সার্জারির পর হনুমানটি সুস্থ হয়ে উঠছে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:২৮:১১ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম :
শরীরের বেশকিছু স্থানে মারাত্মকভাবে আহত হওয়ায় হাত এবং পায়ে সার্জারি করে সেলাই দিতে হয়েছে বিপন্ন প্রজাতির মুখপোড়া হনুমানটিকে। ফলে বর্তমানে সে সুস্থতাবোধ করছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে আরো কয়েকটা দিন তাকে থাকতে হবে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালে, প্রাণী অধিকার ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকারের তত্ত্বাবধানে।
হনুমানটি অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। এ অবস্থায় গত ৪ সেপ্টেস্বর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সিলেট সদর উপজেলার এয়ারপোর্ট সড়ক সংলগ্ন খাদিমনগর ইউনিয়নের কাকুয়ারপাড়ে গুরুতর আহত অবস্থায় যখন হনুমানটি ছটফট করছিলো; তখন এগিয়ে এলেন স্থানীয় বাসিন্দা রিপন কুমার দেব, এমদাদুল হক সোহাগ, মতি মিয়া ও শামিম আহমদসহ কয়েকজন।
পরবর্তীতে লিটন দেব ও তার ভাই ট্রাক চালক রিপন দেব হনুমানটিকে তাদের বাসায় নিয়ে আসেন। প্রাথমিক সেবা শুশ্রƒষা শেষে কিছুটা সুস্থ হওয়ায় হনুমানটিকে ছেড়ে দেয়া হয়। তখন আশপাশের গাছে থাকা কয়েকটি বানরের সাথে ঘোরাফেরার একপর্যায়ে গাছ থেকে পড়ে হনুমানটির গর্ভপাত হয় এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে।
মেছোবাগ, হরিণ কিংবা সাপ হঠাৎ যখন লোকালয়ে চলে আসে, তখন তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরকম খবর, এরকম ঘটনা
প্রায়সময় ঘটে আমাদের চারপাশে। কিন্তু কাকুয়ারপাড়ের মানুষ মানবিকতার নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
মানুষ নয়, একটি হনুমানের জীবন বাঁচাতে বেশ কয়েকজন মানুষ এগিয়ে এলেন। তারা তাদের প্রাত্যহিক কাজ ফেলে প্রাণিটিকে দেখভালের পাশাপাশি ওইদিন বিষয়টি অবগত করেন সিলেট বন বিভাগকে। বনবিভাগ প্রাথমিকভাবে তাদেরকে একটি ইনজেকশন পুশ করতে বলেন। ‘স্টেরনভেট’ নামে ইনজেকশনটি আশপাশের ফার্মেসিতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যাচ্ছিলো না। খোঁজাখুজি করতে করতে ওইদিন আর ট্রাক চালাতে যাওয়া হয়নি রিপন দেবের।
তবু হাল ছাড়েননি তারা। শহরে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে তারা বিমানবন্দর এলাকার কাকুয়ারপাড় থেকে মির্জাজাঙ্গালস্থ পশুপাখির ওষুধ বিক্রেতা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ইনজেকশন সংগ্রহ করেন। বন বিভাগের কথামত নিজেই ইনজেকশনটি হনুমানের শরীরে প্রয়োগ করেন রিপন।
এরই মধ্যে খবর পেয়ে যান পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) প্রাণী অধিকার ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকারের সভাপতি মাহাদী হাসান। তারা অসহায় প্রাণীটির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে, সুস্থতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
এদিকে, কিছুটা সুস্থবোধ করলে পরেরদিন বানরটি নিজেই গাছে উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। একপর্যায়ে গাছ থেকে পড়ে রক্তপাত শুরু হয়। রক্তপাতের খবর পেয়ে পরের দিন আবারো ছুটে যান ভূমিসন্তানের আশরাফুল কবীর এবং প্রাধিকারের মাহাদী হাসান।
রাত তখন এগারোটা। অবস্থার অবনতি হলে তারা বানরটিকে একটি সিএনজি অটোরিকসায় নিয়ে আসেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রাধিকারের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালে। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর হনুমানটিকে চিকিৎসার পাশাপাশি খাবার দেয়া হয়। তবে হাতে একটি আঙ্গুল এবং একটি পা ফেটে যাওয়ায় প্রাণিটিকে সার্জারি করে সেলাই দিতে হয়েছে।
প্রাধিকার সভাপতি মাহাদী হাসান বলেন, আমরা হনুমানটিকে পর্যবেক্ষণে রেখেছি এবং তার চিকিৎসা চলছে। হনুমানটি এখন কিছুটা সুস্থ এবং নিজেই খাবার খেতে পারছে। আশা করি এক সপ্তাহের মধ্যে এটি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থ হলেই আমরা তাকে সেই জঙ্গলে অবমুক্ত করবো, যেখান থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে।
আশরাফুল কবীর বলেন, হনুমানের শারীরিক অসুস্থতা যতটা কষ্ট দিয়েছে তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি একটি বন্যপশুর জন্য মানুষের আন্তরিকতা দেখে, ভালোবাসার বিশালতা দেখে। মূলত তাদের ভালোবাসা, যতœ আর মায়ায় হনুমানটিকে আমরা জীবিত পেয়েছি। তারা চাইলে হনুমানটিকে যতœ না করে পিটিয়ে হত্যা করতেও পারতেন।
হনুমানটির সার্জারির দায়িত্বে ছিলেন পি.এম.এ.সি. ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মোঃ মাহফুজুল হক মামুন, প্রাধিকারের উপদেষ্টা ডা. মোঃ মাসুদ পারভেজ। চিকিৎসার সার্বিক ব্যবস্থায় প্রাধিকারের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তিসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।