দুঃখই কি মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি?
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:১৩:০১ অপরাহ্ন
রোমেনা আফরোজ
মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। এই বিপুল মর্যাদার উপাধিটুকু শুধু সে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, বাকিটুকু তাকে কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয়। এ সত্য জানার পরেও মানুষ শুধুই সুখ প্রত্যাশা করে, জীবন যুদ্ধে জড়াতে চায় না। এই অনীহা তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদাকে ক্ষুণœ করে, মানুষ নামক সত্তা থেকে বিচ্যুতি ঘটায়। এই মানসিকতা বিবর্তনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রহসন। কারণ একদিকে মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী, অপরদিকে সে গতি প্রাপ্ত হয়ে প্রতি মুহূর্তে বিবর্তিত হচ্ছে। আর বিবর্তনের সাথে জড়িয়ে আছে দুঃখ, কষ্ট, জরা-মৃত্যু। যদি মানুষ কষ্টকে অনিবার্য ধরে নিয়ে জীবন পরিচালনা করতে জানতো, তবে পরিস্থিতি সিসিফাসের মতো বৃত্তবন্দি হতো না। সে তার জীবনকে উপভোগও করতে পারতো।
যেকোনো বস্তুর রূপান্তরের জন্য একটা না একটা অনুষঙ্গের প্রয়োজন পড়ে। যেমন কাঠকে সারাদিন ফেলে রাখলেও কোনো পরিবর্তন হবে না। নির্দিষ্ট রূপ দেয়ার জন্য অবশ্যই মানুষকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং শ্রম ব্যয় করতে হবে। এই শ্রম কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কাঠের সাথে শ্রম যুক্ত হলেই কেবল সুন্দর একটা জিনিসের দর্শন পাওয়া যায়। তেমনি মানব জীবনের বিবর্তনের জন্য যন্ত্রণা অপরিহার্য। যন্ত্রণা মূলত একপ্রকার হাতিয়ার, সামনে এগিয়ে যাবার প্রধান অস্ত্র। এর মাধ্যমে মানুষ এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় পরিবর্তিত হয়। যদি কেউ এই কষ্ট মেনে নিতে না চায়, তবে তাকে সুখের আশাও বাদ দিতে হবে। জীবনদর্শন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বৈপরীত্য আছে। তারা বিনা পরিশ্রমে সুখ কামনা করে। কিন্তু সেটা অসম্ভব। একটা শিশুকে হাঁটার জন্য প্রথমে হামাগুড়ি দিতে হয়। দাঁড়াতে যেয়ে সে বারবার পড়ে যায়, ব্যথা পায়। এই ক্রমগুলো অতিক্রম করার পরই কেবল একটা শিশু হাঁটতে শেখে। আসলে ব্যথা মানুষকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে। একটা কথা প্রচলিত আছে, এই পৃথিবীতে আদমকে প্রেরণ করা হয়েছিল শাস্তি ভোগের জন্য। তাই যন্ত্রণা প্রতি পদে পদে ছায়ার মত বিচরণ করবে এটা মানুষের অনিযার্য নিয়তি।
পৃথিবীর সকল বস্তুর মধ্যে গতি বিদ্যমান। কিছু বস্তু ছোট থেকে বড় হয়। আবার কিছু বস্তু আকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে চলমানও। বস্তুর মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ গতি আছে বলেই তা ক্ষয় কিংবা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। মানুষকে এই বিবর্তনের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পথ চলতে হয়। একবার দুঃখ, কষ্ট এসে মানুষের চলার পথকে থামিয়ে দেয়, এতে যতটুকু গতি হ্রাস পায় সেটুকু আরেক পরিস্থিতি এসে পূরণ করে দেয়। বস্তুর সাথে গতি যেমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে, তেমনি যন্ত্রণাও মানবজীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এর থেকে মুক্তি অসম্ভব। তবে মেডিটেশনের মাধ্যমে কষ্টের অনুভূতিকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটুকুই।
আমার কাছে মনে হয়, জ্ঞান সহজাত বিষয়। কিন্তু বাস্তবতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ মানুষ সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন। অল্পকিছু মানুষ আছে যারা জ্ঞানী এবং গুণী। এই যুক্তিবলে সহজাত বিষয়টিকে বাতিল করা যায়। তারপরেও আমি বলবো মানুষের মধ্যে সকল জ্ঞান সমানভাবে প্রোথিত থাকে। মানুষ যতক্ষণ বিপরীত পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয় ততক্ষণ অন্তর্হিত শক্তি এবং সহজাত জ্ঞান সুপ্ত অবস্থায় থাকে। পথে বের না হলে যেমন নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যায় না, তেমনি কোনো ব্যক্তি যদি জাগতিক বিষয়ে মগ্ন থাকে তবে আধ্যাত্মিকতার পথ সৃষ্টি হয় না। এখানে বয়স, সময় এবং পরিস্থিতি মূল ভূমিকা পালন করছে। জীবনযন্ত্রণা মূলত জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরকে জাগিয়ে তোলে, মানুষকে পরিপূর্ণ করে। আদিম যুগে মানুষ যদি কষ্ট করে লোহার ব্যবহার না শিখতো তবে সভ্যতা এতদিনে ধ্বংস হয়ে যেতো। আসলে বিবর্তন সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখে।
