্রীপুর (খরমপুর), মোকামপুঞ্জি, রাংপানিনদী, আলুবাগান, নিজপাট ইউনিয়নের গোয়াবাড়ি ও কমলাবাড়ি এলাকা পরিদর্শনকালে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের চিত্র দেখতে পায়। এছাড়াও সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়কের দু’পাশেই গভীর গর্ত করে পাথর উত্তোলনের চিত্রও দেখতে পান তারা।