সুফিদের মতে, যেকোনো বিষয়ের একটা জাহেরি এবং বাতেনি অংশ আছে। সাধারণ মানুষ কেবল দৃশ্যমান অংশ দেখতে পায়। একমাত্র প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি দেখতে পায় বাতেনি বা গোপন অংশ। সাধারণ মানুষ দুঃখ, কষ্টকে নেতিবাচক ভেবে সারাজীবন আক্ষেপ করে যায়। তারা ভাবে, মানুষ একবার জন্মগ্রহণ করে, মৃত্যুবরণ করে একবার। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, পার্থিব জীবনে মানুষকে অসংখ্যবার জন্মাতে হয়। বিভিন্ন দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা মানুষের মধ্যে নতুন নতুন বোধের জন্ম দেয়। জন্ম হয় ভাবের। আত্মা জাগ্রত হয়। সৃষ্টি হয় আধ্যাত্মিকতার পথ। অতঃপর মানুষ প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ একবার জন্মগ্রহণ করলেও মৃত্যুবরণ করে বারবার। কারণ তারা যে-পরিস্থিতিকে মৃত্যু বলে ধরে নেয়, তা মূলত মৃত্যু নয়। নবজন্ম। যেহেতু তাদের বোধ নিয়মিত জল-হাওয়া পায় না, তাই তাদের অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যায়। যারা যুদ্ধ করতে জানে, জানে মানুষের মধ্যে অপার শক্তি নিহিত আছে, তারা বারবার নবজন্মের স্বাদ পায়।
এই পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ সুখ চায়। কিন্তু সুখ হলো একপ্রকার অধরা মানসিক স্থিতির নাম। মূলত মানুষকে কর্মে মগ্ন থাকতে হয়। যাদের কাছে কর্মই প্রধান, তারা সুখ-অসুখ ভাবার অবকাশ পায় না। সুখ যদি কোনো বস্তুর সাথে যুক্ত থাকে যেমন চাকরি, গাড়ি, নারী ইত্যাদি, তখন তা দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়। অনেকে মনে করেন, টাকাই সুখের মূলমন্ত্র, একমাত্র টাকাই সব সমস্যাকে এক তুড়িতে গায়েব করে দিতে পারে। কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়। একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে সম্পদশালী মানুষদের মধ্যে মানসিক সমস্যা সবচেয়ে বেশি। আসলে যেকোনো পরিস্থিতিতে সুখী হওয়া যায়। এরজন্য চর্চার প্রয়োজন। ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিবার মন-মস্তিষ্কে গেঁথে দেয়, পড়ালেখা করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। অর্থাৎ সুখী হওয়ার জন্য ডিগ্রি ও গাড়ি নামক বস্তুর প্রয়োজন। এই যে সাংস্কৃতিক দৈন্য এই দৈন্য আজীবন থেকে যায়।
পূর্বে আমি নিজ শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম। জীবনের দুঃখবোধ আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। শারীরিক এবং মানসিক কষ্টের জন্য অপরকে দোষারোপ করে ক্ষণিক শান্তি পেলেও যন্ত্রণা বেড়ে গিয়েছিল চূড়ান্তমাত্রায়। তখন ভাবতাম শক্তি ক্ষয়ে গেলেই মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু মানুষের ভেতর স্রষ্টা যে ঈশ্বরকণা হয়ে বিদ্যমান আছেন, সেই শক্তিকে হৃদয়-মন-অস্তিত্ব দিয়ে জাগাতে পারলে অসীম শক্তিকে পুনরুদ্ধার করাও যায়, তা জ্ঞাত হয়েছি নরকযন্ত্রণা ভোগের পর। বর্তমানে কোনো বিপরীত ঘটনার মুখোমুখি হলে ইতিবাচক ধরে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাই। এই শিক্ষা আমাকে কোনো পাঠ্যপুস্তক দিতে পারেনি। যখন জীবনযুদ্ধকে মানুষের পরিণতি হিসেবে মেনে নিয়েছি, তখন জীবন শিক্ষক হয়ে নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একটা কথা সবাইকেই মনে রাখতে হবে, এখনকার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা জীবনমুখী নয়, রাষ্ট্রমুখী। তাই মানুষ জানে না জীবনের দর্শন। যেখানে জীবনদর্শন বাতিল মাল হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানে উত্তরণের কোনো পথ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
লেখক : প্রাবন্ধিক